সপ্তাহ দুয়েক আগে দৈনিক একটি কাগজে দেখলাম- দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) মূল্যায়ন করেছে।ছয়টি কৌশলগত উদ্দেশ্য ও ধাপসমূহ পর্যবেক্ষণে বাউবি’র অবস্থান চতুর্থ। এর আগে এবং পরে রয়েছে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদ্যাঙ্গণসহ উচ্চমানের নানা ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয়। বাউবি ১৬ ধাপ এগিয়ে চতুর্থ এখন। একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ও এগিয়ে যাবার জন্য এ ধরনের মূল্যায়ন প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কেন একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ টানছি?
ভারত স্বাধীনের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহার লাল নেহেরু বলেছিলেন- ‘একটি দেশ আত্মমর্যাদাশীল ও সম্বৃদ্ধ হয় যদি তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানে গবেষণায় নিবিষ্ট ও সুশৃংখল থাকে।’ মূলত; বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটি অপরিসীম, বিস্তৃত ও ব্যাপক। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য, আর্ট, কলা, সামাজিক ও বিজ্ঞানের বিস্তৃত বিষয়াদি এক কথায় সব কিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। গবেষণা, একাডেমিক ডিসকোর্স ও নতুন জ্ঞান উৎপাদনে বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় অগ্রগামী। বিশ্ব ইতিহাসে ৮৫৭-৮৫৯ সালে প্রথম মরক্কোতে আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগে দর্শন, আইন, চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে মোডেনা, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। তবে, শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধর্মশাস্ত্রালয় হিসেবে পরিচিত ছিলো।
ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার শুরু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর পরই। ১৮৫৭ সালের পর ভারতের বড় লাট লর্ড ক্যানিং ‘দ্যা অ্যাক্ট অফ ইনকরপোরেশন’ পাস করে কোলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগেও ভারত বর্ষে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় হুবহু ইউরোপীয় মডেলে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। যার ৯টি ছিল পূর্ব বাংলায়। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ভূ-আঞ্চলিক ষড়যন্ত্রসহ নানা প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে ১৯২১ সালের ১ জুলাই এই ভূ-খন্ডে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এপার বাংলার জাতিসত্তা, অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে। ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয় এখানে। অবশ্য, দীর্ঘ এই ৫০ বছরে পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় আরো পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। দেশ মাতৃকার চরম দুঃসময়ে এই জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছেন এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। লক্ষ্য ছিলো ক্ষুধা, দারিদ্র, শোষণা বঞ্চনা, শিক্ষার সুযোগ, চাকুরী নিশ্চয়তার। দেশ স্বাধীনের পর অসংখ্য সংকটের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। শিক্ষা সুযোগ সেগুলোর অন্যতম একটি। আশি- নব্বইয়ের দিকে প্রান্তিক পর্যায়ে অবহেলিত, দরিদ্র, সুযোগ বঞ্চিত সব বয়সের মানুষের শিক্ষা বিতরণের তাগিদ জোড়ালোভাবে অনুভূত হয়। এরপর ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর জন্ম নেয় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। আজ বাউবির জন্মদিন। জন্মদিনে প্রত্যেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সুন্দরগুণের প্রশংসা, আগামীর জন্য উৎসাহ, উদ্দীপনা বা প্রিয় উপহার দিতে ভালবাসি।
উন্নত বিশে^ দূরশিক্ষণ শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে প্রসার পেতে একটু সময় লেগেছে। মূলত সময়ের চাহিদার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। শিক্ষার উপকরণ ও অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালিত এই শিক্ষা ব্যবস্থা শ্রেণী কক্ষে বা পরীক্ষা হলে উপস্থিত না হয়ে ঘরে বসে সুবিধামতো এ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। একটি বিশেষ শ্রেনী বা গোষ্ঠি এবং সুবিধা বঞ্চিতদের নিয়ে শুরুতে কাজ করতো বাউবি। গত ত্রিশ বছরের পথ চলায় এই প্রেক্ষাপট পাল্টেছে। বাউবি এখন বেশ জনপ্রিয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশে আঞ্চলিক কেন্দ্র ও উপ আঞ্চলিক কেন্দ্রে বিভক্ত হয়ে ৬৪টি জেলা ও ৮০ উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং ১৬০০ টি স্টাডি সেন্টারের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম বিতরণ করে যাচ্ছে। অনার্স, মাস্টার্সের প্রোগামও হাতে নিয়েছে। তবে, ত্রিশ বছরের পুরোনা একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রত্যাশা আমার অনেক। ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি পোস্ট-ডক্টরাল রিচার্চ ফেলো তখন সেখানকার ওপেন ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। সে সময় এটা ডিসটেন্স স্কুল নামে পরিচিত ছিলো। কয়েক বছর আগে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েও যাই। তাদের স্প্রিড, পড়ালেখার মান ও বাস্তব উপযোগিতা চোখে পড়ার মতো। তাদের সাথে বাউবি’র বেশ ফারাক লক্ষ্য করি।
বাউবির জন্ম-ই হয়েছে ডিসটেন্স এডুকেশনকে কেন্দ্র করে। করোনাকালে প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে সবাই যখন অনলাইন ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষায় ঝুঁকেছে তখনও বাউবি চালিয়ে গেছে অনলাইনের পাশাপাশি প্রোগাম ও সিলেবাসভিত্তিক এসডি কার্ড ও বাউটিউবসহ শিক্ষা কার্যক্রম। বাউবি বাংলাদেশে দূরশিক্ষণের অগ্রদূত, দিশারী। বাউবির আছে আধুনিকমানের সবোর্চ্চ শক্তিশালী আইসিটি ইউনিট, ই-লার্নিং সেন্টার, কম্পিউটার ডিভিশন, বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা ও দক্ষ কর্মী বাহিনী। আজকে যারা দূরশিক্ষণ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের সবাই এক সময় বাউবি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বাউবির আছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন আইটি ও পাওয়ার স্টেশন, সম্বৃদ্ধশালী টেলিভিশন সেন্টার, নিজস্ব রেডিও সেন্টার, ওপেন টিভিসহ আরো অনেক কিছু।
ছোট্ট একটি ক্যাম্পাস অথচ নান্দনিকতায় ভরপুর। পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিনন্দন ভবন, পরিপাটি বিপুল গ্রন্থের সমাহারে গবেষণার উপযোগী গ্রন্থাগারও আছে। সম্প্রতি বেশ কিছু দেশে স্টাডি সেন্টার খুলেছে বাউবি। প্রবাসে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক প্রোগাম চালু শিক্ষার প্রসারে ভাল ভূমিকা রাখবে। তবে, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আমার বেশ কিছু পরামর্শ আছে। ওগুলো আরেকদিন বলা যাবে।
কিছুদিন আগে অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন বাউবি’র উপাচার্য হিসেবে। ১৯৯৮-২০০২ পর্যন্ত যখন আমি কম্পিউটার এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট তখন ড. হুমায়ুন আমার সাথে ছিলেন। তিনি খুব মেধাবী, এলিট এবং দক্ষ। এপিএ’র সাফল্যের মধ্য দিয়ে সেই স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন। অর্থাৎ মাটির গভীরের মতো বাউবিতেও যে হিডেন পাওয়ার আছে সেটিকে তিনি আবিস্কার করে তার সঠিক ব্যবহার করতে পেরেছেন। যার দরুন, ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সম্মানিত অবস্থানে বাউবি। অতিতের নানা অভিজ্ঞতা, বর্তমানের তারুণ্য শক্তি আর আগামীর স্বপ্ন বাউবিকে নতুন মাত্রা দিবে- এটা আমার বিশ্বাস। সব প্রতিবন্ধকতা ছাপিয়ে বাউবি আজ ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করতে যাচ্ছে। বাউবির জন্য শুভ কামনা।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল, সাবেক উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
যাযাদি/সোহেল