মুক্তিযুদ্ধের একটি দুর্লভ ছবি : কেমন আছেন ছবির মানুষগুলো

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:৫৫

দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল) উপজেলা প্রতিনিধি

 

 

মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে খালেক, মজিদ ও মজিবর এই তিনজনের সমন্বয়ে তোলা ছবিটি অন্যতম। ছবির তিনজনই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ’৭১’র যুদ্ধে এই তিন কিশোর যোদ্ধা দেখিয়েছিল অসীম সাহসিকতা। যার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে দুর্লভ এই ছবিতে। ওরা বীর ছিল, আছে। জন্ম-জন্মান্তর ওরা জাতির কাছে চিরবীর হয়ে বেঁচে থাকবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অধিকাংশ প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ব্যানারসহ পাঠ্য বইয়ের গল্পের প্রচ্ছদেও ছবিটি ব্যবহার হয়ে আসছে। ‘যে ছবি আজ বাংলার ঘরে ঘরে, তাদের খোজ আজ কে রাখে ? এটাকি শুধুই ছবি? ইা কি ’৭১’র মুক্তিযুদ্ধে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের বীরত্বের প্রতিচ্ছবি। সুপরিচিত এই ছবিটি এখনও বাংলার ঘরে ঘরে থাকলেও এই তিন বীরের পরিচয় ও দুঃসাহসিকতার ব্যতিক্রমী কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। এদের একজনকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে রিকশা চালাতে হয়েছে। আরেকজনকে কখনও কারখানার শ্রমিক কখনওবা নৌকার মাঝি হয়ে উপার্জন করতে হয়েছে। স্বাধীনতায় অগ্রণী ভূমিকায় নেই এদের বাড়তি কোনো সম্মাননা। তিনজনের মধ্যে দুজনেই দীর্ঘ সময়ে পায়নি সম্মানজনক কোনো উপার্জনের উৎস। ছবির দুরন্ত তিন যোদ্ধার পরিচয়, মুক্তিযুদ্ধে অবদান আর তাদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে কথা হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের কথা তুলে ধরেন।

 

ছবিতে থাকা তিনজনই টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন ইউনিয়নের মুশুরিয়া গ্রামের কিশোর। ওপরে গ্রেনেড ছুড়ছেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক। মাঝে রাইফেল হাতে আব্দুল মজিদ। বামে রয়েছেন মজিবর রহমান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানকে স্মরণীয় রাখতে আলোচিত ফ্রেমে আটকে পড়েন এই তিন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর গোধূলিলগ্নে ময়মনসিংহের সম্ভুগঞ্জে পাকসেনাদের একটি শক্ত ঘাঁটির বাংকার ধ্বংসের চিত্রটি ফ্রেমে আটকে রাখেন মানিকগঞ্জের নাইম উদ্দিন নামের এক ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধে এই তিন বীরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লেও ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি একটি দৈনিকে ছবিটি প্রকাশের পর স্বজনরা জানতে পারে ওরা তখনও বেঁচে আছেন।

 

কথায় কথায় বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান ও সাহসিকতার পরিচয়। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক। তিনি মুশুরিয়া গ্রামের মৃত-হযরত আলী ও রূপজানের ছেলে। মজিবর রহমান ওই গ্রামের মৃত মনসের আলী ও মৃত সখিনা বেগমের সন্তান। আব্দুল মজিদও একই গ্রামের মৃত সলিম উদ্দিন ও সোনাবানুর সন্তান। এদের মধ্যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক ছিল সর্বালোচিত। কথা হয় তার সঙ্গে।

 

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ওরা প্রেরণা পায় :

খালেক, মজিদ ও মজিবর ওরা প্রায় সমবয়সি। তখন প্রায় ১২/১৩ বছরের কিশোর। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ওরা প্রেরণা পায়। ওরা ভাবেন যুদ্ধ সুনিশ্চিত। ২৫ মার্চের কালরাত ওরা বুঝতে পারে যুদ্ধ সন্নিকটে। ২৬ মার্চ থেকে সংকল্প নেন দেশকে বাঁচাতে সংঘবদ্ধ হতে হবে। প্রথমে মনে করেন সেনাবাহিনীই পারবে দেশকে মুক্ত করতে। অনিশ্চয়তা দেখে সমবয়সিদের সংঘবদ্ধ করতে থাকে ওরা। মে’র শেষের দিকে ওরা ২১ জন বন্ধু মিলে নৌকাযোগে ইন্ডিয়ার মাইনকার চরে চলে যান। তিন দিন পর তাদের মেডিকেল হয়। তুরা ক্যাম্পে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সেখানে আলফা কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণে ২১ দিন ফ্রন্টফাইটার অতঃপর ৭ দিন গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় ৭শ’ প্রশিক্ষিত যোদ্ধা দেশে ফেরেন। ওদের কৌশল ছিল, সুযোগ বুঝে শত্রæসেনাদের ওপর আকস্মিক হামলা, পরক্ষণেই ইন্ডিয়াতে আত্মগোপন করা। কিছুদিন পর সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। ৭১’র ৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী (ইন্ডিয়ান আর্মি ৬ বিহার) রেজিমেন্টের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামেন। তবে তাদের বন্ধু তোফায়েল (তুলা মিয়া) মেডিকেল আনফিট হয়ে দেশে ফিরে পরোক্ষভাকে যুদ্ধে অংশ নেন। শুধু পাক সেনাদের ওপর গুলিবর্ষণ করেননি ওরা, সাহসিকতার সঙ্গে ধ্বংস করেন শত্রæসেনাদের কয়েকটি ঘাঁটি। তারই একটি প্রতিচ্ছবি আলোচিত এই ছবিটি।

 

ব্যতিক্রমী সম্মাননার দাবি জানান 

সাদা মনের মানুষ আব্দুল খালেক। দেশপ্রেম হৃদয়জুড়ে, কথায়ই বেরিয়ে এলো। অসচ্ছলতার পরিচয় ভাঙা বাড়িটিই সাক্ষী দিল। মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিতে তার আত্মসম্মানে বাধল। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা লম্বা দেখে কেঁদে বললেন, তখন যদি সত্যি এত মুক্তিযোদ্ধা থাকত তাহলে দেশ শত্রæমুক্ত হতে ইন্ডিয়া-রাশিয়ার সাহায্যের প্রয়োজন হতো না। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে দেশ যেমন স্বাধীন হতো না তেমনি টাঙ্গাইল না থাকলে এত মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যেত না। অথচ দুর্লভ ছবির সেই তিন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এখনও কোনো উপাধিতে ভূষিত করা হয়নি। রাস্তায় টাঙানো তার নিজের ছবি দেখাতে গিয়ে অনেক সময় গলাধাক্কা খেতে হয়। সাদাসিধে পোশাকে তিনিই যে ছবির মানুষটি তা অন্যকে বোঝাতে বেগ পেতে হয়। সম্প্রতি ঢাকার খিলক্ষেত ক্যান্টনমেন্টের সামনে এই ছবির ব্যয়বহুল ভাস্কর্য তৈরি হচ্ছে। অথচ নিজের উপজেলার মানুষকে ছবি দেখিয়ে নিজের পরিচয় দিতে হয়। নেই কোনো প্রতীকী ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রায় আড়াইশ’ কবিতা লিখেছেন আব্দুল খালেক। অর্থের অভাবে প্রকাশ করা আর হয়ে ওঠেনি। তিনি গোগ্রীন অটবির গুলশান শাখার অ্যাম্বাসেডর পদে চাকরি করতেন। অটবির ব্যবসায়িক অবস্থা মন্দা থাকায় বেতন বকেয়া পড়ে। ফলে চাকরি ছেড়ে অবসরে চলে যান চট্টগ্রামের ফয়েজলীগে। মাতৃভূমির টানে ফের মুশুরিয়ার পিতৃ ভিটে বাড়িতে থাকছেন। খালেকের ঘরে রয়েছে চার ছেলে মেয়ে। ছেলেরা পৃথক হওয়াতে সরকারি ভাতাটাই এখন তার একমাত্র উপার্জন। মুক্তিযুদ্ধে অবদান ও কর্মকাÐের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন সম্মাননা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।

 

এদিকে, মজিবর রহমান ২০১৪ সালে মারা যান। মজিবর রহমানের স্ত্রী সাহাতন বেগম জানান, ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মজিবর রহমান রেখে গেছেন চার ছেলে। আলোচিত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জীবিকার খোঁজে রিকশা চালাতে হয়েছে মজিবর রহমানকে।

 

অপরজন আব্দুল মজিদ। তিনি ব্যাটালিয়ন আনসার-এ প্লাটুন কমান্ডার পদ থেকে অবসরে আছেন। বাড়ির পুকুরে মাছ চাষ করে সময় কাটাচ্ছেন তিনি। খালেকের মতো একই ধরনের কথা বললেন তিনিও। তার তিন মেয়ে। মজিদ পরে চাকরি করলেও ওই সময়ে অর্থের অভাবে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করতে পারেননি তিনি।

 

এটা কি শুধুই ছবি? প্রশ্ন এলাকাবাসীসহ সুশীল সমাজের। যদি ছবির আড়ালে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ বীরত্ব প্রকাশ পেয়ে থাকে তাহলে এদের বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করার দাবি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের। স্থানীয়দের প্রত্যাশা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিশেষ ছবির একটি ভাস্কর্য নির্মাণ হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিশেষ জায়গায় নাম লেখাতে পারবে দেলদুয়ার উপজেলা। এই তিন বীর, তাদের স্বজনসহ স্থানীয় সুশীল সমাজ সরকারের কাছে জোর দাবি জানান, আলোচিত ছবির এই তিন যোদ্ধাকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকারিভাবে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করে তাদের যথাযথ সম্মান দেবে।

 

দেলদুয়ার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার আবু তাহের বাবলু বলেন, আলোচিত এই ছবির তিনজনকে তিনি চেনেন। তারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই দুর্লভ ছবিটিও তাদের। তিনিও ভাস্কর্যটি নির্মাণের জন্য সরকারে কাছে দাবি জানান।

 

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোবারক হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের জন্য একটি ঘর বরাদ্দ হয়েছে। খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী নিয়মিত পাচ্ছেন।

দেলদুয়ার উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহাদত হোসেন কবির বলেছিলেন, এই তিন কিশোর যোদ্ধাকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি ভাস্কর্য নির্মাণের চেষ্টা চলছে। জেলা পরিষদের সহযোগিতা পেলে একটি ভাস্কর্য তৈরি করা সম্ভব হবে। তিনি বদলি হওয়ার পর ভাস্কর্যটি  আর হয়ে ওঠেনি।

 

নিজ অর্থায়নে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরি

আব্দুল খালেক তার বাড়িতে নিজ অর্থায়নে একটি জাদুঘর তৈরি করেছেন। যেখানে সযতেœ রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় নিদর্শন। টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নিদর্শন সংগ্রহ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রেখেছেন তার গ্রামের ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধার ছবি। আব্দুল খালেক বলেন, পরবর্তী প্রজন্মকে যুদ্ধের ইতিহাস জানাতে তার এই উদ্যোগ। তার জন্য একটি ঘর বরাদ্দ দিয়েছে সমাজসেবা বিভাগ। অথচ তিনি ঘরের পরিবর্তে তার মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক জাদুঘরটিকে সংস্কার করাসহ আঞ্চলিক জাদুঘরে রূপান্তর করার দাবি জানান।

 

যাযাদি/ এস