শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

​বঙ্গবন্ধুর জীবনে দীপ্তিমতী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব

কৃষিবিদ কামরুল হাসান কামু
  ০৬ আগস্ট ২০২১, ২১:৫৪

বাংলাদেশ সৃষ্টির নেপথ্যে দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তপ্লাবনের ইতিহাস রয়েছে। এই কণ্টকাকীর্ণ সংগ্রামে কেউ কেউ সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন কেউবা লোকচক্ষুর আড়ালে মুক্তিসংগ্রামে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তাদের-ই একজন হলেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। একজন সাধারণ গ্রাম্যবধূ, চেতনার তুলি দিয়ে কালের বেদীমূলে মুক্তির চিহ্ন রেখেছিলেন বীরদর্পে। তার চিন্তা, চেতনা, মেধা-মনন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দৃঢ়তা দিয়ে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পথ চলাকে সাবলীল করেছেন। আদতে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে শেখ ফজিলাতুন নেছা একজন স্নেহময়ী মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তার অন্তহীন ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রামের মাধ্যমে ক্রমেই হয়ে উঠেন বঙ্গমাতা রুপে।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট, গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। পুষ্পিত ফুলের মতো সৌন্দর্যের জন্যে তার নাম রাখা হয় রেণু। ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়েছেন, পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর পিতামাতার আদরযত্নে বেড়ে উঠেন। সে সময় নারী শিক্ষার পথ ছিলো রুদ্ধ কিন্তু রেণুর পড়াশুনার প্রতি অদম্য স্পৃহা ছিলো। গোপালগঞ্জের মিশনারি স্কুলে স্বল্পকাল শিক্ষাজীবন শেষে পারিবারিক পরিমণ্ডলে শিক্ষালাভ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছোটবেলা থেকে রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন যা খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্ত্রী রেণু। বঙ্গবন্ধুর সমাজসেবার মনোভাব, স্ত্রী রেণুর মনে প্রভাব বিস্তার করেছিলো সেসময় থেকে। তিনিও ধীরে ধীরে সেই সময় থেকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেন। পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ তাকে বঞ্চিত করেননি বরং অসামান্য হৃদয়ের মানুষ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, স্বামীর রাজনৈতিক কাজে সেখান থেকে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। বিশ্বরাজনীতির দিকপালদের জীবনী বিশ্লেষণ করলে সহজে অনুমেয় হয়, গণমানুষের নেতা হয়ে উঠার পেছনের কারিগর হিসেবে স্ত্রীজাতির ভূমিকা ছিলো অসামান্য। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন আখ্যানে, স্ত্রী রেণু ছিলেন একজন বিশ্বাসী রাজনৈতিক সহযোদ্ধা।

বাঙালি নারীকুল স্বামীর ছত্রছায়ায় জীবনকাটাতে আগ্রহী, নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের প্রতি তাদের আকুতি বেশি থাকে। রাজনৈতিক কারণে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায় ১৩ বছর ৬ মাস কারাভোগ করতে হয়েছিলো; সে সময় স্ত্রী রেণু অসামান্য মানসিক শক্তি নিয়ে নিজের পরিবারকে আগলে রাখার পাশাপাশি দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করেছেন সন্তর্পণে। কর্মীসূলভ মানসিকতা আর মমতার আদলে তিনি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছেন যা পত্রপত্রিকায় ছাপা না হলেও শেখ মুজিব তার জীবনী গ্রন্থ 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে অসংখ্যবার উচ্চারণ করেছেন। এই বইটি রীতিমতো রাজনীতির বাইবেল বললেও ভুল হবেনা। এই অসামান্য বইটি পাকিস্তান গঠন ও সেখান থেকে বাংলাদেশ তৈরির রুপরেখা, প্রেক্ষাপট সকল কিছুর বাস্তব আলেখ্য-চিত্র, ইতিহাসের এক তথ্যবহুল বই যার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাসের বাণী পৌঁছে যাচ্ছে দোরগোড়ায়। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি রচনার পিছনেও স্ত্রী রেণুর অনুপ্রেরণা ছিলো যা শেখ মুজিব গ্রন্থের প্রথমেই তুলে ধরেছেন।

তিনি বলেছেন,“আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। বললাম, লিখতে যে পারি না, আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে কি জনসাধারণের কোন কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুক বলতে পারি নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”

শেখ মুজিব উক্ত গ্রন্থে আরও বলেছেন, “আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু, আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিলো, জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিলো তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।” এই বইটি না থাকলে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারতাম না, অনেক দেশপ্রেমিকের নামও থেকে যেতো লোকচক্ষুর আড়ালে।

শেখ মুজিবের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছিলো স্কুল জীবন থেকেই। তিনি যখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ৭ম শ্রেণি ছাত্র তখন স্কুলের ছাত্রাবাসের অবস্থা নাজুক ছিলো। তিনি শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবে স্কুল পরিদর্শনে আসা জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের পথরোধ করে স্কুলের ছাত্রাবাস মেরামতের জন্য ১২শ টাকা আদায় করেন। স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা রেণু তার স্বামীকে এই সাহসী কাজের জন্যে সাধুবাদ জানান এবং ক্রমেই শেখ মুজিবের সংগ্রামী জীবনের প্রেরণাদাত্রী হিসেবে স্ত্রী রেণু নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন। স্বামীর প্রতি তার কোন অনুযোগ, অভিযোগ ছিলোনা। একটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা সহজে উপলব্ধি করা যায়। শেখ মুজিবের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার জন্মের সময় কলকাতায় দাঙ্গা চলছিলো, পিতা মুজিব সে সময় দাঙ্গা নিরসনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পাশে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, প্রথম সন্তানের জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে মানসিকভাবে থাকতে পারেনি তবুও কোন অনুযোগ ছিলোনা স্ত্রী রেণুর। তিনি জানতেন স্বামী মুজিব দেশসেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে স্বামীকে কখনো কোন কাজে বাঁধা কিংবা নিরুৎসাহিত করেননি। এমনই একজন সহ্যশীলা বাঙালি নারীর মূর্ত প্রতীক ছিলেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। শেখ মুজিবের বার বার কারাভোগ স্ত্রী রেণুর মনে রাজনীতির একটা গ্রামাটিক দৃশ্যায়নের অবতারণা করে। তিনি ততোদিনে বুঝে গেছেন আন্দোলন সংগ্রাম, কারাভোগের মাধ্যমে শেখ মুজিব এক অনন্য মুক্তির দিকে যাত্রা করেছেন।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের কাজে অন্যদের মতো শেখ ফজিলাতুন নেছা রেণু কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত মন্ত্রীসভার সদস্য হোন। অল্প সময়ে মন্ত্রীসভা ভেঙে যায়, গ্রেফতার হোন বঙ্গবন্ধু, স্ত্রী রেণুকে নোটিশের চাপে বাসা ছাড়তে হয়। তখনকার দিনে ঢাকায় বাসা খোঁজা, সংসার চালানো, দুঃসময়ের পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের বঙ্গমাতা অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এরপর ১৯৫৫ সালে আবার মন্ত্রীসভার সদস্য হোন বঙ্গবন্ধু, পরবর্তীতে দলের জন্যে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দলের হাল ধরেন। শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব কোন সাধারণ বাঙালি নারী হলে স্বামীর স্বেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারতেন না। লোভ, লালসা তাঁর অভিধানে ছিলোনা, তিনি সাধারণের মাঝে ছিলেন অসাধারণ।

ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু অনেকবার কারাভোগ করেন, এই সময়ে মামলা-মোকদ্দমা চালানো, কোর্টে যাওয়া এবং বাড়ি খোঁজা, দলীয় নেতাকর্মীদের খোঁজ খবর নেওয়া, যারা বন্দী হয়েছিলেন তাদের পরিবারে খাবার আছে কিনা, কারো অসুখ হয়েছে কিনা সে সব ধৈর্যের সঙ্গে করেছেন। পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ এমনকি নিজের গহনা বিক্রি করে তিনি মানুষের পাশে থেকেছেন।

বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি যেটি তৈরীতে মেহনত রয়েছে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের। এ বাড়িটা তৈরি করার সময় লেবার খরচ বাঁচানোর জন্য নিজের হাতে ওয়ালে পানি দিতেন, ইট বিছাতেন। এই বাড়িতেই বসবাসকালে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৬৪ সালের রায়টের সময় শেখ মুজিব অনেক হিন্দু পরিবারকে বাড়িতে শেল্টার দেন, তাদের খাওয়া-দাওয়া করানো, খোঁজখবর রাখা সব কাজ অতি যত্নের সাথে করেছেন স্ত্রী রেণু। এরপর ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ঘোষণা দেন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার। সারাদেশে তিনি সভা সমাবেশে বক্তৃতায় ৬ দফার বাণী পৌঁছে দিতে থাকেন জনসমুদ্রে। এসময় বার বার গ্রেফতার হোন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদ আন্দোলনে সারাদেশ উত্তাল হতে থাকে। গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করতেন, গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন। ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতাল খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, ছাত্র আন্দোলন, গণ আন্দোলন, হরতালকে বেগবান করতে সে সময় তিনি রীতিমতো একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে লোক চক্ষুর আড়াল থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের রাজনৈতিক দৃঢ়তা লক্ষ্য করা যায়, ৬ দফা আন্দোলনে। এসময় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ হয়, কেউ কেউ ৮ দফার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ফলে দেখা দেয় বিভক্তি। তিন দিনের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং এ শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন ৬ দফার পক্ষে। মূলত কারাবন্দী শেখ মুজিবের বার্তাবাহক ছিলেন স্ত্রী রেণু, শেখ মুজিবের দিক নির্দেশনার আদলে তিনি অনড় ছিলেন।

শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ক্রমশ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আলো ছড়াতে থাকেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে আইয়ুব খান গোল টেবিল বৈঠক আহ্বান করেন, শেখ মুজিব তখন বন্দী, দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে আবারো সিদ্ধান্তে মতবিরোধ দেখা দেয়; অধিকাংশ গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়ার জন্যে প্ররোচিত করেন। এসময় জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার মাধ্যমে শেখ ফজিলাতুন নেছা, কারাবন্দী বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যেন গোলটেবিল বৈঠকে যোগ না দেন, যোগ দিতে হলে পরিপূর্ণ মুক্তি নিয়ে যেন যান। এসময় দলীয় অনেকেই বলেছিলো, বৈঠকে যোগদান না করলে সর্বনাশ হতে পারে, শেখ মুজিবকে জীবিত নাও পেতে পারি। তারা বলতেন, ‘‘আপনি তো বিধবা হবেন।’’

শেখ ফজিলাতুন নেছা সেসময় শুধু বলেছিলেন, ‘‘আমি তো একা না, এখানে তো ৩৪ জন আসামি, তারা যে বিধবা হবে এটা আপনারা চিন্তা করেন না? আমার একার কথা চিন্তা করলে চলবে? আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ৩৫ জনের মধ্যে ৩৪ জনই তো বিবাহিত। মামলা না তুললে উনি যাবেন না।’’ সেদিন একজন গ্রাম্যবধূ যে দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখিয়েছিলেন যা আমাদের স্বাধীনতার পথ সুগম করেছে। কারণ সেদিন যদি প্যারোলে যেতেন শেখ মুজিব, তাহলে কোনোদিনই আর বাংলাদেশ স্বাধীন হত না, এটা হল বাস্তবতা। থেমে যেতো সারাদেশে সে আন্দোলনের উত্তাল অবস্থা। কারাবন্দী শেখ মুজিব সহ সকল আসামীর মুক্তির লক্ষ্যে ক্রমশ গণআন্দোলন গড়ে উঠে সে সময়।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বার্তা কি হবে সেটা নিয়ে দলের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। অনেক বিজ্ঞ নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্যে শেখ মুজিবকে প্ররোচিত করতে থাকে, এমনকি মনোমালিন্য ও হয়। এসময় শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন ছায়াসঙ্গীর মতো। গুরুত্বপূর্ণ কিছুতে যাওয়ার আগে ফজিলাতুন নেছা, বঙ্গবন্ধুকে বলতেন ‘‘কিছুক্ষণ তুমি নিজের ঘরে থাক। ’’তাঁকে ঘরে নিয়ে তিনি একটা কথা বললেন যে, ‘‘তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সে কথা বলবা। কারণ লাখো মানুষ সারা বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছে, হাতে বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা নিয়ে।’’ সামনে জনগণ, পেছনে গুলি, প্রস্তুত পাকিস্তানের বোমারু বিমান-এমন এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন। আজ সে ভাষণ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, নিয়ে এসেছে খ্যাতি। এরপর নেমে আসে কালোরাত। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পরে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে মগবাজারের একটা বাসা থেকে গ্রেফতার করে ১৮ নম্বর রোডের একতলা বাসায় বন্দীরাখা হয়। এক অজানা আতঙ্কে দিন পার করতে হয়েছে তখন।

যুদ্ধের পর প্রধানমন্ত্রীর বউ হিসেবে তাকে কখনো বিলাসিতা করতে দেখা যায়নি। যুদ্ধের পর নির্যাতিত মেয়েদের পাশে পরম মমতায় দাঁড়িয়েছিলেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। স্বাধীনতার পর সে সব নির্যাতিত মেয়েদের সাহায্য করা, তাদেরকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া, বোর্ডের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, ওই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, এমনকি তাদের গহনা দেওয়া এইসব কাজে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সংশ্লিষ্টতা ছিলো।

শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় আবারো পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালে। সে সময় লাহোরে অনুষ্ঠেয় ইসলামী সম্মেলনে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। কারণ হিসেবে তিনি বলেন- বঙ্গবন্ধু লাহোরের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলে স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে রাষ্ট্রীয় সফরের দাওয়াত দিতে হবে ফলে স্বাধীনতা বিরোধীরা আবারও আগ্রত হতে পারে। শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সে ইঙ্গিত বাস্তবায়িত হয় ১৫ আগস্টে। বাঙালি জাতির এক কালো অধ্যায় রচিত হয়। আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের বঙ্গমাতা, আমাদের বঙ্গবন্ধু সহ পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের। এমন এক ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের কালিমা নিয়েই এই জাতিকে চলতে হবে। একজন সাধারণ গ্রাম্য বধূয়া থেকে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব এক দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গমাতা রুপে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই, মহীয়সী মায়ের প্রতি।

লেখক-

কৃষিবিদ কামরুল হাসান কামু

কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা

ফুলপুর, ময়মনসিংহ।

ইমেইল- [email protected]

যাযাদি/ এমডি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে