শোকের আগস্ট বেদনার ধারাভাষ্য

তার কর্ম সংগ্রাম ও চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে সারাবিশ্বে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বাঙালি জাতি চিরকাল শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করবে।

প্রকাশ | ০৪ আগস্ট ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৪ আগস্ট ২০২১, ১০:২৫

সালাম সালেহ উদদীন

শুরু হয়েছে শোকাবহ আগস্ট মাস। এই মাস বাঙালি জাতির জন্য এক বেদনাবিধূর মাস। এই মাসের ১৫ ও ২১ আগস্ট খুবই মর্মপীড়াদায়ক। ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কলঙ্কিত বর্বরোচিত অধ্যায়। আমরা হারিয়েছি বাঙালির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের মহাকাব্যিক বীর নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। হারিয়েছি তার দুই কন্যা ব্যতিরেকে পুরো পরিবারকে। যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুনিচক্র কেবল ব্যক্তি মুজিবকেই হত্যা করেনি। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তির ওপর আঘাত হানে। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে পিছিয়ে নিয়ে যায়। পঁচাত্তরের ক্ষমতাসীন সামরিক-বেসামরিক এলিটচক্র বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শগত অবস্থান ও লক্ষ্য থেকে সরিয়ে এনে একটি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে। রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা বেদখল করে এবং সংবিধানের কর্তৃত্ব ধ্বংস করে। দেশব্যাপী হত্যা, সন্ত্রাস, জোর-জবরদস্তি চলে। পরে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল তাহেরের হত্যাকান্ড, বিচার প্রহসনের নামে সশস্ত্র বাহিনীর শত শত মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও জোয়ানকে হত্যা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনায় আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ইত্যাদি এর নজির হয়ে ওঠে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদকে অর্থাৎ '৭১-এর সশস্ত্র আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনীতিতে যেমন দক্ষিণপন্থি ধারায় বিএনপি তথা জাতীয় পার্টি গড়ে ওঠে, তেমনি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সমাজ গঠনের মধ্য যে পরিবর্তনগুলো সাধিত হয়েছিল পূর্বোক্ত রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো ছিল তারই প্রতিফলন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনিরাও প্রকাশ্যে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলে রাজনীতির অঙ্গনে সক্রিয় হতে চেষ্টা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রধানত সামরিক শাসনের ছায়াতলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের স্স্নোগানের আড়ালে চরম দক্ষিণপন্থিসহ প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সংগঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হয় শক্ত প্রতিরোধ। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। একদিকে ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর জোর দিয়ে, এমনকি একপর্যায়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে তারা যেমন নিজেদের প্রভাব দৃঢ়মূল করতে চেয়েছে তেমনি একই ধারায় অন্ধ ভারত বিরোধিতাকে পুঁজি করে নিজেদের রাজনীতি পরিচালনা করতে চেয়েছে সব সময়। বাংলাদেশের রাজনীতি বহুল পরিমাণে উথাল-পাতাল অবস্থার মধ্যদিয়ে কালাতিপাত করেছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০ সালের আজকের দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একজন নেতা তার দেশের মানুষকে মর্যাদাপূর্ণ আত্মপরিচয়ের আলোকে কী অপরিসীম সাহসিকতার মধ্যদিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের সর্বস্তরের মানুষ তথা আবালবৃদ্ধবণিতার ভালোবাসা, হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধা ও সম্মানে তিনি অভিষিক্ত হয়েছেন। সমগ্র দেশের মানুষ অকৃত্রিম ভালোবাসার ও বিশ্বাসের কারণে তার ওপর অর্পণ করে পূর্ণ আস্থা, তাকে স্থান দেয় তাদের হৃদয়ে। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আমরা তাকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। স্মরণ করি তার কাজ, চেতনা ও আদর্শকে। তিনি বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছেন, এ দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, এটা আমাদের সৌভাগ্যের কথা। তিনিই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রূপকার এবং প্রতিষ্ঠাতা। দেশের মানুষের স্বার্থের বিষয়ে তিনি সব সময় ছিলেন আপসহীন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি সব সময় ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ। কখনো কোনো কিছুর বিনিময় বা প্রলোভনে বা ভয়ে বিন্দুমাত্র নতি স্বীকার করেননি। \হবঙ্গবন্ধু মাত্র ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কেবল পাকিস্তান আমলেই ১৮ বার কারারুদ্ধ হয়ে ১২ বছর জেলে কাটিয়েছেন। ২৪টি মামলা তিনি সাহসের সঙ্গে লড়েছেন এবং দুইবার মৃতু্যর সামনে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর অকুণ্ঠ ভালোবাসায় ফিরে এসেছেন। তিনিই প্রথম নেতা যিনি মাতৃভাষায় প্রথম জাতিসংঘে ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষার মুখ উজ্জ্বল করেন। সত্তরের নির্বাচনে জাতির অবিসংবাদিত নেতারূপে তিনি অভিষিক্ত হন। গোটা জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেন। শুরু হয় এক অভূতপূর্ব আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন। দেশের মানুষকে তিনি মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করেন। এরই একপর্যায়ে আসে মহান একাত্তরের ৭ মার্চ। সেদিন ঢাকার ঐতিহাসিক জনসমুদ্রে তিনি যে ভাষণ দেন সেটাই হয়ে ওঠে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অতু্যজ্জ্বল মাইলফলক। তিনি ঘোষণা করেন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তিনিই তার নেতৃত্বের মাধ্যমে জাতিকে পৌঁছে দিয়ে গেছেন স্বাধীনতার স্বর্ণ তোরণে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, মৃতু্যঞ্জয়ী মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে এক মুহূর্ত সময় অপচয় করেননি। পাকিস্তানি হানাদাররা শুধু এ দেশের ৩০ লাখ মানুষকেই হত্যা করেনি, এ দেশের স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, অফিস-আদালত, কল-কারখানা সব ধ্বংস করে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনে শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম। দিন-রাত বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত পরিশ্রম আর কূটনৈতিক পারদর্শিতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে থাকে। \হবঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তার হত্যার বিচার করা যাবে না- এই লক্ষ্যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়াই শুধু নয়, রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম থেকে তার নাম বা তার কথা প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক কথায় মানুষের মন থেকে বঙ্গবন্ধুর কথা, তার স্মৃতি, তার অবদান মুছে ফেলার যাবতীয় অপচেষ্টা করা হয় সে সময়। কিন্তু ইতিহাস বিকৃত করা, বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা, তার ভূমিকা খাটো করে দেখানো ইত্যাদি চেষ্টা যে সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে সেটা সময়ের পরীক্ষায় প্রমাণিত। অবশেষে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে স্বাধীনতার স্থপতিকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের পথও সুগম হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হতে থাকে। দিনটিকে সরকারি ছুটির দিনও ঘোষণা করা হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে এ ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন বাতিল করে দেওয়া হয়। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি চূড়ান্ত অবমাননা ও অমর্যাদা। পরে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শোক দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কারণ বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, এগিয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রের পূর্ণতার পথে। যদিও করোনা মহামারিকালে এই ধারাবাহিকতা কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশ আবার এগিয়ে যাবে স্বমহিমায়। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ, তার স্বপ্নকে পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। বস্তুত, ১৯৭১, ১৯৭৫ ও ২০০৪-এর আগস্ট গণহত্যা ও হত্যা প্রচেষ্টার লক্ষ্য এক, শত্রম্ন এক কেবল তাদের চামড়ার রং ও মুখের ভাষা আলাদা। এ স্বদেশী পাকিস্তানিদের রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করতে না পারলে এবং বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও সদাজাগ্রত রাখতে না পারলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অসমাপ্তই থেকে যাবে। তার কর্ম সংগ্রাম ও চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে সারাবিশ্বে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বাঙালি জাতি চিরকাল শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করবে। সালাম সালেহ উদদীন : কবি কথাসাহিত্যিক প্রাবন্ধিক কলাম লেখক ও সাংবাদিক