আসন্ন রমজান ও নিত্যপণ্যের বাজার

প্রশ্ন হচ্ছে, কেজিতে ৩০ টাকা দাম বাড়িয়ে ৭ দিন পর ১০ টাকা কমানো, এটা কি দাম কমানো নাকি কারসাজি। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। এ ছাড়াও একই বাজারে পাশাপাশি দোকানে একই পণ্যের দাম ভিন্ন। কোথাও কোনো সমতা ন্যায্যতা সততা নেই। কেবল রমজানে নয়, সারা বছর বাজার মনিটরিং করতে হবে। বাজার নিয়ে অতীতে অনেক পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। বিক্রেতাদের মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। বিক্রেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন যতদিন না ঘটবে - ততদিন নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির থাকবেই এবং দেশের জনগণও তাদের কাছে জিম্মি থাকবে।

প্রকাশ | ৩০ মার্চ ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২২, ১০:০০

সালাম সালেহ উদদীন

নিত্যপণ্যের বাজার কোনোভাবেই স্বাভাবিক হচ্ছে না। একেক সময় একেক অজুহাত তুলে বিক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আসন্ন রমজানে আগের মতো দাম বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং দাম কমাতে সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশ করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সংসদে কঠোর সমালোচনা করেছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ও বিএনপির সদস্যরা। এ সময় জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, 'বাজারে গেলে মনে হয় না সরকার আছে। মনে হয় না সরকারের কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ আছে। জনগণ চরম দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছে। সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। টিসিবির পণ্য ন্যায্যমূল্যে দেয়া হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম কমানোসহ গ্রামে ও শহরে সার্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন। ২৮ মার্চ সোমবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধনে এ দাবি জানায় সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এটা সত্য, করোনাকালে কাজ হারিয়ে লাখ লাখ মানুষ বেকার ও কর্মহীন হয়েছে। এরমধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় পুড়ে যাচ্ছে মানুষের স্বপ্ন। তাই বিপদ থেকে মানুষের উত্তরণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সব পণ্যের দাম কমানোসহ গ্রামে ও শহরে মানুষকে রেশনিং ব্যবস্থার আওতায় আনার যে দাবি, সরতার তা ভেবে দেখতে পারে। কিছুদিন ধরে নিত্যপণ্যের বাজারে পাগলা ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। রাজধানীতে এখন প্রতিকেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে। গত এক সপ্তাহ আগেও যা বিক্রি হয়েছে ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকায়। ক্রেতারা বলছেন, গত শবেবরাতের দিন থেকে বেড়ে যাওয়া গরুর মাংসের দাম আর কমবে কিনা তা অনেকটাই অনিশ্চিত। কারণ, এই দেশে কোনো জিনিসের দাম একবার বাড়লে আর কমে না। তবে ঠিক কোন কারণে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে তা জানেন না কেউই। স্বল্প আয়ের মানুষ তো দূরের কথা মধ্যবিত্তরাও গরুর মাংস কেনার সক্ষমতা হারিয়েছে। কনজু্যমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ঢাকায় ২০১৪ সালে এক কেজি গরুর মাংসের গড় দাম ছিল ৩০০ টাকা। ওই সময় মাঝারি আকারের দেশি মুরগির প্রতি কেজি দাম ছিল ৩১৭ টাকা। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হিসাবে দেশি মুরগির গড় দাম ৩৫২ টাকায় ওঠে, আর গরুর মাংসের গড় দাম ৫২৭ টাকায় ঠেকে। ক্যাবের হিসাবে, গত অক্টোবরে গরুর মাংসের গড় দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর গত চার বছরে বাংলাদেশে অনেক গরুর খামার হয়েছে। তরুণদের অনেকে বড় খামার করে উদ্যোক্তা হয়েছেন। সরকার দাবি করছে, নিজেদের গরুতেই ঈদুল আজহার বিপুল চাহিদা মিটছে। তবে তা দিয়ে বছরের অন্য সময়ের চাহিদার কতটুকু মিটছে তা অবশ্য অনেকটাই অদৃশ্য রয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে এখন গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৮৫ লাখের মতো। ২০১৮ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হিসাব দিয়েছিল, তখন গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৩৯ লাখ ছিল। বাজারে মাংসের সরবরাহ কম নয়। তারপরেও দাম কেন এত বেশি। আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ও ভেজালরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু বাজার কেন্দ্রিক অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। প্রতিবারই লক্ষ্য করি পবিত্র রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার সিদ্ধান্ত হয়, চোখে পড়ার মতো কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়। কিন্তু ইতিবাচক কোনো ফল পরিলক্ষিত হয় না। রমজান আসার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের অতিমুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ীরা প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। প্রতি রমজানেই এই দৃশ্য আমরা প্রত্যক্ষ করি। এটা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং বাজার সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল অংশ। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের অজুহাতের শেষ নেই। তারা একেক সময় একেক অজুহাত দাঁড় করায়। তারা খাদ্যে ভেজালও দেয়। এই চিত্র বদলানো কঠিন। সমাজের সর্বত্র চলছে নীতিহীনতার জয়জয়কার। এর ফলে সত্য ন্যায়পরায়ণতা ঢাকা পড়ে গেছে অবলীলায়। আগে পাঠ্যপুস্তকে নীতিকথা ছিল। নীতিকথা থাকা মানে হচ্ছে, ব্যক্তি জীবনে তা অনুসরণ করা। কেবল পাঠ্যপুস্তকে নয়, গুরুজন বা অভিভাবকরা শিশু বয়স থেকেই শেখান এবং সাবধান করে দেন, সন্তানরা যাতে অসৎ পথে না চলে। ব্যক্তি সৎ ন্যায়নিষ্ঠ কর্তব্যপরায়ণ বলেই তার প্রভাব পড়ে পরিবার ও সমাজে। ব্যক্তির চরিত্র ও মানস গঠনে সততা এক অপরিহার্য শর্ত। আমরা শত চেষ্টা করেও ব্যক্তি চরিত্রের বিকাশ ঘটাতে পারলাম না। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। \হঅপ্রিয় হলেও সত্য, দেশে কেবল নিত্যপণ্যের দামই অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে তা নয়, বর্তমানে খাদ্যে ভেজালও অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে বাংলাদেশের মানুষকে কিডনি রোগ, ক্যানসারসহ নানাবিধ মরণব্যাধি থেকে রক্ষা করতে হলে খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। দেশে 'খাদ্য নিরাপত্তা' একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উৎপাদন করেই হোক কিংবা আমদানি করেই হোক, খাদ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মনে রাখতে হবে, 'খাদ্য নিরাপত্তা' এ দেশের জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। সেই সাংবিধানিক অধিকার সামনে রেখেই 'খাদ্যে নিরাপত্তা' নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের মনে রাখা জরুরি, নিরাপদ খাদ্যে বাঁচে জীবন, ভেজালে হয় বিপন্ন। দেশে আইন আছে, প্রয়োগও হয়। কিন্তু তাতে ভেজাল প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না। সঙ্গত কারণে আরও কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। দেশ খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করলেও মানসম্মত খাদ্যের নিশ্চয়তা মেলেনি। খাদ্য উৎপাদনে এ দেশের কৃষকের সাফল্য রয়েছে। কিন্তু ভেজাল খাদ্যপণ্য ও পণ্যের উচ্চমূল্য মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। জনসাধারণকে ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হলে চলবে না। তাদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এরা জনগণের স্বার্থের দিকে কখনোই নজর দেয় না। এরা বাজার সন্ত্রাসী। কীভাবে অসৎ উপায় অবলম্বন করে দ্রম্নত ধনী হওয়া যায় সেটাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। বাজারে মূল্য তালিকা টাঙিয়ে যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের অসহায় জনগণকে জিম্মি করে তারা পকেট কাটবে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এর আগে তারা চাল চিনি ও পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল। লবণের ক্ষেত্রেও চেষ্টা চালিয়েছিল, সফল হয়নি। ওই সময়ে ৪০ টাকার পেঁয়াজ ২৫০ টাকা কেজিতে উঠেছিল। এর চেয়ে দুঃকজনক ঘটনা আর কী হতে পারে। এবারও চাল, চিনি ও পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছিল। বর্তমানে পেঁয়াজের দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। চালের বাজারও কিছুটা স্থির। ভোজ্যতেল নিয়ে কারসাজি আপাতত বন্ধ হয়েছে। অবাক ব্যাপার দু বছর আগে এক লিটার তেলের দাম ছিল ১০৫ টাকা, যা সম্প্রতি কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ২০০ টাকায় উঠেছিল। \হপ্রশ্ন হচ্ছে, কেজিতে ৩০ টাকা দাম বাড়িয়ে ৭ দিন পর ১০ টাকা কমানো, এটা কি দাম কমানো নাকি কারসাজি। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। এ ছাড়াও একই বাজারে পাশাপাশি দোকানে একই পণ্যের দাম ভিন্ন। কোথাও কোনো সমতা ন্যায্যতা সততা নেই। কেবল রমজানে নয়, সারা বছর বাজার মনিটরিং করতে হবে। বাজার নিয়ে অতীতে অনেক পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। বিক্রেতাদের মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এটা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। বিক্রেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন যতদিন না ঘটবে- ততদিন নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির থাকবেই এবং দেশের জনগণও তাদের কাছে জিম্মি থাকবে। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর কঠোর উদ্যোগই কেবল পারে জনগণকে হয়রানি ও দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে। জনগণকে অসহায়ত্বে বা জিম্মিদশায় ফেলে দেয়া কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ নয়। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে ভালো কথা, সেই উন্নয়নের সুফল যেন সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে সেদিকে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সরকার চাইলেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হলে চলবে না। জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক