বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

ড. রাশিদ আসকারী
  ১৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৫ আগস্ট ২০২২, ১০:২২

বাঙালি জাতির সহস্র বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু। বস্তুত, একাত্তর-পূর্ব বাঙালি জাতি কখনো প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ছিল না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের অভু্যদয়ের যে-পটভূমি, তাতে সর্বাধিক দায়, দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে পদচারণা একমাত্র বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধু বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম বীর সেনানী; বাষট্টির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ; ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনের ঋত্বিক; ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থানের প্রেরণা-পুরুষ; সত্তরের নির্বাচনের ঈর্ষণীয় বিজেতা; একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক; বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপকার; সর্বোপরি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি এবং সে-কারণেই বাঙালি জাতির জনক, অবিসংবাদিতভাবেই। আমেরিকার যেমন ওয়াশিংটন-লিংকন, রাশিয়ার লেনিন, ইংল্যান্ডের চার্চিল, ফরাসির দ্য গলে, চীনের মাও সে তুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা, আলজেরিয়ার বেনবেলস্না, দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যান্ডেলা, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, বাংলাদেশের তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যথার্থই তিনি বঙ্গবন্ধু। বাংলার বন্ধু। বাঙালির বন্ধু। তাই প্রাণসংশয়ের চরম মুহূর্তেও তার কণ্ঠে উচ্চারিত হতে পেরেছে: 'ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।' সত্যিই তিনি সমগ্র দেশ ও জাতিকে অগ্নিকুন্ডের মুখে ঠেলে দিয়ে কাপুরুষের মতো আত্মগোপন করেননি। বরং দখলদার বাহিনীর আক্রমণের প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছেন ইচ্ছাকৃতভাবেই। মৃতু্যর ঝুঁকি আলিঙ্গন করেছেন হাসিমুখে। নির্ভেজাল ভালোবাসার জারকে জারিত তার দেশপ্রেম তাকে এরকম দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিতে প্রাণিত করেছে। এরপর দীর্ঘ নয় মাসে দেশ ও জাতিকে যেমন সহ্য করতে হয়েছে অমানবিক অত্যাচার সন্তানের লাশ বাবাকে বহন করতে হয়েছে; কন্যা বলাৎকারের পৈশাচিক দৃশ্য স্বচক্ষে দেখতে হয়েছে হাত-পা বাঁধা বাবাকে; স্ত্রীর ওপরে বিজাতীয় পশুর আদিম উলস্নাসকে নির্বিবাদে সহ্য করতে হয়েছে অসহায় স্বামীকে; অবৈধ গর্ভের ভার বয়ে বেড়ানো যুবতীদের অবাঞ্ছিত সন্তানের আগমন-আশঙ্কায় সর্বদা বিপর্যস্ত থাকতে হয়েছে; লাশের ভাগাড়ে শকুনের মেলার নারকীয় দৃশ্য নিত্য দেখতে হয়েছে; তেমনি সেই দীর্ঘ সময়ে রাতদিন শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে পাঞ্জাবের মিলানওয়ালি কারাগারে। কিন্তু কারাগারের সেই বদ্ধ প্রকোষ্ঠেও বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেমে তিলার্ধ পরিমাণ চিড় ধরেনি। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় তাই তিনি আবারও বলতে পেরেছেন : 'বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে।' দেশই ছিল তার কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আর শুধু কথায় নয়, প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়েছেন কী করতে পারেন তিনি স্বদেশের জন্য। আর তা কেবল এক আধবার নয়। অসংখ্যবার। পাথরের দেয়াল এবং লোহার গরাদ অতিক্রম করে একটি স্বাধীন দেশ স্থাপন করেছেন পৃথিবীর মানচিত্রে। তার ৫৫ বছরের জীবনের এক-চতুর্থাংশই কাটিয়েছেন জেলে, প্রায় তেরো বছর যা দিনের হিসাব করলে ৪৬৮২ দিন। ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ছাত্র-প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে কারাভোগ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি কাল কাটান কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে সীমাহীন দুর্ভোগে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে তার কারাজীবনের চিরসমাপ্তি ঘটে। \হগোপালগঞ্জের মিশন স্কুলপড়ুয়া সেই কিশোর ছেলেটি যেদিন স্কুলের প্রধান ফটকে হক-সোহরাওয়ার্দীর (আবুল কাসেম ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন, নিঃশঙ্কচিত্তে জানিয়েছিলেন তার দাবি, সেদিন তার ভেতর যে নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতার স্ফুরণ দেখা গিয়েছিল, তা-ই সেদিনকার সেই অকুতোভয় মুজিবকে পরবর্তী সময়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। আর সেই মহান নেতা দীর্ঘপ্রতীক্ষিত জাতিকে উপহার দিলেন পরম কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, দিলেন একটি ভূখন্ড একটি পতাকা, একটি জাতীয় সংগীত। টুঙ্গিপাড়ার দামাল ছেলেদের নিয়ে গড়ে তোলা সেদিনের সেই খুদে সংগঠনের খুদে স্থপতি হয়ে উঠলেন একটি দেশের স্থপতি। নির্মাণ করলেন পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি স্বাধীন দেশ। যার নাম তিনি নিজেই রেখেছেন বাংলাদেশ। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃতু্যবার্ষিকীতে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন : 'এই ভূখন্ডটির নাম হবে বাংলাদেশ।' আর তখন থেকেই মূলত 'বাংলাদেশ' নামের রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন হয়েছিল। বস্তুত, বাংলাদেশ সৃষ্টির এক রাজনৈতিক ভিশন নিয়েই বঙ্গবন্ধু কাজ করে গেছেন তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে। তার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বই ভিতু বাঙালিদের অদম্য সাহসী মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত করেছে; বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে তারা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছে; যার যা ছিল তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবিলা করেছে; সেবারের সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামে, মুক্তির সংগ্রামে পর্যবসিত করেছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। একটি রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা। আমাদের পরম আরাধ্য স্বাধীনতা এবং কাঙ্ক্ষিত বিজয় একটি সর্বাত্মক সশস্ত্র বিপস্নবের প্রসূন। সংগ্রামের চালিকাশক্তি হলো নেতা। বিপস্নবের প্রাণস্পন্দন নেতৃত্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল শক্তি ছিল একটি সফল নেতৃত্ব। কিন্তু প্রশ্ন হলো- কে সেই নেতা, যার নেতৃত্বে ২০০ বছরের হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধৃত হয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাস অন্নেষা আর সহস্র উপাত্তের আলোয় উত্তর মেলে : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হলেন আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই মহাকাব্যিক নেতা। এই ঐতিহাসিক স্বতঃসিদ্ধের বিপরীতেও ইতিহাসের ভিন্নপাঠ প্রদানের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের খলনায়ক এবং তাদের ভাড়াটে পন্ডিতরা। এ সবের মূল কারণ হলো আগস্ট ট্র্যাজেডি। একটি কাপুরুষোচিত হত্যাকান্ডের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বিপস্নবের মহান নেতাকে হত্যা করে। এরপর তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য অনেক রাজনৈতিক গিমিক তৈরি করে। ইতিহাসের এক কাকতালীয় তত্ত্ব দিয়ে ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা জনৈক মেজরকে বঙ্গবন্ধুর জুতো পরানোর চেষ্টা চালানো হয়। এই প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিটি অত্যন্ত হাস্যকর ও নির্লজ্জভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব অপাত্রে দান করতে চায়। ফলে তারা জন্ম দেয় বঙ্গবন্ধু বিদূষণের রাজনীতি। অন্যদিকে আরেক দল বঙ্গবন্ধুকে দলীয় সম্পত্তি ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এভাবে রাজনৈতিক স্বার্থবুদ্ধি এবং আদর্শিক টানাপড়েন বঙ্গবন্ধুর সর্বজনীন মহিমা অনেকখানিই ক্ষুণ্ন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা লড়াই করেছেন তাদের মধ্যে সফলতম হলেন বঙ্গবন্ধু। ২৪ বছরের পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে যখন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ঐক্যবদ্ধ, যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, ঠিক তখনই তাদের রাজনৈতিক মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন তাদের সমবেত রাজনৈতিক ইচ্ছার : এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু একদেশ মানুষের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মুক্তির দিকদর্শন দিয়েছেন, গোলামির নাগপাশ থেকে মুক্ত করেছেন। তাই তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি ক্ষুদিরাম-মাস্টারদাদের যোগ্যতম উত্তরাধিকারী। তাকে কোনোমতেই ক্ষুদ্রতর দলীয় বলয়ে বিবেচনা করা ঠিক নয়। তিনি ছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কণ্ঠস্বর। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাপাগল বাঙালি জাতির 'বাতিঘর'। বাংলাদেশের অভু্যদয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু উপাখ্যান এমনভাবে মিশে আছে যে বাংলা-বাঙালি-বঙ্গবন্ধু বলা চলে একই সমন্তরালে। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন দরকার ঠিক সেইভাবেই। বঙ্গবন্ধু বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক। যখন জানতে পারি তার ওপর ফ্যাসিস্ট আইয়ুব-ইয়াহিয়া সরকারের জেল-জুলুম আর অত্যাচারের কাহিনী; জানতে পারি তার প্রতিরোধের বীরগাথার সেই ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণ-অভু্যত্থান, অসহযোগ, সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জনসমর্থন; যখন শুনতে পাই একাত্তরের ৭ মার্চের সেই বজ্রকণ্ঠ হুঙ্কার-- 'আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকেদের হত্যা করা হয়'; তখন বাংলার ইতিহাসে, বাঙালির ইতিহাসে তার প্রকৃত মহিমা প্রকাশ পায়। স্বাধীনতার এই মহানায়ককেও হত্যা করতে কুণ্ঠিত হয়নি নরঘাতকরা। সত্যিই হিসাব মেলা ভার। ২০০ বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে জীবন্ত কিংবদন্তির মহানায়ক হলেন যিনি; সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র সাড়ে তিন বছরেই তাকে হত্যা করা হলো। নিদারুণ নৃশংসয়তায়, সপরিবারে। অসহায় শিশুপুত্রটিও রেহাই পেল না সেই পৈশাচিক বর্বরতা থেকে। জাতির পিতার এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ড তাই আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মন্তুদ অধ্যায়। এই শোক এত গভীর ও মর্মস্পর্শী যে, এর স্মৃতি মনে হলে আমাদের স্বাধীনতা কিংবা বিজয়ের সব গৌরব ম্স্নান হয়ে আসে। বারবার মনে হয়, যে-দেশে স্বাধীনতার স্রষ্টাকে হত্যা করা হয়েছে, সে-দেশের স্বাধীনতার মূল্য কী? বঙ্গবন্ধু অমর, অজর, অবিনাশী। ঘৃণ্য ঘাতকের কটি তপ্ত বুলেট তার নশ্বর দেহকে শেষ করে দিতে পারে; কিন্তু তার কীর্তি অবিনশ্বর। তার আদর্শ অম্স্নান। তার নবজাগরণ অনিবার্য। আজ জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে সেই জাগরণের জোয়ারে পস্নাবিত করতে হবে বাংলাদেশের সাধারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। বঙ্গবন্ধু আমাদের রাজনৈতিক মানস বিনির্মাণের প্রেরণাপুরুষ। রাজনৈতিক ভাবাদর্শে দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ইহজাগতিকতার প্রেরণা আমরা পাব বঙ্গবন্ধুর কাছে। বঙ্গবন্ধুই হতে পারেন আজকের বহুধা-বিভক্ত সমাজে সংহতির সেতু। 'বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ' এক ও অভিন্ন সত্তা। বঙ্গবন্ধুকে বিয়োগ করে বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবা দুঃস্বপ্ন। লেখক : বাংলা-ইংরেজি লেখক, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং প্রাক্তন উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে