মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন-জীবিকায় করোনার আঘাত

প্রিন্সিপাল এমএইচ খান মঞ্জু সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এমএইচ খান ডিগ্রি কলেজ গোপালগঞ্জ
  ০৯ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ০৯ আগস্ট ২০২১, ১১:৩৩

করোনা মহামারি ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। লকডাউন দীর্ঘস্থায়ী করেও খুব একটা সুফল মিলছে না। এদিকে দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। চাকরিনির্ভর মধ্যবিত্তদের অবস্থা খুবই খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের চাকরি থাকলেও আংশিক বেতন পাচ্ছেন। এমন অবস্থায় তাদের পক্ষে পরিবার নিয়ে টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। অনেকের যে সামান্য সঞ্চয় ছিল, তা-ও শেষ হয়ে গেছে। নিম্নবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষ সামান্য পরিমাণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা পেলেও বেশির ভাগই তা পায়নি। বাস, লঞ্চসহ গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। আগের লকডাউনের সময় জেলাগুলোতে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে শ্রমিকদের আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা হলেও আজও তা তাদের হাতে পৌঁছায়নি। এ অবস্থায় লকডাউন যদি আরও দীর্ঘ হয়, তাহলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা কী করবেন, কেউ-ই জানেন না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপে উঠে এসেছে, করোনা মহামারির এ সময়ে দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) আরেকটি জরিপ অনুসারে, মহামারির প্রভাবে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশই হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর সরকার মোট ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। যেগুলোর মোট আর্থিক মূল্য ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। কিন্তু এগুলোর মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে রক্ষায় তেমন কিছুই নেই। সর্বশেষ যে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার নতুন প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, সেখানেও নেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আবার যেসব ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা এসব প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পেয়েছেন, তারাও শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন কিংবা শ্রমিকদের কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য করিয়েছেন। তাই অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রণোদনা প্যাকেজের লক্ষ্য অর্জনে সরকারের নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও আরও মানবিক হতে হবে এবং কর্মীদের জীবন-জীবিকা রক্ষায় আন্তরিক হতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান নিতান্ত বাধ্য হয়ে কর্মী ছাঁটাই করছে, প্রয়োজনে সেসব প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে করা হচ্ছে, মহামারির প্রভাব শিগগিরই কাটবে না। সে কারণে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রণোদনা প্যাকেজের পাশাপাশি দরিদ্র ও বিপদে পড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে রক্ষায় সরকারের সহায়তা কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে এসডিজি অর্জন ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও কাজ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। করোনাকালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। বাংলাদেশও সে কালো থাবা থেকে মুক্ত নয়। এটি জাতির জন্য এক বড় দুঃসংবাদ হলেও সুসংবাদ হলো সে ধকল দ্রম্নত কাটিয়ে ওঠার সাফল্য দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান অনন্য। এ খাতে করোনা তেমন কোনো অপপ্রভাব ফেলতে পারেনি। চলতি বোরো মৌসুমেও বাম্পার ফলন হয়েছে এবং এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ধান কাটা। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক থাকায় অর্থনীতিতে করোনা অভিঘাতের চাপ কমছে। রপ্তানি খাতের খরা কাটছে। রেমিট্যান্স ও রিজার্ভে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে করোনাকালেই। তবে সামনের দিনগুলোয় দুশ্চিন্তা বাড়ছে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও বেকারত্ব নিয়ে। গত বছরের এ সময় করোনাঘাতে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির ছিল। সে ভয়ংকর দুর্দিনে সরকারি খাতের নানা প্রণোদনা ও বেসরকারি খাতের সার্বিক প্রচেষ্টায় অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে আবারও শুরু হয়ে যায় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ। এ সংক্রমণ ঠেকাতে বর্তমানে চলছে লকডাউন। কিন্তু গত বছরের মতো সবকিছু বন্ধ করে না দিয়ে শিল্প-কারখানা খোলা রাখা হয়েছে। এতে একদিকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে অর্থনীতিও রয়েছে সচল। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই অপ্রাতিষ্ঠানিক ও বেসরকারি খাতের সঙ্গে জড়িত। ফলে সবকিছু বন্ধ রাখলে কার্যত মানুষের জীবনই অচল হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আয় কমেছে বিপুলসংখ্যক মানুষের। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে জুতসই পথ উদ্ভাবন করা না গেলে বিপদ এড়ানো কঠিন হবে। বৃদ্ধি পাবে সামাজিক অস্থিরতা। করোনার আগে দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য দেখিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রতি বছর অন্তত ১ শতাংশ দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। করোনাকালে দরিদ্র হয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। গ্রহণ করতে হবে কার্যকর কর্মপরিকল্পনা। এ মুহূর্তে মহামারি নিয়ন্ত্রণে বেশির ভাগ মানুষকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেভাবেই নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লাগতে হবে। একই সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষায়ও সরকারকে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে