'শুভ জন্মদিন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়' 

প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০২২, ২১:২৭

কামরুল হাসান কামু

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কৃষি শিক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এবং বাংলাদেশের প্রথম উচ্চতর কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার প্রবাদপ্রতিম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রহ্মপুত্রের কোলজুড়ে এক নৈসর্গিক পরিবেশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতিকন্যা খ্যাত এই কৃষি শিক্ষার মাতৃপীঠ। বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রকৃতির নানান রূপ এখানে দেখা যায়।এখানকার শীতের প্রকৃতির কাছে বড় ঋণী হয়ে গেছি। শীতের পরিযায়ী পাখির মতো যদি কোনো অতিথি বেড়াতে আসেন এই ক্যাম্পাসে, ব্রহ্মপুত্রের জলছোঁয়া শীতের হিমেল হাওয়ায় তিনিও মুগ্ধ হয়ে পড়বেন। ক্যাম্পাসে ঢোকার পথেই রয়েছে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছ। এই পথ ধরে এগুলেই একসময় দেখা যাবে ক্যাম্পাসের ভেতরের ছোট ছোট রাস্তাগুলোর পাশে থাকা শীতের নানা ফুল। সন্ধ্যার পর হলগুলোর সামনেই পাওয়া যায় শীতের ধোঁয়া ওঠা পিঠার দোকান। প্রতিটি সকালে কুয়াশার তাঁবু ভেদ করে সূর্যের আলো এসে পড়লে, রূপালি ঝিলিকে হেসে ওঠে এই ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাস আর বৃক্ষের উজ্জ্বল সব বাহারি মুখ। বোটানিক্যাল গার্ডেনজুড়ে পাওয়া যাবে শীতের নানা রঙের ফুল, প্রজাপতি আর পাখি। বিভিন্ন স্থাপনার পাশে রয়েছে সবুজ ঘাসে কমলারঙা সূর্যের আলো। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বালিহাঁস আর পানকৌড়ির উদাসি ওড়াওড়ি, অদূরের সবুজ গ্রামটি, ঠিক মাছরাঙা নীল আকাশের নিচেই ঝকঝক করে। এই নদে নৌকায় ঘুরে ঘুরে আপনিও নিমেষেই স্বাদ নিতে পারবেন জীবনানন্দ দাসের সেই রূপসি বাংলার।

শাহ্জালাল হলের সামনের লেকের চারপাশের রয়েছে সারি সারি গাছ। দেখা যাবে শীতের অতিথি পাখিদের। ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের পথ ধরে আপনিও ভাগাভাগি করে নিতে পারেন শীতের প্রকৃতির নির্জন স্নিগ্ধতা। গবেষণার জন্য থাকা বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলিমাঠ, যেখানে শীতের ফসলি ফুল আপনাকে মুগ্ধ করবে। একটি নির্মল ভোরের কাছে হাজার বছরের গ্রামীণ সুখ পেতে, শহরের যান্ত্রিক জীবন ছেড়ে যে কেউ আসতে পারেন আমাদের এই সবুজ ক্যাম্পাসে। রয়েছে ফুলের মাঠ, যেখানে পাওয়া যাবে নানা রঙের গোলাপ থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের ফুল। শীতের প্রথম সকালে এ বাগানে দেখা যাবে রঙবেরঙের প্রজাপতি। ভাবতে পারছেন এ কেমন নৈসর্গিক দৃশ্য! তাই কবি জীবনানন্দ দাসের মতোই গর্ব করে বলতে ইচ্ছে করে,/ 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,/তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর'

বাকৃবির অগণন বৃক্ষের উজ্জ্বল বাহারিয়া দৃশ্য আর বিস্তৃত মাঠ জুড়ে সবুজঘাসের স্নিগ্ধতা, শহুরের ক্লান্ত প্রাণকে এক স্বর্গীয় অনুভবে মাতাবে বিশেষ করে শীতের রঙ-বেরঙের ফুলের সৌন্দর্য বুকের ভেতর নৈসর্গিক সুখের জন্ম দেয়। চিরসবুজ এই ক্যাম্পাসের ভেতরের রেললাইনের দুইপাশ জুড়ে সারি সারি বৃক্ষ দেখলে মনে হয় যেন কোন অনন্ত কালের সবুজবৃক্ষের সুরঙ্গ, যে পথে প্রিয় মানুষটির হাত ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করবে যে কারো। পিচঢালা পথের দুপাশে সারি সারি আমগাছ আমাকে মোহিত করেছে বার বার। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ ফলদ বৃক্ষের জার্মপ্লাজম সেন্টার আর ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষা বোটানিক্যাল গার্ডেনের নানাবিধ গাছ, ফুল ও বর্ণিল প্রজাপতির সৌন্দর্য আমার মানসপটে রঙ খেলবে আমৃত্যু। যতোদূরেই যাই না কেনো বসন্তের লাল-হলুদ কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষ আচ্ছাদিত বাকৃবির পথ আমাকে আহ্বান করবে প্রিয়বন্ধুর মতো।

শুধু নৈসর্গিক সৌন্দর্য-ই নয়, ৬১ বছর চলার পথে দুর্যোগ-দুর্বিপাকে দেশের মানুষের পাশে থেকেছে বীরদর্পে। একসময় দেশের মানুষের খাদ্য সংকট ছিলো, একফসলি জমি ছিলো। সেই সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে দেশকে অবিশ্বাস্য সাফল্য এনে দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেশের নানানপ্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার কৃষিবিদ যাদের তৈরি করেছে এই কৃষি শিক্ষার মাতৃসম বিদ্যাপীঠ। 

১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। ভেটেরিনারি ও কৃষি অনুষদ নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো। 

গবেষণার ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এক কিংবদন্তীতুল্য প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ চলার পথে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অনেক শস্যের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এগুলোর মধ্যে বাউধান-৬৩, বাউধান-২, নামে উফশী ধান জাত-সম্পদ ও সম্বল, বাউ-এম/৩৯৫, বাউ-এম/৩৯৬ নামে ৪টি উফসি সরিষা জাত, ডেভিস, ব্র্যাগ, সোহাগ, জি-২ ও বিএস-৪ নামে ৫টি সয়াবিন জাত, কমলা সুন্দরী ও তৃপ্তি নামে আলুর জাত, লতিরাজ, বিলাসী ও দৌলতপুরী নামে তিনটি মুখীকচুর জাত, বাউকুল নামক বরই, কলা ও আনারস উৎপাদনের উন্নত প্রযুক্তি, রাইজোবিয়াম জৈব সার উৎপাদন প্রযুক্তি, সয়েল টেস্টিং কিট, পেয়ারা গাছের মড়ক নিবারণ পদ্ধতি, বীজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সহজ পদ্ধতি, অ্যারোবিক পদ্ধতিতে ধান চাষ প্রযুক্তি, শুকানো পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ, পশু খাদ্য হিসেবে ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধির কলাকৌশল। আফ্রিকান ধৈঞ্চার অঙ্গজ প্রজনন, এলামনডা ট্যাবলেট, আইপিএম ল্যাব বায়োপেস্টিসাইড, বিলুপ্তপ্রায় শাকসবজি ও ফলের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ ও মলিকুলার বৈশিষ্ট্য সনাক্তকরণ কলাকৌশল, মোরগ-মুরগির রাণীক্ষেত রোগ ও ফাউলপক্সের প্রতিষেধক টিকা উৎপাদন, হাঁসের পেগ ভ্যাকসিন ও হাঁস-মুরগির ফাউল কলেরার ভ্যাকসিন তৈরি, রাণীক্ষেত রোগ সহজেই সনাক্তকরণে মলিকুলার পদ্ধতির উদ্ভাবন, মুরগির স্যালমোনোসিস রোগ নির্ণয় প্রযুক্তি; হাওর এলাকায় হাঁস পালনের কলাকৌশল, কমিউনিটি ভিত্তিক উৎপাদনমুখী ভেটেরিনারি সেবা, গবাদিপশুর ভ্রুণ প্রতিস্থাপন, ছাগল ও মহিষের কৃত্রিম প্রজনন, কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহৃত ষাঁড়ের আগাম ফার্টিলিটি নির্ণয়, গাভীর উলানফোলা রোগ প্রতিরোধ কৌশল, হরমোন পরীক্ষার মাধ্যমে গরু ও মহিষের গর্ভ নির্ণয়, সুষম পোল্ট্রি খাদ্য, গো-খাদ্য হিসেবে খড়ের সঙ্গে ইউরিয়া-মোলাসেস বক ব্যবহার, হাঁস-মুরগির উন্নত জাত উৎপাদন, কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন অনুসন্ধানী গবেষণা তৎপরতার মাধ্যমে টেকসই শস্যবীমা কার্যক্রম, ক্ষুদ্র সেচ কার্যক্রমের উন্নয়ন, পশুসম্পদ উপখাত ও ডেইরি উৎপাদনের উন্নয়ন, স্বল্প ব্যয়ে সেচনালা তৈরি, উন্নত ধরনের লাঙ্গল ও স্প্রে মেশিন, বাকৃবি জিয়া সার-বীজ ছিটানো যন্ত্র, সোলার ড্রায়ার, উন্নত ধরনের হস্তচালিত টিউবওয়েল পাম্প, জ্বালানি সাশ্রয়ী উন্নতমানের দেশি চুলা, মাগুর ও শিং মাছের কৃত্রিম প্রজননের কলাকৌশল, ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি, খাচায় পাঙ্গাস চাষ, পেরিফাইটন বেজড মৎস্যচাষ, দেশি পাঙ্গাসের কৃত্রিম প্রজনন, ডাকউইড দিয়ে মিশ্র মৎস্যচাষ, মাছের জীবন্ত খাদ্য হিসেবে টিউবিফিসিড উৎপাদনের কলাকৌশল, পুকুরে মাগুর চাষের উপযোগী সহজলভ্য মৎস্যখাদ্য তৈরি, শুক্রাণু ক্রয়োপ্রিজারভেশন প্রযুক্তি, স্বল্প ব্যয়-মিডিয়ামে ক্লোরেলার চাষ, মাছের পোনা পালনের জন্য রটিফারের চাষ, মাছের রোগ প্রতিরোধকল্পে ঔষধি গাছের ব্যবহার এবং মলিকুলার পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছের বংশ পরিক্রম নির্ণয়, তারাবাইম, গুচিবাইম, বাটা মাছের কৃত্রিম প্রজনন, ধানক্ষেতে মাছ ও চিংড়ি চাষ, পুকুরে মাছ চাষ, সহজলভ্য মাছের খাদ্য তৈরি, একোয়াপনিক্সের মাধ্যমে মাছ এবং সবজি উৎপাদন, মাছের বিকল্প খাদ্যের জন্য বাক সোলজার ফ্লাই চাষ এবং কচি গমের পাউডার উৎপাদন সহ ইলিশ মাছের জীবনরহস্য উন্মোচনে যুগান্তকারী সাফল্য নিয়ে এসেছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ১৯৮৪ সালের ৩০ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা হয় যার মাধ্যমে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৯২২ টি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে এবং বর্তমানে ৫২৭ টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণ কেন্দ্র। 

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি ইনস্টিটিউট ফর ফুড সিকিউরিটি, ইনস্টিটিউট অব এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, ভেটেরিনারি ক্লিনিক, দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, উপমহাদেশের প্রথম মৎস্য জাদুঘর এবং প্রায় সাড়ে চার হাজার বৃক্ষসমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন রয়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট ছয়টি অনুষদ ও দুটি ইন্সটিটিউটের আওতায় ৪৪টি বিভাগের মাধ্যমে শিক্ষা ও গবেষণার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৫৬০ শিক্ষার্থীকে ডিগ্রি দিয়েছে। এর মধ্যে স্নাতক ৩০ হাজার ৭৬৪ জন, স্নাতকোত্তর ২২ হাজার ৯৭৪ জন এবং পিএইচডি ৮২২ জন। বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সাত হাজার ১৩২ জন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের জন্য ১৪ টি আবাসিক হল রয়েছে। 

কৃষি ভিত্তিক এই দেশের উন্নয়নে কাজ করছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত কৃষিবিদ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি। দেশের মানুষের পাশে ভবিষ্যৎ কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মাতৃসম বিদ্যাপীঠের গবেষণা অব্যাহত থাকুক। 

লেখক-
কামরুল হাসান কামু,
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা
ফুলপুর, ময়মনসিংহ
সাবেক শিক্ষার্থী, বাকৃবি।
ইমেইলঃ [email protected]