মানবিক বিশ্ব ব্যবস্থাই কাম্য

সাম্প্রতিক সময়ের বৈশ্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে খুব সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত যেদিকেই যাক না কেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে চোখ রাখতে হবে এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের দিকে। আবেগের বশে কোনো খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। কোনো রাষ্ট্রের চাপের কাছে মাথা নত করাও ঠিক হবে না, আমাদের মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ নয়, মানবিক বিশ্ব ব্যবস্থাই আমাদের কাম্য।

প্রকাশ | ০১ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২২, ১০:০৩

মোনায়েম সরকার

আদিমকাল থেকেই দেখা যাচ্ছে, সমাজে একদল দুর্বল মানুষ থাকে- যারা কোনো দিনই নিজেদের অধিকার পেতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এরা কম খায়, কম পরে, কম শিখে; কিন্তু কাজ করে সবার চেয়ে বেশি। এই অল্পে তুষ্ট মানুষ নিজের গায়ে ধূলি লাগিয়ে, কাদা-জলে জীবন কাটিয়ে সমাজের উঁচুতলার মানুষকে সেবা দিয়ে যায়- কিন্তু তাদের ভাগ্যে এতটুকু সম্মান বা সমাদর জোটে না। এই ধুলোমাখা মানুষই সভ্যতার নির্মাতা, এদের বুকে পা ফেলেই পৃথিবীতে আসে নব উত্থান। এই মানুষের মঙ্গল কামনাই রাষ্ট্রনায়কদের জীবনের ব্রত। বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অগ্রগতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি- পৃথিবীর ইতিহাসে নিঃসন্দেহে তা চমকপ্রদ, যা বিগত বহু শতাব্দীতে সম্ভব হয়নি এবং অনাগত কালের জন্যও বিস্ময়কর। কিন্তু এটা কি অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে, যে বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণের জন্য যে শ্রম ও মেধা ব্যয় করছে- মানুষকে বিভিন্নভাবে মারার জন্যও তার প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। অ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মারণাস্ত্র তৈরিতেও মানুষের বিপথগামিতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আজ মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, সে কি তার সর্বশক্তি মানবকল্যাণেই ব্যয় করবে- নাকি মারণাস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখবে। ইতিহাসে মধ্যযুগে আমরা দুই শতাব্দীব্যাপী ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কথা জানি। ক্রুসেডাররা পবিত্র জেরুজালেম নগরী লুণ্ঠন করেছিল, অসংখ্য মসজিদ ও সিনেগগ ধ্বংস করেছিল এবং নির্বিচারে অগণিত মুসলমান এবং ইহুদিকে হত্যা করেছিল। কিন্তু তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো ধর্মীয় পবিত্রতা ছিল না। ১০৯৯ সালে ক্রসেডারা জেরুজালেমে খ্রিষ্টান রাজত্ব কায়েম করেছিল। ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ আজও চলছে, তবে অন্যরূপে। আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম আর ধর্ম নিয়ে সংঘাত অনেক সময়ই প্রধান রাজনৈতিক ইসু্যতে পরিণত হয়েছে। এক অর্থে এটা হয়তো স্বাভাবিক, কেননা, এশিয়া থেকেই বেশির ভাগ ধর্মের উৎপত্তি। ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, কনফুসিয়ানবাদ, তাওবাদ, সিন্দোবাদ- এসব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলেই সৃষ্টি হয়েছে। এখানে ধর্মের নামে যে কি ভয়াবহ রক্তপাত হয়েছে তা আমরা ইতিহাসে দেখেছি। দেখেছি হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। পরে ১৯৭১ সালে দেখেছি মুসলমান-মুসলমানের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ধর্মের নামে, সাম্প্রদায়িকতার নামে বর্তমান শতাব্দীতেও কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ হচ্ছে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পালস্না দিয়ে বেড়েছে মানুষের লোভ আর স্বার্থপরতা। সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিমানুষকে যে পরিমাণ নির্লোভ আর পরার্থপর হওয়া উচিত তা কি একবিংশ শতাব্দীর অতৃপ্ত, লোভী ও স্বার্থপর মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব? আজ বরং আমার মনে হচ্ছে- যা হয়েছে সমাজপ্রগতির ধারাতেই হয়েছে। যা হবে তাও সমাজপ্রগতির স্বাভাবিক ধারাতেই হবে। সমাজপ্রগতির ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে মানুষ শুধু নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় দেবে না, সঙ্গে সঙ্গে মানবসভ্যতার পতনও ডেকে আনবে। আমি আমার জীবনে কত ঘটনা-ই না দেখেছি। আমি দেখেছি, জমিদারের জমিদারি গেছে, রাজার রাজত্ব গেছে, সাম্রাজ্যবাদীর সাম্রাজ্য গেছে। সামরিক স্বৈরশাসকদের পতন হয়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে। শীতল (ঈড়ষফ ডধৎ) বা স্নায়ুযুদ্ধের মুহূর্তগুলোও প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এগুলো থেকে আমার এই প্রতীতিই জন্মেছে যে, ক্ষমতা কখনো স্থায়ী হয় না; ফাঁকি দিয়ে, চালাকি করে বৃহৎ ও মহৎ কাজ করা যায় না। জোর করে ইতিহাসে স্থান পাওয়া যায় না। ইতিহাস তার অমোঘ নিয়মে চলে। বর্তমান বিশ্ব হিংসা আর স্বার্থপরতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তাই দেশে দেশে ও মানুষে মানুষে মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত লেগেই আছে। মানুষের জন্য যা ক্ষতিকর সেসব করা মানুষের উচিত নয়। তবু মানুষ মোহে অন্ধ হয়ে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে এমন কিছু আবেগী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে- যা সভ্যতার জন্য কলঙ্কতিলক হয়ে থাকে। যুদ্ধ পৃথিবীতে কেউ চায় না, তবু আজ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে মানুষ আজ মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তির পথে না হেঁটে মানুষ যদি যুদ্ধের পথে হাঁটে ও অস্ত্রের ভাষায় কথা বলে, তাহলে রক্তস্রোত বন্ধ হবে না। বন্ধ হবে না ঘরে ঘরে অসহায় মানুষের কান্না। দেশে দেশে আজ মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। পৃথিবীর স্বার্থেই আজ মারণাস্ত্র তৈরির কারখানা বন্ধ করতে হবে। বর্তমান কালপর্বে ইউক্রেন যুদ্ধ তারই ফলে সংঘটিত হচ্ছে। এর শেষ কোথায় কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। এক সময় মানুষ বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে বসবাস করত। সেই বনচর মানুষরা স্বাধীনভাবেই জীবনযাপন করত। তাদের মধ্যে তেমন কলহ ছিল না। শোষণ ছিল না। উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চয়ের কোনো মানসিকতাও ছিল না। বনচারী মানুষের সেই জীবনকে সমাজতাত্ত্বিকরা নাম দিয়েছেন আদিম সাম্যবাদী সমাজ। সমাজ বিবর্তনের ধারায় আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তৈরি হয় দাসপ্রথা। দাসযুগে ব্যক্তি মানুষের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। দাসদের ছিল না স্বাধীন জীবনযাপন করার অধিকার। দাসবিদ্রোহের পরে আসে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দাসরা কিছুটা মানবিক অধিকার ফিরে পেলেও তাদের ভাগ্যোন্নয়ন পুরোপুরি হয় না। আবার শুরু হয় শোষিত মানুষের লড়াই। এ লড়াই চলতে থাকে যুগের পর যুগ। এক সময় ভেঙে পড়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। জন্ম নেয় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এই নব্য পুঁজিবাদী যুগে এসেও মানুষ শোষিত হতে থাকে। যার ফলে রাশিয়া-চীনসহ বেশ কিছু দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে হয়- আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে যাওয়ার পর এখনো মানুষ পরিপূর্ণভাবে সুখী হতে পারেনি। অর্থ ও ক্ষমতালোভী কিছু মানুষ অধিকাংশ মানুষকে সুখী হতে দেয়নি। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, 'পৃথিবীর ইতিহাস মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।' বাস্তবে পৃথিবীর ইতিহাস কখনোই শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস নয়। পৃথিবীর ইতিহাস মূলত ক্ষমতা দখল ও বদলের ইতিহাস। ক্ষমতাই পৃথিবী পরিবর্তনের কারণ। কেননা, মানুষ দেখেছে ক্ষমতা থাকলে অর্থ-বিত্ত-আরাম-ভোগ-বিলাসিতা সবকিছু করতলে থাকে। তাই ক্ষমতার কাছে যাওয়ার জন্য মানুষ চিরদিনই তৎপর থেকেছে। এই তৎপরতা আজও অব্যাহত আছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ নানারকম লড়াই-সংগ্রাম করছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তা মূলত ক্ষমতা কুক্ষিগত করারই সংগ্রাম। একদল সুবিধা বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষ ভেবেছে তাদের ক্ষুধা ও মৃতু্যর কারণ ক্ষমতাশালীদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য। তাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্যই সুবিধাবঞ্চিতরা নানারকম লড়াই করেছে এবং সেসব লড়াইয়ের কেতাবি নামও প্রয়োগ করেছে। কিন্তু দেখা গেছে, যারাই ক্ষমতার কাছে গিয়েছে তারাই দসু্য, ডাকাত ও দুর্বৃত্ত হয়ে ওঠেছে। তাই তাদের হটানোর জন্য আবার শুরু হয়েছে নতুন লড়াই, ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন নামে। পৃথিবী নিজের নিয়মেই পরিবর্তনশীল। মানুষ সেই পরিবর্তন কিছুতেই রোধ করতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে মানুষ চাঁদ-মঙ্গলসহ অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের পাশাপাশি মহাবিশ্বের অনেক কিছুই জয় করেছে। কিন্তু প্রকৃতিকে জয় করতে পারেনি। মানুষ ভূমিকম্প, সুনামি, জলোচ্ছ্বাস ও দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি। মানুষ চেষ্টা করছে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে। কবে এসব তার করতলগত হবে, তা ভবিষ্যতই জানে। আজ পৃথিবীর দিকে তাকালে মনে হয়, বিশ্ব একটি মানবিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে, ঘরে ঘরে, দেশে দেশে মানুষের কান্না থামাতে গেলে অবশ্যই মানুষকে মানবিক হতে হবে। মানুষ যদি মানবিক না হয়, তাহলে মানুষের পৃথিবী কখনোই সুন্দর শান্তিময় হবে না। এই পৃথিবী আমাদের; আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্রাজ্যবাদসহ সব উগ্রপন্থিদের নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখতে হবে। আজ আমরা পৃথিবীর দেশে দেশে কিছু উপদ্রব দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখছি, একটি সম্প্রদায় আরেকটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তৎপর হয়ে উঠছে, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীকে দমন-পীড়ন ও হত্যা করছে সংখ্যাগুরুরা। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কর্মকান্ড দেখে আজ সঙ্গত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগছে আমরা কী তাহলে আবার পেছনে ফিরে যাচ্ছি? ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও মাস্টার দা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা কল্পনা যোশীর (১৯১৩-১৯৯৫) একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি কল্পনা যোশী কলকাতার পিজি হাসপাতালে মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যর কয়েকদিন পূর্বে আমি আর নাচোলবিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র কল্পনা যোশীকে হাসপাতালে দেখতে যাই। হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বে ইলাদি বলেন, 'কল্পনাদিকে দেখতে গিয়ে কি হবে, তিনি তো কাউকে চিনতে পারেন না।' তবু আমি কল্পনাদির স্নেহের কথা মনে করে তাকে শেষ দেখা দেখতে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তিনি তার বেডে চুপচাপ শুয়ে আছেন। তাকে সেবারত নার্সের অনুমতি নিয়ে আমি আর ইলাদি ভেতরে যাই এবং ডেকে তুলি। আমার পরিচয় দিতেই তিনি চোখ মেলে তাকান এবং বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাকে বলি বাংলাদেশ ভালো নেই। এরপর তিনি বললেন, 'একদিন আমরা একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য লড়াই করেছি। তখন মনে হতো পৃথিবী একদিন সুন্দর হবে। কিন্তু আজ দেখছি পৃথিবীটা যেন কেমন হয়ে গেল।' তিনি আর কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজন বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমার মাথায় তখনও কল্পনাদির কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছিল। একদিন তো আমরাও আমাদের যৌবনে সুন্দর পৃথিবীর জন্যই লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আজ পৃথিবীর এই রক্তাক্ত দুরবস্থা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আজ আমরা প্রাচ্য-প্রতীচ্য যেদিকেই তাকাই না কেন সবখানেই মানুষের হাহাকার দেখছি। দিশেহারা মানুষের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। ক্ষমতাশালীদের প্রতাপে ভেঙে পড়ছে প্রাচীন ঐতিহ্য ও সভ্যতা। মানুষ তার স্বভূমি থেকে হচ্ছে বাস্তুচু্যত। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দেশে আগুন জ্বলে ওঠছে। শান্তির পরিবর্তে মানুষ ভোগ করছে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক শাস্তি। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তবু হচ্ছে। আমরা কি পারি না সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দর দিন আনতে? মানুষের প্রয়োজনেই মানুষকে সুন্দর ও শান্তির পথ বেছে নিতে হবে। কল্যাণের দায়িত্ব নিতে হবে মানুষকেই। বিগত শতাব্দীতে আমরা দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। সেই দুটি বিশ্বযুদ্ধে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির কথা নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণে আছে। আজ যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং পারমাণবিক ও জীবাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ সেই যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিছুতেই আমরা আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের পাশাপাশি মানবিক বোধ জাগ্রত করতে মানুষকে আরো সচেষ্ট হতে হবে। অশুভ-শক্তির পতন ঘটিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকারে আজ আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই মুক্তি মিলবে মানুষের। বর্তমান পৃথিবী এখন একটা নতুন আর্থসামাজিক ব্যবস্থার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক (টহরঢ়ড়ষধৎ) বিশ্ব ব্যবস্থা কখনো সফল হবে না। সিআইএ, পেন্টাগন, ন্যাটোর সব প্রচেষ্টা আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সৃষ্ট তালেবান, আল-কায়দা, আইএস-এর সঙ্গে আবার তাদেরই যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষ আজ মানবিক বিশ্ব ব্যবস্থা (ঐঁসধহব ডড়ৎষফ ঙৎফবৎ) কামনা করছে। এবার বাংলাদেশের প্রসঙ্গে দুয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার। বঙ্গবন্ধুর আমলে যেমন বাংলাদেশ অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের ও প্রতিষ্ঠানের চক্ষুশূল ছিল এখনো তাই আছে। তবে আশার কথা এই যে, জনবান্ধবনেত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে বিরুদ্ধবাদী সেই শক্তিমান রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- আমেরিকা, চীন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ওআইসি- এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্য গড়তে তৎপর হয়ে উঠছে। এটা বর্তমানের বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সুখবর। নিন্দুকের দৃষ্টি কখনোই ভালো কিছু দেখে না। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সব দুঃসাধ্য কাজ সাধন করেছেন তা কারো পক্ষে সম্ভব হতো কিনা জানি না। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন (যেমন হিজবুত তাহরীর, জেএমবি, আনসারউলস্নাহ বাংলা টিম, হরকাতুল জিহাদ)-এর মূলোৎপাটন করেছেন- এগুলোকে যারা ছোট করে দেখতে চায়, তারা প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অস্বীকার করতে চায়। বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এটা যতদিন বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে না পারবে ততদিন বাংলাদেশের কোনো উন্নয়নই, কোনো পরিকল্পনাই টেকসই হবে না, আর সেইখানেই অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নাম আকাশে-বাতাসে সসম্মানে উচ্চারিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষে ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সূচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে সমুন্নত রাখতে শেখ হাসিনাকেই ভূমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় সুনাম অর্জন করছে। অর্থনীতি ও সামাজিক জীবন কাঙ্ক্ষিত স্তরে উপনীত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ পরিহার করতে হবে। দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং জনমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সাংগঠনিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে। সজাগ থাকতে হবে দলের প্রত্যেকটি নেতাকর্মীকে। আওয়ামী লীগের কাছেই বাংলাদেশ আশা করে, কেননা, আশার স্বপ্ন আওয়ামী লীগই বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য রাখে, বহতা নদীর মতো আওয়ামী লীগ চলমান। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বাংলাদেশকে উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছে। এখন মানুষের মনে অনেক আশা জন্ম নিচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এখন সবদিক সামাল দিয়ে ঠান্ডা মাথায় সরকার ও দল পরিচালনা করতে হবে। বাংলাদেশের এখন বড় বাধা দুর্নীতি। সব সেক্টরে দুর্নীতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। আগামী দিনের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছে। শেখ হাসিনার স্বপ্ন আর সাধারণ মানুষের স্বপ্ন মিশে একাকার হয়ে গেছে। যে অনন্য উচ্চতায় শেখ হাসিনা নিজেকে এবং বাংলাদেশকে স্থাপন করেছেন সঙ্গত কারণেই তার কাছে মানুষের প্রত্যাশা সীমাহীন। বাংলার নিরন্ন-দুঃখী মানুষের প্রত্যাশা তিনি পূরণ করবেন এমনটাই আশা করে এ দেশের জনগণ। সাম্প্রতিক সময়ের বৈশ্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে খুব সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত যেদিকেই যাক না কেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে চোখ রাখতে হবে এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের দিকে। আবেগের বশে কোনো খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। কোনো রাষ্ট্রের চাপের কাছে মাথা নত করাও ঠিক হবে না, আমাদের মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ নয়, মানবিক বিশ্ব ব্যবস্থাই আমাদের কাম্য। মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ