আফগানে তালেবান এবং বাংলাদেশে তার প্রভাব

ওই সময়েও তালেবান শরিয়াভিত্তিক সরকার আফগানিস্তানকে প্রতিষ্ঠা করে। শরিয়াভিত্তিক সরকারের ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে ওমরে নেতৃত্বাধীন সরকার ১৫টি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। এই অধ্যাদেশগুলোর মধ্যে প্রথমটি ছিল- কোনো নারী বোরকাবিহীন চলাফেরা করতে পারবে না। কোনো বোরকাবিহীন নারীকে গাড়িতে ওঠালে চালককে গ্রেপ্তার করা হবে। বোরকাবিহীন কোনো নারীকে রাস্তায় চলাফেরা করতে দেখলে তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হবে। কোনো নারীই অভিভাবক ছাড়া বাড়ির থেকে বের হতে পারবে না। সব ধরনের খেলাধুলা নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ মাঠের অ্যাথলেটেও নারীরা অংশ নিতে পারেনি। এবারও তারা তাই করছে।

প্রকাশ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:২৮

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

আফগানিস্তানে তালেবানরা পুনরায় সরকার গঠন করেছে। তালেবান সরকার স্পষ্টত ঘোষণা দিয়েছে, তাদের সরকার ব্যবস্থা হবে শরিয়াভিত্তিক। এর আগে আফগানিস্তানে তালেবানরা সরকার গঠন করে। সেই সময় সারা আফগানিস্তান জুড়ে সরকার কর্তৃক যে নিয়মগুলো প্রচলিত ছিল, সেগুলোর একটু মূল্যায়ন করা দরকার। ওই সময়েও তালেবান শরিয়াভিত্তিক সরকার আফগানিস্তানকে প্রতিষ্ঠা করে। শরিয়াভিত্তিক সরকারের ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে ওমরে নেতৃত্বাধীন সরকার ১৫টি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। এই অধ্যাদেশগুলোর মধ্যে প্রথমটি ছিল- কোনো নারী বোরকাবিহীন চলাফেরা করতে পারবে না। কোনো বোরকাবিহীন নারীকে গাড়িতে ওঠালে চালককে গ্রেপ্তার করা হবে। বোরকাবিহীন কোনো নারীকে রাস্তায় চলাফেরা করতে দেখলে তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হবে। কোনো নারীই অভিভাবক ছাড়া বাড়ির থেকে বের হতে পারবে না। সব ধরনের খেলাধুলা নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ মাঠের অ্যাথলেটেও নারীরা অংশ নিতে পারেনি। এবারও তারা তাই করছে। \হতাই বর্তমানে তালেবান পুনরায় ক্ষমতা আসার পর নারী ক্রীড়াবিদরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশের কোনো নাগরিকই কোনো ধরনের গান-বাজনা করতে পারবে না। মাইক এবং লাউড স্পিকারে গান বা বিনোদনমূলক কিছু বাজালে কঠোর শাস্তির বিধান রাখে ওমর সরকার। নামাজের সময় দোকানপাট, গাড়িসহ সব পরিবহণ বন্ধ থাকবে, সবাইকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে হবে। ঘুড়ি ওড়ানো, কবুতর পালন, নদীর তীরে নারীদের কাপড় ধোয়া, পুরুষ দর্জি কর্তৃক নারীদের পোশাক বানানো, অফিস বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে যে কোনো ছবি টাঙানো নিষিদ্ধ ছিল। জুয়া খেলা বা মদ খাওয়া যাবে না। ওমরে নেতৃত্বাধীন সরকার এরকম অপরাধ দমন করতে 'পাপ নির্মূলকরণ মন্ত্রণালয়' নামে একটি মন্ত্রণালয় গঠন করে। তালেবানি প্রথম আমলে আফগান শিশুদের অংক শেখানো হতো, ধরো ওমরের রাইফেলে তিনটি ম্যাগজিন আছে, প্রতিটি ম্যাগজিনে ২০টি করে গুলি রয়েছে, ওমর তার গুলির এক-তৃতীয়াংশ খরচ করে ষাটজন বিধর্মীকে হত্যা করল, তাহলে ওমরের প্রতিটি গুলিতে কতজন বিধর্মী মারা গেল? এরকম ছিল শিক্ষা ব্যস্থাটা। প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠেছিল সন্ত্রাসী হয়ে। বর্তমানে তালেবানিরা ক্ষমতা দখল করার পর সাধারণ আফগানিরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। কাবুল থেকে বিদেশগামী বিমানগুলোতে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ বাদুড় ঝোলা হয়ে দেশ ছেড়েছেন। এভাবে দেশ ত্যাগের ঘটনা আধুনিক বিশ্বে ঘটেনি। এই দৃশ্য থেকে বোঝা যায়, আগের তালেবানি সরকার ব্যবস্থাটা কতটা জঘন্যতম ছিল? আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় বসার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিকেও প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশের মৌলবাদীগোষ্ঠীরা আবার জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর গোয়েন্দাদের তথ্যে গণমাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদগুলো থেকে জানা যায়, এদেশ থেকে কিছু যুবক আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গোপালগঞ্জে হত্যা পরিকল্পনা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বাংলা ভাইয়ের ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা, বাংলা ভাইয়ের বাহিনী গঠন, ৫ মের হেফাজতি তান্ডবসহ বিভিন্ন জঙ্গি হামলার সঙ্গে তালেবানি গোষ্ঠীর যোগসাজশ ছিল, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। এক ফেসবুক ব্যবহারকারী তালেবানি মৌলবাদীরা ভয়ংকর বলে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে, ঈরা সাদিয়া নামে একজন নারী কমেন্ট করেছেন, তার কমেন্টের মর্মার্থটা হলো- ফেয়ার ইলেকশান দিলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। তার এই কমেন্টে বোঝা যায়, দেশের মৌলবাদীরা অনেক সংগঠিত। ঈরা সাদিয়া কী করে বুঝল মৌলবাদীরা শক্তিশালী এবং তৃণমূলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে তা গোয়েন্দা নজরদারিতে দেখা দরকার। তালেবানিরা এখনো দৃঢ়ভাবে ক্ষমতায় বসতে পারল না অথচ বাংলাদেশে কিছু মানুষ বিজয়ের হাসি হাসছেন। এর কারণ কী? তাহলে কি এদেশেও মৌলবাদীরা শ্বেত ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠছে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে মৌলবাদীরা ধর্মীয় বাতাবরণে নিজেদের একটি ভিত্তি গড়ে তুলছে। তাদের কাছে তালেবানরা আফগানে ক্ষমতা দখল করার বিষয়টি একটি বড় ধরনের সুখবর। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর প্রভাবটা সহসাই পড়লে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে এর প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্য দেখা দেবে। দেশের কৃষিক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ নারীশ্রমিক কাজ করছে। দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় পোশাক শিল্প খাত থেকে। পোশাক শিল্পের শতকরা ৮০ ভাগ শ্রমিকই নারী। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের শ্রমিকদের মাঝে দেখা যায় নারীই কাজ করছে। শ্রমিক থেকে শুরু করে দেশের সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় নারীরা শ্রম বিনিয়োগ করছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত ৭০ দশকে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কত ছিল, তার সঙ্গে বর্তমানের নারী শ্রমিকের তুলনা করলে দেখা যাবে, সেই সংখ্যাটি বর্তমানে বেড়েছে কমপক্ষে ১০-১৫ গুণ। আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতির জিডিপির মূল যোগানদার এদেশের নারী শ্রমিকরা। বাংলাদেশের এই অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতিতে পৃথিবীর অনেক দেশ ঈর্ষান্বিত। বাংলাদেশের অর্থনীতির ইতিবাচক ধারাকে নেতিবাচক করার জন্য চলছে নানা ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর সঙ্গে দেশীয় চক্র জড়িত থাকাটা স্বভাবিক। এদের মূল লক্ষ্য হলো, নারীদের শ্রম বিনিয়োগটা বন্ধ করা। তাই নারীদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার লক্ষ্যে দেওয়া হয় নানা ধরনের ফতুয়া। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস বেশ ভাইরাল করে মৌলবাদীরা। স্ট্যাটাসটি ছিল, স্বামী-স্ত্রীর ছবি ফেসবুকে দেওয়া অন্যায়। আবার কেউ কেউ বলছে, নারীদের ছবি ফেসবুকে প্রদর্শনকরাটা পাপ। এর প্রভাবে ফেসবুকে নারীর ছবি দেওয়ার বিষয়টি অনেক কমে গেছে। এমকি নারী আইডিতেও প্রোফাইলে নারী নিজের ছবি দেয় না। রাস্তা-ঘাটে বোরকা বা হিজাববিহীন নারীরা চলাফেরা করাটা নিয়ে বিভিন্ন আড্ডায় শোনা যায়, শ্লেষ এবং নানা ধরনের ব্যঙ্গাত্মক কথাবার্তা। বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতিকে মাধ্যম করে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক সুনিপুণভাবে ঢুকানো হচ্ছে মৌলবাদ। আর এ ধরনের বিস্তার ব্যবস্থা বহাল থাকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে একটি বড় জনভিত্তি গড়ার সুযোগ পেয়ে যাবে মৌলবাদীরা। আফগানিস্তানে তালেবানরা যে ঘটনাটি ঘটিয়ে ক্ষমতায় বসেছে, সেরকম ঘটনা যে বাংলাদেশেও ঘটবে না, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মৌলবাদীরা সংগঠিত হচ্ছে তালেবানি কায়দায় তৃলমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় স্তরে। এরা পুরোপুরি সংগঠিত হলে বড় ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে দেবে আর তৃণমূলের সাধারণ মানুষের একটা সমর্থনও তারা পাবে সুতরাং এখনই সতর্ক না হলে মৌলবাদী আগ্রাসনের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করাটা কঠিন হয়ে পড়বে। আর কোনো কারণে মৌলবাদীরা সংঘাত ঘটিয়ে ফেলে তাতে শুধু রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটবে না, দেশের অর্থনীতি পর্যুদস্ত হয়ে যাবে। বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মৌলবাদী সংঘাতগুলোর সঙ্গে আফগান তালেবানীয়দের একটি যোগাযোগ রয়েছে। তাছাড়া অনেক সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের নিখোঁজ হওয়া বহু তরুণ তালেবানিদের পক্ষ নিয়ে চলে গেছে আফগানিস্তানের যুদ্ধে। আফগানিস্তানে তালেবানীয়দের সরকার পাকাপোক্ত হয়ে গেলে, আফগান যুদ্ধে যোগ দেওয়া বাংলাদেশীয়রা স্বদেশে ফেরত আসবে, আর তখন দেশের অভ্যন্তরে এরাও তালেবানি কায়দায় সংগঠিত হবে। তখন আফগানিস্তানের কায়দায় সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটা চালাতে পারে এমন ভাবনাটাও কিন্তু অমূলক নয়। সুতরাং সব বিষয়গুলো এখন ভাবার দরকার। তা না হলে দেশের অভ্যন্তরে মৌলবাদীরা বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক