তেলফসল উৎপাদনে কৃষি বিভাগের গুরুত্ব

প্রকাশ | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:২৬

কৃষিবিদ কামরুল হাসান কামু

 

প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে জনগোষ্ঠীতে। অপরদিকে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর বাসস্থান, কৃষি জমিতে শিল্পায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, উর্বরা কৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপন, রাস্তাঘাট তৈরীসহ নানা কারণে প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি জমির পরিমাণ যা রীতিমত চিন্তার বিষয়। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা, উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার। সামগ্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে দেশের কৃষি বিভাগ ও কৃষি বিজ্ঞানীগণ।

ইতোমধ্যে আমরা দানাজাতীয় খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। অনেক ফসল উৎপাদনে আন্তর্জাতিক স্থান লাভ করেছি তবে তেলজাতীয় ফসলের ক্ষেত্রে সে সক্ষমতা এখনো হয়নি। চাহিদার প্রেক্ষিতে ভোজ্যতেলের ৯০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় যার অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ভোজ্যতেল আমদানি বাবদ বিপুল অংক প্রতিবছর বিদেশে চলে যাচ্ছে ফলে ক্রমেই ভোজ্যতেল রাজনৈতিক পণ্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বাংলাদেশীদের কাছে তেল এমন-ই এক নৈমিত্তিক পণ্য যা ছাড়া সংসারে রান্না চলেনা। পুষ্টিমানের দিক থেকে তেল বা চর্বি থেকে সবচেয়ে বেশি ক্যালরি পাওয়া যায়। পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে প্রতি গ্রাম তেল থেকে ৯ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে মানবদেহে দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তির ৩০ শতাংশ তেল বা চর্বি জাতীয় খাদ্য থেকে আসা উচিত অথচ আমাদের আসে মাত্র ৯ শতাংশ যা ভাবনার বিষয়। এই মুহূর্তে দেশে মাথাপিছু তেলের চাহিদা প্রায় ৩৫ গ্রাম তবে সে পরিমাণ তেল আমরা গ্রহণ করতে পারিনা। মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে বিদেশী পণ্য খুব সহজেই দেশীয় বাজারে সয়লাব হবে এটা ধ্রুব সত্য। বিবিএস ২০১৯ এর তথ্যমতে আমদানীকৃত ভোজ্য তেলের মধ্যে পামওয়েল ৫৮ শতাংশ, সয়াবিন ৩৭ শতাংশ, (র‌্যাপসিড+ক্যানোলা) ৫ শতাংশ। সুতরাং উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের ভোজ্যতেল উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে।

ইতোমধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তেলফসলে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করতে প্রকল্প গ্রহণ করেছে যা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তেলফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো প্রচলিত শস্যবিন্যাসে তেলফসলকে অন্তর্ভুক্ত করা। এ মুহূর্তে দেশে প্রায় ২০ লক্ষ হেক্টর জমি বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্যবিন্যাসের আওতায় আছে যেটিকে সরিষা-বোরো-রোপা আমন শস্যবিন্যাসে রুপান্তর করতে পারলে সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। ফলে দুই ফসলি জমি গুলো তিন ফসলে রুপান্তরিত হবে এবং শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধি পাবে। এ শস্য বিন্যাসটির জন্য প্রয়োজন স্বল্পমেয়াদী রোপা আমন (জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন) এবং স্বল্প জীবনকালের সরিষার জাত (জীবন কাল ৭৫-৮০ দিন)। দেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে স্বল্পমেয়াদী জাত অবমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যান্য তেল ফসলের ক্ষেত্রে বিশেষ করে তিল, চিনাবাদাম, সয়াবীন এবং সূর্যমূখীর উচ্চফলনশীল জাত চাষাবাদের মাধ্যমে তেলফসলে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। নদীমাতৃক বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য চর যেখানে তেলফসল খুব সহজে করা যায়, রয়েছে বিস্তীর্ণ হাওর যা হবে তেলফসলের অপার ভূমি।

তেলফসল চাষাবাদের সাথে মৌচাষ বিষয়টি নিবিড়ভাবে জড়িত। তেলফসলের মাঠে মৌচাষ করলে মধু বিক্রির মাধ্যমে অনেক কৃষক বাড়তি আয় করতে পারবে ফলে তৈরী হবে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। তাছাড়া ফুলের পরাগায়নে মৌমাছি সহযোগিতা করার ফলে ফসলের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। কৃষক ভাই-বোনেরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করলে নিঃসন্দেহে লাভবান হবে। আমরা একটু পিছনে তাকালেই দেখতে পাবো আমাদের ইতিহাস। আশি-নব্বই দশকে এদেশের মানুষ ঘানিতে ভাঙানো সরিষার তেল খেতো যা একদম নির্ভেজাল ছিলো। দেশের সক্ষমতা বাড়ালে আমদানি করে বিদেশ থেকে ভোজ্যতেল নিয়ে আসার প্রয়োজন তেমন হবেনা। আমাদের এখনই বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করে কাজ করতে হবে।

তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ও দায়-দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্ব রয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। আমাদের দেশের কৃষক চায় ন্যায্যমূল্য। দেশীয় তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি আমলে নিলে কৃষক লাভবান হবে। প্রয়োজনে কনট্রাক্ট ফার্মিং বিষয়টি আমলে নেওয়া যেতে পারে। তবে সর্বোপরি নিজেদের প্রাত্যহিক রান্নার জন্য হলেও তেল ফসল চাষাবাদ করতে হবে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত তেলের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবেনা। শুধু সরষে ইলিশের সময় নয় সারাবছর এদেশের মানুষ দেশে উৎপাদিত তেল গ্রহণ করে পুষ্টি লাভ করুক এটাই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি আমাদের দেশ হবে স্বনির্ভর কৃষির।

 

লেখক : কামরুল হাসান কামু

কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা

ফুলপুর, ময়মনসিংহ

ইমেইল- [email protected]

 

যাযাদি/ এস