বদরুদ্দীন উমর একজন সৎ রাজনীতিক এবং এ দেশের একজন নিষ্ঠাবান বিশিষ্ট লেখক। তিনি রাখঢাক করে কথা বলেন না। ব্যক্তিভজা কর্তাতুষ্টি মানসিকতা তার ভেতর কখনোই দৃশ্যমান নয়। ঔচিত্যবোধ তার মধ্যে তীব্র ও তীক্ষ্ন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বা পরবর্তী কোনো সরকার ও সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করতে তাকে দেখা যায়নি। সততা, নিষ্ঠা, আপসহীনতা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা এসব শব্দই বদরুদ্দীন উমরের পরিচয়ে নির্দ্বিধায় যোগ করা যায়। এমন প্রচারবিমুখ নির্মোহ ব্যক্তি বর্তমান সমাজে বিরল। ২০ ডিসেম্বর, ৯০ বছর পূর্ণ করে ৯১-এ পা রেখেছেন তিনি। প্রবীণ লেখকদের মধ্যে সন্জীদা খাতুন, আহমদ রফিক, রণেশ মৈত্র, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবু বকর সিদ্দিক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রেহমান সোবহান, হাসনাত আবদুল হাই, আবদুল মতিন খান, আকবর আলি খান, বেগম জাহান আরা, আনোয়ারা সৈয়দ হক আমাদের মাঝে আছেন। ৬৫ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে বেঁচে আছেন অনেক লেখক। দেশের গড় আয়ু তেয়াত্তর হলেও অনেকেই অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে উমর ভাই আয়ুষ্কালের দিক থেকে সৌভাগ্যবান। তিনি পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ সৌন্দর্য এখনো উপভোগ করছেন। একই সঙ্গে চারপাশের কদর্য দৃশ্যও তাকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে প্রবল অনিচ্ছায়। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ তাকে যথার্থ মূল্যায়ন করেননি, তার কাজ ও অবদানের নিরিখে। কেন মূল্যায়ন করেননি সে এক রহস্যাবৃত প্রশ্ন। এ দেশে কত অযোগ্য লোকদের মূল্যায়ন হচ্ছে। অথচ তার মতো পন্ডিত ব্যক্তি সমাজে উপেক্ষিত। আর এ কথা তার জবানীতে শুনতে হলো আমাদের। এটা আমাদের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের ও অস্বস্তির। কলকাতায় তার বই ও লেখার ওপরে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক কৃতবিদ্য মানুষ তার ওপরে লিখেছেন। সেটা বাংলাদেশে চিন্তাও করা যায় না। কাজী আবদুল ওদুদ, মৈত্রেয়ী দেবী, নারায়ণ চৌধুরী, অন্নদাশঙ্কর রায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বিনয় ঘোষ, অশোক মিত্র। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে উঁচু স্তরের মানুষ। দলনির্বিশেষে তারা তার ওপরে লিখেছেন। কিন্তু এখানে দলনির্বিশেষ উপেক্ষা করা হয়েছে। \হবদরুদ্দীন উমরের জন্ম ভারতের বর্ধমান জেলায় ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর। উমর ভাই শৈশবে আবৃত্তি করতেন, নাটকে অভিনয় করতেন। সে সময় বর্ধমান কমিউনিস্ট পার্টি ছিল সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠান। কখনো ছাত্ররাজনীতি না করলেও উমর ভাই পার্টির কিছু ক্লাসে যোগ দিয়েছেন। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার এবং বিনয় চৌধুরী। দুজনই ভূমি সংস্কার ও বর্গাচাষির অধিকার আদায়ের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে উমর ভাই সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। পরে এই আন্দোলনের গবেষণায় তিনি পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত। তিনি ১৯৪৮ সালে বর্ধমান টাউন স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৫০ সালে বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে ১৯৫৩ সালে স্নাতক ও ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকার সময় ১৯৬৪ সালে 'সাম্প্রদায়িকতা' প্রবন্ধ দিয়ে বদরুদ্দীন উমর প্রথম আলোচনায় আসেন। তিনি প্রথম জীবনে শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত ছিলেন- যা তাকে বিত্তবান করতে ও সমাজের পাদপ্রদীপের আলোকে নিয়ে আসতে পারত। তিনি পাকিস্তান সরকারের ও সরকার সমর্থকদের চক্ষুশূল হয়েছেন। তিনি স্বেচ্ছায় ওই পেশা ছেড়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। এ দেশে আদর্শিক রাজনীতির ঝান্ডা বেশি দূর এগোয় না, উজ্জ্বল ও প্রতিষ্ঠিত হয় না। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভকারী উমর ভাই ইচ্ছে করলে অনেক দূর যেতে পারতেন, আদর্শচু্যত হলে। তিনি তা হননি, হওয়া তার পক্ষে সম্ভবও নয়। তিনি বেছে নিয়েছেন প্রথাগত রাজনীতি নয়, কমিউনিস্টদের ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর রাজনীতি। কমিউনিস্ট সংগঠনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি এখনো কমিউনিস্ট হিসেবেই রাজনীতি করছেন। অনেক তথাকথিত কমিউনিস্টের মতো ভোল পালটে সাবেক কমিউনিস্ট নেতা বা শাসক দলের সহযোগী হিসেবে পরিচিত হননি। এখানেই একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান আদর্শবান রাজনীতিক হিসেবে তার বিশিষ্টতা। তিনি রাজনীতিতে ঢুকে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী- লেনিনবাদী) সদস্য পদ নিলেও ১৯৭১ সালে পার্টির গৃহীত রাজনৈতিক লাইনের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন। স্বাধীনতার পর তার কয়েকজন সহযোগী নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তা ছাড়া কৃষক ফেডারেশন, বাংলাদেশ লেখক শিবির, গণতান্ত্রিক বিপস্নবী জোট, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল এবং ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় কমিটি গঠন তার সাংগঠনিক কাজের উলেস্নখযোগ্য দিক। তরুণ বয়সে তিনি সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) শিরোনামে তিনটি বই লিখেছিলেন- যা পাকিস্তানি যুগের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যবান রাজনৈতিক গ্রন্থ হিসেবে আলোড়ন তুলেছিল। তিনি 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক' বাংলার কৃষক, কৃষি অর্থনীতি এবং মধ্যশ্রেণির ওপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে সমাদৃত। এ পর্যন্ত তার আজ ১২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তার অনেক বই পশ্চিমবঙ্গ থেকেও প্রকাশিত হয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের অনেক খ্যাতিমান লেখক তার ওপর মূল্যায়নধর্মী লেখা লিখেছেন। সে তুলনায় বাংলাদেশে তার মূল্যায়ন হয়নি বললেই চলে। তার সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য কাজ হচ্ছে ৩ খন্ডের পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি। পরবর্তীকালে আরও অনেক লেখক-গবেষক ভাষা আন্দোলন নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন, কিন্তু তার কাজকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি। একমাত্র এই একটি বই-ই তাকে বাংলাসাহিত্যে অমর করে রাখার জন্য যথেষ্ট। তার পিতা আবুল হাশিম অবিভক্ত বাংলা মুসলিম লীগের অত্যন্ত সফল সাধারণ সম্পাদক। তাদের পরিবারে একদিকে কংগ্রেস-মুসলিম লীগের যেমন, তেমনি কমিউনিস্ট কর্মীদের নিয়মিত আনাগোনা ছিল। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে'-তে কলকাতায় মুসলিম লীগের জনসভায়ও দুই পুত্রকে নিয়ে যান আবুল হাশিম। তাদের পরিবারে সবসময় একটি উদারনৈতিক ধারা ছিল। দেশভাগের পর এক দাঙ্গায় তার বর্ধমানের বাড়িতে আগুন দিলে ক্ষুব্ধ, ব্যথিত আবুল হাশিম পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে, সামরিক শাসন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, সব ধরনের জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে, সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতার বিরোধিতায় সারা জীবন মিটিং-মিছিলে তিনি যেমন মাঠে সক্রিয় থেকেছেন, তেমনি সক্রিয় থেকে তার কলম, অব্যাহত রেখেছেন, পঠন-পাঠন, নিবিড় জ্ঞানচর্চায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে 'রাজা রামমোহন রায় স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধের ওপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ তাকে অনুরোধ করেন; আবার ভারতের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি আয়োজিত নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তার ডাক পড়ে। তিনি এ দেশে বিদ্যাসাগর চর্চার একজন পথিকৃৎ। 'ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ' গ্রন্থে তিনি মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উনিশ শতকের বাংলার জাগরণ এবং কলকাতার হিন্দু মধ্যবিত্তের গড়ে ওঠা ও বিকাশের বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন এবং এর সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি মনে করেন, সাম্প্রদায়িকতা একটা রাজনৈতিক ব্যাপার। ধর্মকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়া হয়। তিনি আরো মনে করেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিজমের ভবিষ্যৎ নেই- তারা সামনে এক হাতের বেশি দেখতে পায় না। তাদের ধারণা, সমাজতন্ত্র শেষ। কিন্তু ইতিহাস তো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। তাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? তিনি বলেন, এই প্রশ্নের আগে আরেকটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ কী? পুঁজিবাদের যদি কোনো ভবিষ্যৎ না থাকে, তবে সমাজতন্ত্র ছাড়া মানব জাতির আর কী বিকল্প আছে? জীবনের পড়ন্ত বেলায় তার আক্ষেপ একটাই, এ দেশের মানুষের মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন তিনি দেখে যেতে পারলেন না। এই সমাজের মৌলিক কোনো পরিবর্তন দেখে যেতে পারলেন না। যদিও তার জন্য তিনি নিরন্তর চেষ্টা ও সংগ্রাম করেছেন। তিনি প্রত্যাশা করেন, মানবজাতি বেঁচে থাকলে পরিবর্তন হবেই; যদি পুঁজিবাদী বিশ্ব গোটা বিশ্বকে ধ্বংস করে না দেয়। তারা কেবল শ্রমিককে ধ্বংস করছে না। মানুষ ও পরিবেশকেও ধ্বংস করছে। লেখনির মাধ্যমে মেহনতি মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তিনি। মার্কসবাদের অনুসারী হয়ে তিনি যেমন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, তেমনি সংগঠন গঠনেও কাজ করেছেন। তিনি স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত যারা লুণ্ঠন করে এদেশে সম্পদশালী হয়েছেন, তিনি তাদের বিষয়ে লিখে যাচ্ছেন। ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের জন্যে কর্মসূচিভিত্তিক ঐক্যের প্রয়োজন। তিনি এ ধরনের ঐক্যেরই ডাক দিয়েছেন সবসময়। তিনি এও মনে করেন, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ছাড়া মানুষের হাতে এতো সম্পদ চলে এলো। এটা বিপজ্জনক। তার জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ ও মানুষের মুক্তির রাজনীতির মধ্যে কোনো প্রাচীর নেই, একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। জয়তু উমর ভাই। আপনার স্বপ্ন সফল হোক। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক কলাম লেখক ও সাংবাদিক