মোবারক আমার বন্ধু

বাস্তব জীবনে যোগ দিতে আমি ফিরে এলাম ঢাকাতে। অনেক কাজ। অনেক ভণিতা নিয়ে জীবন। আধুনিক জীবন। আমার জীবনে এখন বহু দামি বন্ধু এসেছে। তারা দেখতে সুদর্শন। অনেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তবু মাঝে-মাঝে আমার ঘুম ভেঙে গেলে আমি মোবারকের কথা ভাবি।

প্রকাশ | ০৩ জুন ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ০৩ জুন ২০২২, ১২:২৩

শহীদুল আলম

মোবারক আমার বন্ধু, আমার সহপাঠী। পঞ্চশ শ্রেণি পর্যন্ত আমরা ছিলাম হরিহর আত্মা। সে আমাকে তুই বলে ডাকত। এখন সে শ্রমিক। এখন থেকে ৪৫ বছর আগেও সে বিড়ি টানত। ধূমপানে ছিল তার আনন্দ। ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিল না। দুষ্টুমি এবং দৈহিক সামর্থ্যে সে ছিল আমার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু আজ আমি হাইস্কুলে গেছি, সে যায়নি। ফলে আমি দিনে দিনে এগিয়েছি। আর মোবারক দিনে দিনে পিছিয়েছে। তার বুদ্ধি আধুনিক তথ্যে ভরপুর হয়নি। তাই সে এখন আমাকে আপনি বলে ডাকে। আমি লজ্জা পাই, তবু তাকে বাধা দিতে বাধে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন মোবারক এবং শত বন্ধুর স্মৃতি আমাকে আলোড়িত করত। অবসরে মোবারককে আমার খুবই মনে পড়ত। বৃষ্টি হলেই মনে হতো মোবারক বুঝি আমাকে ডেকে বলবে, 'আলাউদ্দিন চল ভিজতে যাই। চল মাছ ধরতে যাই। হয়তো বলবে, শিল পড়ছে, চল শিল কুড়াই'। কিন্তু মোবারক আসে না। মোবারক আমার বন্ধু কিন্তু সে আমার সামাজিক সঙ্গী নয়। তবু মোবারককে ভালোবাসি, সে আমার পাঠের সঙ্গী, কিশোর কালের সঙ্গী। আমার বন্ধু। ঈদে বাড়ি গেলাম। আমি অনেক বড়। লোকজনে দূর হতে সমীহ করে। কিন্তু মোবারক আসে না। সেমাই-জর্দা রান্না হয়েছে মোবারক এলো না। রাতে মোবারককে খবর দিলাম। মোবারকের ছেলে মোশারেফ এলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। বসতে বললাম। সে বসল না। বললাম 'বাবা কোথায়?' মোশারেফ জবাব দিল না। অনেক পরে বলল 'বাবা অসুস্থ, হাঁটতে পারে না।' বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠল। ডান হাতটা বাম বুকে উঠে গেল। নিঃশ্বাসে কষ্টবোধ হলো। মোশারেফ আমার কেউ না, তবু তাকে জড়িয়ে ধরলাম। মোশারেফ বুছতে পারল না, কেন তাকে আমি ধরতে গেলাম। কেন আমার চোখ দুটো অশ্রম্নস্নাত। মোবারক আমার মতো সুখী জীবন পেতে পারত। মোবারকের স্ত্রী শৌখিন-সৌম্য রমণী হতে পারত। কিন্তু মোরারকের কিছুই যেন পাওয়া হলো না। মোবারক শুধু অসুখ পেল। সুখ পাখি তার উড়ে গেছে দূরে, বহু দূরে। যৌবনপূর্ব সময়েই তার মানবজীবন ছিল। সম্মান ছিল। বড় হয়েই সে দেখেছে অভাব, কর্মহীনতা, অপমান। পিতা-মাতা হতে সে পৃথক অন্নে বাস করছে বহুদিন। পিতাও পিতা থাকেনি, আবার সন্তান হয়েও সে মায়ের কোলে থাকতে পারেনি। মাকে ভাত দিতে পারেনি। মায়ের শাড়ি দিতে পারেনি। শুধু বিয়ের মাধ্যমে পেয়েছে স্ত্রী এবং একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে। তবু মোবারক আমার বন্ধু। সকালে সহধর্মিণীসহ মোবারকের বাড়িতে গেলাম। মোবারক হাসল। বসতে দিতে অস্থির হলো। আমি শুধু চঞ্চল চোখে তার চোখে চোখ রাখলাম। মোবারবকে কিছু টাকা দিতে চাই। কিন্তু কেমন যেন লাগে। তাহ ওঠে না। বন্ধুকে দান করে বড়ত্ব দেখাতে গেলে কতটুকু কষ্ট বোধ হয় সেটা আজ বুঝলাম। তবু মোবারকের টাকাটা দরকার। চিকিৎসার জন্যই দরকার। খাম ভর্তি করাই ছিল। বৌয়ের সামনে দিতে সংকোচ হচ্ছিল মোবারকের সম্মানের কথা ভেবে। তাই ইশারা করাতেই আমার সহধর্মিণী উঠে গিয়ে গ্রামের আকাশ দেখতে থাকল। আমি মোবারকের হাতে একটা খাম গুঁজে দিতে চেষ্টা করলাম। মোবারক আলতো হাতে ধরে রাখলো খামটা। তার মুখ থেকে গরম নিঃশ্বাস বের হলো। একটু হাঁপানির মতো মনে হলো। আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে বললাম, মোবারক আজ আমি। চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করব। মোবারক নীরব হয়ে থাকল। বাস্তব জীবনে যোগ দিতে আমি ফিরে এলাম ঢাকাতে। অনেক কাজ। অনেক ভণিতা নিয়ে জীবন। আধুনিক জীবন। আমার জীবনে এখন বহু দামি বন্ধু এসেছে। তারা দেখতে সুদর্শন। অনেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তবু মাঝে-মাঝে আমার ঘুম ভেঙে গেলে আমি মোবারকের কথা ভাবি। গাড়ি জ্যামে আটকে গেলে ভাবি এখন আমিও একজন মোবারক। তেল পুড়ছে অথচ গাড়ি যাচ্ছে না। যেমন মোবারক বেঁচে আছে অথচ হাঁটতে পারে না। অস্থিরতা শুধু অস্থিরতা কাজ করে আমার মনে। ভাবি এ জীবনে যদি আর কোনো দিন মোবারকের সঙ্গে আমার দেখা না হয় তাহলে অসুস্থ বন্ধুর মুখখানাই বুকের মধ্যে ছবি হয়ে থাকবে। আমি এটা চাইনে। একেবারেই চাইনে। আমি মোবারককে সুস্থ দেখতে চাই। আবার মোবারক নারকেল গাছে উঠে ডাব পেড়ে এনে বলবে, 'আলাউদ্দিন ধর'। আমি সেই ডাবের পানি খাব। আর বুক ভিজে উঠবে ডাবের জলে। তারপর মোবারক বলবে, 'ঠিকমতো খেতেও পারিসনে'। আমি সে রকম একটা নির্জন দুপুরের সন্ধানে হাঁসফাঁস করতে থাকি। তারপর ভেতরে ভেতরে টাকা গোছাই। তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাই। হাতে অনেকগুলো টাকা। গভীর রাতে পেঁৗঁছেছি বলে আর মোবারকের কাছে যেতে পারিনি। আধো ঘুমে আমার ক্লান্ত রাত কেটে যায়। ভোরবেলা উঠেই চলে যাই মোবারকের বাড়ি। মা বলেন, 'আরো একটু ঘুমো। এত কাজে থাকিস! বাড়িতে একটু শান্তিমতো ঘুমিয়ে নে'। কিন্তু আমার ঘুম। আসে না। মায়ের কথায় কোমল একটা শান্তি লাগে। তবু উঠে পড়ি। মোবারকের বাড়ি গিয়ে তার পাশে বসি। মোবারক তাতে কেমন যেন সংকোচবোধ করে। আমি তাকে, 'বন্ধু শুধু তোমার জন্যই এসেছি। চলো ওই গাছের পেয়ারা পেড়ে খাই। চলো নারকেল গাছের নিচে গিয়ে বসি। কথায় কি জাদু ছিল জানি না। মোবারক সত্যি উঠে বসল। তারপর আমাকে ধরে দাঁড়াল। বলল, চল যাই। সত্যি সত্যি মোবারক হাঁটা শুরু করল। তার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী হাঁ হয়ে দেখতে থাকল। কি অবাক কান্ড, যে মানুষ ১২ বছরে হাঁটেনি সে কীভাবে হেঁটে গাছ তলায় এলো। আমিও বিস্মিত। মোবারকের মুখে সুন্দর একটা হাসি। তারপর দুই বন্ধু চলে গেলাম শিশু স্মৃতিতে। মোবারকই বেশি বলছে। আমি শ্রোতা মাত্র। আস্তে আস্তে মোবারক হেঁটে তার স্ত্রীর কাছে এলো। ছেলে মোশারেফের কাছে গেল। ছোট মেয়ের কাছে গেল। কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। তারপর মোবারক আমার হাত ধরে তার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমার সঙ্গে তার আর কোনো কথা হলো না। অনেকক্ষণ বসে থেকে উঠে এলাম বাড়িতে। কিন্তু কিছুতেই মোবারকের মুখখানা ভুলতে পারছিলাম না। তারপর উঠে স্নান ও নাশতা শেষ করে ভাবতে থাকলাম বিষয়টির কীভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে? মোবারক কি সুস্থ হয়ে উঠছে না কি তার জীবন প্রদীপ নিভে যেতে চাইছে? মনটা ভালো লাগল না। আমি বসে থাকলেও আমার মন বসে নেই। মন উড়ে বেড়াচ্ছে স্মৃতির সব পাতা জুড়ে। একটু পরে মোশারেফ এলো। হাতে একটা চিঠি। ভাঙা ভাঙা লেখা নয়। একেবারে ঝকঝকে লেখা, মোবারকের লেখা। আমি চিঠিটা নড়াচাড়া করলাম, দ্রম্নত পড়লাম। টাকার জন্য সে ধন্যবাদ দিয়েছে। তবে শেষ লাইন পড়ে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। মোবারক লিখেছে, 'তুমি আমাকে সুস্থ দেখতে চেয়েছিলে, আমি সুস্থ হয়ে তোমাকে দেখিয়েছি। তোমার ভালোবাসা, তোমার বন্ধুত্ব আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিয়েছে। তাই আমি অসুস্থ শরীর আর কাউকে দেখাতে চাইনে। আমি সুস্থ হয়েই চলে যেতে চাই। তোমাকে ডাব পেড়ে খাওয়াতে পারলাম না। শুধু চোখের জলে তোমার বুকের গেঞ্জিটা ভিজিয়ে দিলাম। কষ্ট রেখ না। তোমার মতো বন্ধু ভাগ্যে কজনে পায়? তুমি আলাউদ্দিন, আমি মোবারক। এর চেয়ে বড় কি আর আছে। কত বড় তুমি! তুমি আমাকে হাত ধরে তুললে। তুমি ঢাকার জ্যামে পড়ে যা ভাব আমি তা টের পাই। তোমার জীবনের জ্যামের সঙ্গে আমার জ্যামের কোনো মিল নেই। তোমার জন্য ট্রাফিক আছে। কিন্তু আমার জ্যাম আর ছাড়বে না। ভালো থেকো। নিজ হাতে একটু মাটি দিয়ে যেও।' আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যেতে চাইলাম। কিন্তু মা একটু থামাল। তারপর দম নিয়ে ধীরে ধীরে মোবারকের বাড়ির কাছে যেতেই মৃতু্য সুরের কান্না শুনতে পেলাম। আমি কতক্ষণ হেঁটেছি তার কথা আর মনে পড়ে না। কিন্তু মনে হয়েছিল যেন আমি বহু যুগ দাঁড়িয়ে আছি। অনেকে এলো। কিন্তু মনে হয়েছিল যেন আমি বহু যুগ দাঁড়িয়ে আছি। অনেকে এলো। মোবারককে গোসল করানো হলো। আমি হাতে মাটি নিয়ে তার কবরের উপরে নরম হাতে ছাড়িয়ে দিলাম আর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলাম শিশিরের মতো অশ্রম্নবিন্দু। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলাম বিন্দু-বিন্দু ভালোবাসা। মোবারক আমার বন্ধু। সে অনেক কিছু পড়েনি। তবে সে পড়েছে আমার মন, পড়েছে আমার হৃৎস্পন্দন। ইতোমধ্যে গেছে কয়েক বছর। হয়তো বেঁচে থাকব আর কিছুকাল। আর খুঁজতে থাকব মোবারককে। যে পড়তে পারতো দূর হতে মনের কথা। পড়তে পারতো মনের গভীরতম আকুতি। কারণ মোবারক আমার বন্ধু ছিল। এমন গল্প হয়তো সবার জীবনেই আছে। বন্ধু আছে, কষ্ট আছে। তাই, আসুন না সবাই একটু সহযোগী হই, বন্ধুকে খুঁজি। শহীদুল আলম :কলাম লেখক