মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অবক্ষয় রোধে সন্তানের দিকে নজর দিন

ফারজানা চৌধুরী
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৩৩
ছবিটি এঁকেছেন রীম চৌধুরী

এ লেখাটি লিখছি আমার একমাত্র মেয়ের আঁকা অ্যাক্রেলিক পেইন্টটি নিয়ে। আর্টটিতে যে দক্ষ শিল্পীর তুলির stroke আছে এটা বুঝতে কোনো পেশাদার শিল্পীরই অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আজ আমি বা আমার মেয়ের এই পেইন্টিংটির শ্রম্নতিবাক্য শোনার জন্য আর্টটি শেয়ার করছি না। শেয়ার করছি ছবিটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা অবক্ষয়, যা সমাজে বিষবাষ্পের দূষণ ছড়িয়ে কিভাবে সমাজ, সামাজিক বন্ধন সবকিছুকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করেছে। কিশোর অপরাধ, কিশোরগ্যাং, যুবসমাজের অবক্ষয়, পারিবারিক ঘৃণা অবক্ষয়, খুনখারাপি, পিতা-মাতা, আপন ভাইবোনকে অনুশোচনাহীন হত্যাযজ্ঞ এসব শুনতে শুনতে আর এর শিকার হওয়া মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে মনে হয় আমরা সবাই প্রায় গা'সওয়া হয়ে গিয়েছি। কিন্তু তা কি করে হয়? সর্বোপরি আমি একজন 'মা'- আমি সন্তানকুলের অবক্ষয় নিজ চোখে দেখে কী করে সহ্য করি, সে যে নরকের আজাব। মাতৃত্বের 'অবমাননা' বলতে যদি কিছু বোঝায় এটি কি তাই নয়? কিন্তু ছবির সঙ্গে এর কি সম্পর্ক? ছবিতে সুন্দর শিল্পকর্মের দেওয়ালে একটি বীভৎস কঙ্কালের মাথার অবয়ব, যাতে সে কঙ্কাল মাথাটি বিষের বাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে- যা অতি ভয়ংকর! এখানেই লুকিয়ে আছে লেখনীর টুইস্ট। সবাই আমরা সোচ্চার কিশোরগ্যাং নিয়ে। সমাজের সমগ্র অনৈতিক, ভয়াবহ হিংস্র কাজের নাটের গুরু এই যুবসমাজ এবং সঙ্গে খুনি পিতা-মাতার সংখ্যাও নেহাত কম নয়- পরকীয়ার জেরে। কিন্তু কেন- এ সময় তো এদের হাতে কলম থাকার কথা। তবে কারা এদের এই পথে ঠেলে দিয়েছে? আমার খুব একটি রূঢ় উত্তর 'জন্মদাত্রী মা ও ঔরসজাত পিতা' এদের এই বিপথগামী হতে প্রথম হাতেখড়ি দিয়েছে। তাই এই শিল্পকর্মে এই কঙ্কালের মাথাটি সব মাতা-পিতার প্রতীক। যারা সমাজে এই কিশোরগ্যাং বা অনৈতিক সন্তান-সন্ততির জন্ম দিয়ে বিষবাষ্প ছড়িয়ে চলেছেন। কথাটি খুবই দুঃখজনক এবং সব পিতামাতার জন্য অতি লজ্জাজনক; কিন্তু এটিই বাস্তবতা। পেইন্টটি কি তবে সত্যিই একটি বীভৎস মাতৃজঠরের কান্না, আপন সন্তানের সামনে লাজ ও লজ্জাহীন বিকৃত লালসার, উগ্র বাসনার ভর্ৎসনা মাত্র। মা-বাবার unconditional love, নিঃশর্ত ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ,অবক্ষয় রোধে সন্তানের দিকে নজর দিন

একে-অপরকে সম্মান প্রদর্শন, দুঃখ-কষ্টে সন্তানকে আগলে রাখা এসব প্রথাগত। জাগতিক স্বভাবসুলভ আচরণবিধি লঙ্ঘন আজ এসব বিপথগামী কিশোর-কিশোরী যুবকদের সৃষ্টি। সন্তানের প্রতি বাবার অবহেলার সুযোগে কিছু চিল জাতীয় অশুভ আত্মা সেইসব অসহায় সন্তানকে ছোঁ মেরে তাদের কবজা করে ওদের দিয়ে নানা অপকর্ম করিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, অথচ নিজেরা পরিশুদ্ধ ও অরক্ষিত। কিন্তু এই অসহায় যুবসমাজ ভালোবাসা, নির্ভরতা এসবের অভাবে আজ চিরজীবনের জন্য অপঘাতে মৃত্যুর দুয়ারে একটি জ্বালাময় জীবনের মধ্য দিয়ে সবাইকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিজেরাও আত্মাহুতি দিয়ে চলেছে। কারণ এরা দুর্ভাগা জন্ম থেকে বাবা অথবা মাকে কান্ডারি হিসেবে পায়নি, পায়নি ভালোবাসার সামান্য উষ্ণ-আদর। তাই তারা আজ বিকৃত মানসিকতার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বাবা-মা ওদের পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে বটে তবে কর্তব্য না করে ওদের পথে ঠেলে দিয়েছে- ওরা আজ পথহারা। ওদের কোনো ছায়া নেই, কোনো (গাইড নেই) পথপ্রদর্শক নেই, কোনো শাসন নেই, শিক্ষক নেই, সমাজপতি নেই, কেউ নেই। আছে শুধু খোলা আকাশের নিচে কিছু ‘হায়েনার’ দল। যারা অসহায় ছেলেমেয়েকে ছিঁড়ে-কুড়ে নষ্ট করে, আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলছে। এর বেশি খারাপ পরিণতি আর ওদের কি-ই বা হতে পারে। ক্ষুধার জ্বালা, লোভের উদ্রেক করা মেটিরিয়ালিস্টিক পণ্যদ্রব্য, আর নেশায় বুঁদ হওয়া এইতো এদের পরম চাওয়া, আত্মধ্বংসের মরণযজ্ঞ যাকে বলে। এদের বাঁচানোর ক্ষমতা শুধু বাবা-মারই ছিল কিন্তু বিধিবাম! বাবা-মা সব সন্তানের জন্য একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয়, সে আশ্রয় যার নেই সে তো অবশ্যই পথহারা, দুর্ভাগা, এমন দুর্ভাগা যে কাউকে অভিযোগ করার নেই।

তেমনি এ ঘটনাগুলো আবার প্রমাণ করে কিভাবে একজন মা সন্তানের ভাগ্য পাল্টাতে পারেন।

হাজারও কুর্নিশ/সালাম জানাই এসব হাজারও মায়ের যারা নিজের জীবন/সম্ভ্রম উৎসর্গ করে সন্তানের মঙ্গল কামনায় সদাপ্রস্তুত। উনারাই মায়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ যাকে বলে সন্তানের সঙ্গে নাড়ির টান। তাই মায়ের মর্যাদার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। সে কারণেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মায়ের পায়ের নিচেই সন্তানের বেহেশতের বিধান দিয়েছেন।

একজন সুসন্তান যেমন মায়ের কোলে মাথা রেখে সব আদর্শ শেখে, তেমনি মাঠে কাস্তে হাতে শ্রমিক বাবার পাশে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে কিংবা রিকশা বা ঠেলাগাড়ি চালাতে চালাতেও বাবার কাছে শেখে জীবনে স্বপ্নপূরণের গল্প। যা সন্তানের মনের অজান্তেই পৃথিবীতে কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে জীবনে বড় হওয়ার স্বাদ বা রাস্তাটা বাতলে দেয়। আর যে মা শক্ত মাটিতে বিছানা পেতেও সন্তানকে আদর্শের বুলি শেখায় যেমন- বাবা অন্যের জিনিসে লোভ করবে না, অন্যের কিছু না বলে ধরার চেষ্টা করবে না, পথে যেতে যেতে কোনো বড়লোকের গাড়িতে না বলে হাত/আঁচড় দেবে না। সেটা করা অন্যায় তাতে ক্ষমতাবান লোকটি তোমায় যে কোনো কঠিন শাস্তিই দিতে পারে, তোমার সামান্য ভুলের জন্য। কারণ ব্যাপারটি হয়তো তোমার কাছে সামান্য কিন্তু তার কাছে অসামান্য- এর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ পরিমাপ করার ক্ষমতা তোমার নেই। অন্যের পুকুরে মাছ ধরতে যেও না- কারণ পুকুরটি অনেক বড় হতে পারে, মাছ অগণিত থাকতে পারে, কিন্তু পুকুরের মালিকের মনটি হয়তো তেমন বিশাল নাও হতে পারে যার কারণে কয়েকটি মাছ না বলে ধরার জন্য তোমার অনেক দামি প্রাণটাই অসুর কেড়ে নিতে পারে। শিশুকালের ভুল বলে ক্ষমা পাওয়ার আশা কোনোভাবেই করবে না বরং অন্যায়কে অন্যায় হিসেবেই জানবে। না বলে অন্যের জিনিসে হাত দেওয়া আর চুরি করা একই অভিযোগ, তাই হাত ও মনটাকে সর্বদা সংযত রাখবে। খুব বেশি কোনো লোভের জিনিস দেখলে নিজের মনকে বলবে- ওই জিনিসটির আমার কি প্রয়োজন, আর ওটি না পেলে আমার কিবা আসবে-যাবে! বরং যদি নিজেকে সংবরণ না করি তবে আমার মা যিনি আমায় এত আদর্শ শিখিয়েছেন তার কোলে শুইয়ে রেখে, তার চোখে চোখ রেখে তাকে কষ্ট দিয়ে আমি কি সত্যিই এই লোভনীয় জিনিস (মোবাইল ফোন, আইপড, টাকা-পয়সা ইত্যাদি) এসব নিয়ে সত্যি সুখী হতে পারব? যদি সুখী হইও তবে তা কতক্ষণের জন্য আরেকটি নতুন Model-এর Gaggette বাজারে আসা পর্যন্ত। কিন্তু আদর্শ শেখানো ‘মা’ তিনি যে কষ্ট পেয়ে নিজেকে শেষ করে দিলেন চিরতরে তার কি হবে? আমি নিশ্চিত এই অনুভূতিগুলো যদি কোনো সন্তানের মধ্যে জন্ম থেকেই দেওয়া যায় তবে সমাজে এমন সব সন্তানেরই জন্ম হবে যাদের আমরা প্রতিনিয়ত নিউজ পেপারে আকুল আবেদন দেখি- মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা যে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিজের কষ্টার্জিত মেধা দিয়ে নিজের কঠিন অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছে, বাবার টাকা বা কারও তোষামোদে নয়। এবং তারা এসব সুযোগ কঠিন যোগ্যতা দিয়ে পেলেও অর্থের অভাবে তা সফলতার সঙ্গে গ্রহণ করার অনিশ্চয়তায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আমার কথাটি হলো এসব সন্তান-সন্ততি এমনি এমনি তৈরি হয়নি- তৈরি করা হয়েছে। এদের স্বার্থকতার পেছনে মা-বাবার অবদান ১০০% কোনো সন্দেহ নেই। এরা তো এই মফস্বল থেকেই মানুষ হয়েছে। বেশিরভাগই দারিদ্র্যের পরাকাষ্ঠা দেখে বড় হয়েছে- কিন্তু সত্যিকার অর্থে তারা বড় মানুষ হয়েছে কারণ ভালো মানুষই বড় মানুষ আমার ধারণায়।

যে কথায় আসতে চাই- ‘গৃহই সন্তানের শিক্ষার সূতিকাগার’- আর মা-বাবা সবচাইতে প্রথম শিক্ষাগুরু যাদের হাতে সন্তান হাতেখড়ি নেয়, এই পৃথিবীতে একা মানুষের মতো মানুষ হয়ে সমাজের মুখ উজ্জল করে। তাই হয়তো নেপোলিয়ন বোনাপাট বলেছিলেন, ‘তোমরা আমায় প্রকৃত শিক্ষিত ভালো মা দাও আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমাদের প্রকৃত শিক্ষিত ভালো জাতি উপহার দেব।’ মায়ের গুরুত্ব ঠিক তেমন। সে একজন অশিক্ষিত মা-ও প্রমাণ দিতে পারেন যোগ্য সন্তান তৈরি করে, এতে শিক্ষাগত যোগ্যতা যত না প্রয়োজন নৈতিকতার প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি। নির্লোভ, অমায়িক, ভদ্রতা, যোগ্যতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা, পরোপকার করা, অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়া, অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া, কটুকথা না বলা, ক্ষমা করে দেওয়া সর্বোপরি ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস করা। এসব গুণাবলি যে মা তার সন্তানদের দিতে পেরেছেন তারাই আজ দেশ-বিদেশে সমাদৃত। প্রশংসিত হওয়ার এটাই সহজ পন্থা। কিন্তু সময়টা সঠিক হতে হবে। কারণ পাঁচ বছর বয়সের মধ্যেই আপনার সন্তানের ভালো হওয়া বা মন্দ হওয়া- বাবা-মায়ের কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হয়ে যায় তাই এ সময় পার হয়ে গেলে ওদের পাত্র বদল করে কোনো লাভ হয় না। তারা ততক্ষণে পাত্রের আকার ধারণ করে ফেলে। একটি ঘটনা শেয়ার করতে চাই পাঠককুলের সঙ্গে- আমার মেয়ে যখন এদেশের একটি নামি স্কুলে হাতেখড়ি দিতে পড়ালেখা শুরু করল তখন একদিন শিশুসুলভ আচরণে সে আমার কাছে তার অন্য একজন সহপাঠীর একটি দৃষ্টিনন্দন টিফিন বক্স দেখে আবদার করে বলল তার এমনটি চাই। নইলে স্কুলে যাবে না- কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে তাকে এ লোভের জিনিসটি থেকে উরাবৎঃ করব। রাতে পাশে নিয়ে ঘুমানোর সময় তাকে বললাম আম্মু ওই টিফিন বক্সটা কি তোমার খুবই পছন্দ? কাঁদো কাঁদো গলায় উত্তর এলো ‘ণবং’ উত্তরে বললাম তবে একটা কাজ করি, আমি বা আমরা কেউ কাউকে আসলে কিছুই দিতে পারার শক্তি রাখি না, যিনি দিতে পারেন এবং সব ক্ষমতার অধিকারী যিনি, ‘আল্লাহ’ তার কাছে তুমি দোয়া চাও দেখবে হয়তো অমন জিনিসটিই তুমি পেয়ে গেছ। কথাগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করল। সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট দুটি হাত মোনাজাতে বলতে শুরু করল- আল্লাহ আমাকে অমন একটা টিফিন বক্স দাও- কত নিস্পাপ এবং সীমিত চাওয়া- মাত্র একটি ম্যাটিরিয়ালিস্টক দ্রব্যেই ওর চাওয়া সীমিত। তাই বুঝি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সঙ্গে সঙ্গেই ওর নিস্পাপ চাওয়াটিকে সত্যে পরিণত করলেন। কাকতালীয়ভাবেই কয়েকদিনের ব্যবধানেই আমার এক বোন বিদেশে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসার সময় ঠিক অমন টিফিন বক্সটিই আমার মেয়ের জন্য কিনে আনেন। আর যখন সে ওটা নিজের করায়ত্ত করল সে যে কি খুশি সেটা বোঝানোর কোনো দরকার নাই। কারণ এসব অভিজ্ঞতা আজকাল সব সন্তানরেই আছে। কিন্তু এটা কোনো সহজ ব্যাপার ছিল না। এটি ছিল একটি জটিল সমাধান চাওয়া। আকাক্সক্ষা, না পাওয়ার ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে লোভ, নানা রকম বিপথগামিতার সূচনালগ্ন যা অতি সহজেই একজন মা হিসেবে সামাল দিতে সাহায্য করেছিল। তারপর থেকে আমার সন্তানরা জানে কিছু চাইতে হলে কার কাছে চাইতে হবে। তাই ওরা কোনো কিছু চেয়ে পরক্ষণেই আবার নিজেকে শুধরে নিয়ে বলে- জানি তো বলবে ‘আল্লাহর কাছে চাও’ এই ম্যাজিক বাক্যটি হয়তো সেদিন আমার সন্তানকে নির্লোভ হতে সাহায্য করেছে এ লোভের পৃথিবীতে।

একটি উদাহরণ বা ব্যবধান যাই বলুন, না বলে পারছিনে। সেটি হলো বিদ্যালয়ের পরিবেশ, শৃঙ্খলা, নিয়মকানুন ইত্যাদি। আমাদের দেশের তথাকথিত নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের গেটে সব নব্য বড়লোক অভিভাবকদের দামি গাড়ির বহর তাদের সন্তানকে দামি গেজেট ও দামি জিনিসপত্রের (ঘড়ি, ব্যাগ, মোবাইল ও অন্য) যেন প্রতিযোগিতা চলে- এগুলো ছাড়া যেন ওখানে ভালো ছাত্রছাত্রীদের সনদ পাওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই অশুভ প্রতিযোগিতা একটা নিস্পাপ সন্তানের মনকে কখন যে অগোচরে লোভী, নীতিজ্ঞানহীন, অপদার্থ, ক্ষতিকারক মানুষ হিসেবে তৈরি করছে তা বুঝতে বুঝতে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়েই যাচ্ছে। তাই এটিও একটি উপদেশ। কোনো বিদ্যালয়ে সে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠই হোক কোনো ম্যাটিরিয়ালিস্টিক জিনিসের প্রতিযোগিতা থাকবে না সেখানে শুধু- লেখাপড়ার চর্চা ও প্রতিযোগিতাই প্রাধান্য পাবে।

এই অভিজ্ঞতাটি আমার সন্তান স্কুলে পড়াকালে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমায় তখনকার অভিজ্ঞতা- ব্রিটেনের একটি ঐতিহ্যবাহী পুরনো স্কুল যা ১৪৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজিতে যাকে বলে (চৎবংঃরমরড়ঁং চৎরাধঃব ঝপযড়ড়ষ) ওখানে পড়ার সুযোগ পেল। কিন্তু প্রথমেই ভীষণ তফাৎ বুঝতে পারলাম এখানে কোনো বড়লোকি দেখানোর সুযোগ নেই। বেশিরভাগ সবাই স্কুলের স্পেশাল বাসে যেতে হবে এবং কোনো রকম গেজেট, ঘড়ি, গেম, মোবাইল যা লোভের উদ্রেক করতে পারে এমন জিনিস সঙ্গে রাখাও নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রয়োজনে ফোন করতে হলে অফিস রুমে গিয়ে যে কোনো ছাত্রছাত্রী দরকারি ফোনের কাজ সারতে পারে। এই যে নিয়মটি কত জরুরি সেটা আমাদের ক’জন বাবা-মায়ের জানা বা ক’জন স্কুল কর্তৃপক্ষের জানা আমাদের দেশের স্কুলগুলোয়? আমার জানামতে, আমি শুনিনি বরং প্রতিযোগিতা যে খুবই জোরাল সেটাই প্রমাণিত। এর পেছনে কারণ আছে- সেসব পিতা-মাতার যারা অবৈধ উপার্জন দ্বারা সন্তানদের নামিদামি স্কুলে পাঠিয়ে মানুষ বানানোর অপচেষ্টা করে চলেছেন যা সত্যিই দুঃখ দেয়। এসব বাবা-মা, এসব সন্তান তাদের নিজ প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র ড্রাইভার, পিওনের ছেলেমেয়ের কষ্টার্জিত সাফল্য দেখে চোখ টাটিয়ে বলে- ওতো একটা ড্রাইভারের সন্তান আমাদের সামনে টাই পরে, অফিসার সেজে ঘুরে বেড়াবে তাতে তাদের ইগোতে বাধে। সত্যিই কি ইগো জিনিসটা এতো সস্তা নর্দমার পাঁকের মতো। ছিঃ ধিক্কার দেই সেসব আত্মা ও মনকে যারা দরিদ্র বলে তাদের কষ্টার্জিত অর্জন যা তাদের প্রাপ্য দিতে শুধুই কার্পণ্য করে তা নয়, কেড়েও নেয় সময় বিশেষে! কিন্তু সেই পিতামাতা যে নিজের অজান্তেই সন্তানকে সন্ত্রাসী হতে, অন্যের কষ্টার্জিত অর্জন ছিনিয়ে নিতে দীক্ষা দিয়ে দিল হাতে-কলমে তা কি তারা অনুধাবন করে?? করে না। তাই আবারও আসছি পেইন্টিংটির দিকে আরও একবার নজর দিতে এর বীভৎস্য চেহারাটি কি সেসব বাবা-মায়ের বললে ভুল হবে? যারা সমাজে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে!

এবার অন্য একটি ঘটনা বলি- আজ থেকে ২০ বছর আগের ঘটনা আমার একমাত্র ছেলে যখন ওর বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। প্রথম থেকেই যে বিদেশের স্বনামধন্য স্কুলে পড়েছে কিন্তু বছরে ৩টি ছুটিতেই তাদের আমি দেশে এনেছি মাটি ও মানুষের দুঃখ বোঝার জন্য। কখনও বিলাসিতার মোহ ওদের বিপথগামী করেনি, ইৎধহফ হধসব নিয়ে ওদের মাথাব্যাথা নেই, ওরা নিজেদেরই কষ্টার্জিত অর্জন দিয়ে ভালো মানুষ হওয়ার ‘ইৎধহফ’-এ পরিণত হওয়ার পথ নির্দেশ পেয়েছে একজন মায়ের কাছে, যা আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আমায় সাহায্য করেছেন ভালো সন্তান তৈরি করতে নইলে হয়তো সম্ভব হতো না। যে কথায় ফিরে যেতে চাই, আমার ছেলে যখন চড়শবসবহ-এর এধসব-এর ঈৎধুব চলছিল তখন ওকে নিয়ে একদিন ঢাকার কোনো একটি অভিজাত দোকানে যাই এধসবটি কিনবে বলে। কোনো কিছু চাইলে মা হিসেবে সব সময় আমি ইধৎমধরহ করি সেটা দেওয়ার আগে। আর কমিটমেন্টে আসতে হবে ইবংঃ ৎবংঁষঃ করলে শুধু সেই কাক্সিক্ষত জিনিসটি পাবে নইলে নয়। যাই হোক ভালো ৎবংঁষঃ-এর বিনিময়ে আমাকে চড়শবসবহ এধসবটি কিনে দিতে বাধ্য হতে হয়েছিল। কিন্তু সে সময় সে দোকানে গিয়ে দুটো এধসব কেনার বায়না ধরে। একটি ঈড়সরঃসবহঃ মোতাবেক কিনে দিই কিন্তু অন্যটি অন্যায়ভাবে চাইছে শিশুসুলভ আচরণে। যখন ওর সঙ্গে আমার গাড়িচালক ছিল, আমার সন্তানরা কখনো নাম ধরে ডাকে না, মামা বলেই ডাকে। আমি তখন ওর গরহফ ফরাবৎঃ করতে কানে কানে বললাম বাবা তুমি কি জান তোমার এই গেমটার দাম তোমার এই ড্রাইভার মামার সারা মাসের বেতনের সমান, এই টাকা দিয়ে ও বাবা-মা, পরিবার, বাচ্চা সবাইকে নিয়ে কখনো খেতে পারে পেট ভরে কখনো না খেয়ে থাকে। তুমি যদি এই চড়শবসবহ-এর এধসব-এর টাকাটা দিয়ে এধসবটি না কিনে উনাকে দিয়ে দাও ও কত খুশি হবে জান। ওরা পেট ভরে খাবার খাবে আর তুমি একবার এটা দিয়ে খেলবে তারপর তা ফেলে দেবে। এবার ভেবে দেখ তুমি এধসব কিনবে না যে তোমাকে এত খেয়াল রাখে তাকে খুশি করবে? ম্যাজিকের মতো কাজ করল। সে টাকাগুলো দোকানদারকে না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কাছে থাকা ড্রাইভার মামার হাতে দিয়ে দিল। ড্রাইভার সাহেব প্রথমে বুঝতে পারল না ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে থাকল। যখন বুঝল তখন আমার ছেলের চোখেও পানি (ওরা একটুতেই গরিবের কষ্টে কষ্ট পায়) আর ড্রাইভারও ছলছল চোখে দোয়া করছে। আপনারা ভাবছেন এতে মা হিসেবে স্বার্থকতা কোথায়? হ্যাঁ আমি সেই মা যে এই ক্ষুদ্র সার্থকতার বীজ সেদিন আমার ছোট নিস্পাপ সন্তানের মনে বপন করতে পেরেছিলাম। যার সুমিষ্ট ফল আজ আমায় আনন্দের জীবনে ভাসিয়ে দিয়েছে। কারণ আমি দু’জন ভালো সন্তান সর্বোপরি ভালো মানুষের জন্ম দিয়েছি- যোগ্যতা-অযোগ্যতা মাপার মাপকাঠি আমার নেই, কারণ আমি একজন মা। আর আমার কাছে বঞ্চিত, নিগৃহীত, অসহায় সন্তানসন্ততি আমারই সন্তান। তাই যেখানেই আমি ওদের পাই আমার সাহায্যের হাত বাড়াই সবার অজান্তে- একজন প্রকৃত মা জননীরূপে। যদি কিছুই করতে না পারি হাত তুলে দোয়া করি প্রাণভরে সেই মজলুম, অত্যাচারিত, অসহায় সন্তান যেন সৎপথে ফিরে আসে।

আমার এ লেখার পেছনের ঘটনাগুলো নিজেকে বা আমার সন্তানদের জাহির করার জন্য নয়- এই ঘটনাগুলো সাক্ষী দেয় একজন মা তার সন্তানকে কিভাবে তৈরি করবে মাটির দলা থেকে শক্ত কিন্তু উদার, দয়ালু কিন্তু কঠিন (নৈতিকতার কাছে হার না মেনে)। যে মা মাটির ওপর মাদুর বিছিয়েও যে শিক্ষা দিতে পারে, সে পালঙ্কে শুয়েও একই শিক্ষা দিতে পারে। তফাৎ শুধু ভালো মা হতে পারা- সন্তানকে হাতে ধরে ন্যায় এবং অন্যায়ের তফাৎ বোঝানো। মেটিরিয়ালিস্টিক জিনিসের লোভ যে অল্প সময় ফুরিয়ে যায় কিন্তু মায়ের চোখের পানি কি কখনো কেউ সহ্য করতে পারে? নিশ্চয়ই না। সব দুঃখ-কষ্ট বাবা-মা একসঙ্গে ভাগভাগি করে নিয়ে সন্তানদের দায়িত্ববোধের স্বভাব গড়ে তুলুন। ভালোবাসার ঘর দিন, ঘরবিমুখ হবে না আপনার সন্তান।

খোঁজ নিয়ে দেখুন এসব কিশোরগ্যাং, বিপথগামী যুবসমাজ (তা বিত্তবানদের সন্তান হোক বা হতদরিদ্র সন্তানই হোক) এদের বাবা এদের সঙ্গে চরম নিষ্ঠুরতা করেছে- কর্তব্যে অবহেলা, সন্তানের সামনে অশ্লীল পরকীয়া, মায়ের প্রতি নিষ্ঠুরতা, সামাজিক অবক্ষয় আজ এসব কিশোর গ্যাং-এর তৈরির পেছনে কাজ করছে- নেশাও একটি প্রধান উপাদান তবে আবারও সেই ভয়ঙ্কর পেইন্টিংটির কথাই মনে করেই দিচ্ছি এটাই সেসব বাবা-মায়ের চেহারা যারা সন্তানদের জীবনে এমনই অশুভ বিষবাষ্প ঢেলে চলেছে অবিরত। হয়তো তা অতি ঐশ্বর্য্যে অথবা অতি খারাপ স্বভাবে। অথবা অতি অভাবে যখন মানুষ দায়িত্বহীন হয়ে যায় আর আজ এই কিশোরগ্যাং এসব বাবা-মায়ের বলির পাঁঠা। কথায় আছে মানুষের বাচ্চাকে শুধু মানুষ বানাতে হয়, জীবজন্তুর বাচ্চারা জন্ম নিয়েই হাঁটতে-চলতে পারে। তাই ঘৃণা কিশোরগ্যাং, অবক্ষয়জনিত, বিপথগামীদের নয় এদের জন্মদাতা পিতা-মাতাদের, যারা নিজেদের শোধরাতে পারলে এমন সন্তানের জন্ম হয়তো হতো না। তাই সুন্দর-সুস্থ সমাজ গড়তে আদর্শবান মা-বাবার কোনো বিকল্প নেই।

আর ঝুড়িতে থাকা কিছু পচা আমকে ফেলে না দিয়ে এগুলোকে জুস হিসেবেও ব্যবহার করা যায়- মানে এসব কিশোরকে গায়ের ঘাম ঝরানো কাজে নিয়োজিত করুন ওদের সব টিকটক, লাইকির নেশা মুহূর্তেই উধাও হয়ে যাবে- যখন সৎভাবে বেঁচে থাকার স্বাদ পাবে তখন বাস্তবকে মেনে নেওয়া ওদের জন্য সহজ হবে, সম্মানের হবে।

আপনার সন্তান বিপথগামী হলে আপনি কাকে দোষারোপ করবেন? সমাজ, সংসার, আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব কাকে? তাতে লাভ কি হবে। সর্বনাশ যা হওয়ার তাতো হয়েই যাবে। আপনারা বাবা-মা আত্মগ্লানিতে মৃত্যুসম জীবনযাপন করবেন তাই এখনই সময় সন্তানের অন্তরে ভালো স্বভাব, ভালো কথার বীজ বুনুন। ওদের সময় দিন, পৃথিবীটা কত Unfair, কিন্তু মনুষত্ব যা সবার ওপরে। তাতে পুঁথিগত বিদ্যা নাই বা আয়ত্ত হলো ছোটখাটো কাজের মধ্যেও যে অনেক বড় মাপের মানুষ হওয়া যায় মনুষত্বের পরিচয় দিয়ে। তেমনি ঘৃণা করতে শেখান ওইসব তথাকথিত অর্থসম্পদশালীকে যারা নৈতিকতা বিবর্জিত, যারা হাতে ধরে নিজ সন্তানকে বিপথগামী থেকে বুক ফুলিয়ে উৎসাহ দিয়ে চলেছে- তবেই ওদের চোখ খুলবে। Life is nothing but a combination of responsibility respect and unconditional love!! Only then it will make this world peaceful, I belive in it!

জীবন হলো দায়িত্বশীলতা, প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শন ও স্বার্থহীন ভালোবাসার সংমিশ্রণ। আর এই কটি অপরিহার্য আবেগ পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে। তখন হয়তো আমাদের আর বলতে হবে না- 'There are lot of human beings but there is no humanity!!'

লেখাটি শেষ করার আগে আমি সেসব পিতা-মাতার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী যারা বহু চেষ্টা করেও সন্তানকে সৎপথে আনতে পারেননি। তাদের জন্য উপদেশ- হাল ছাড়বেন না কখনো, কারণ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যে কোনো সময় আপনার প্রতি সদয় হতে পারেন। আর বিত্তবান পিতা-মাতার প্রতি অনুরোধ আপনারা অঢেল টাকার লোভ দেখিয়ে নিজ সন্তানের নৈতিক চরিত্র হনন করা থেকে বিরত থাকুন।

ফারজানা চৌধুরী ডাইরেক্টর, এইচআরসি গ্রুপ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে