আলো ছড়াচ্ছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়

প্রকাশ | ০১ মার্চ ২০২৩, ১৪:৩৬

মাসুম পারভেজ

স্বাধীনতার ৫১ বছর পর রাজধানীর কেরানীগঞ্জে জনবিচ্ছিন পাঁচ গ্রামের শিক্ষার্থীরা পেল একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। উপজেলার ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষে কলাতিয়া ও হযরতপুর ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামে এতোদিন ছিল না কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়। চর চামারদহ, চর খাড়াকান্দি, হোগলাগাতি, মধুরচর ও দক্ষিণ ঢালিকান্দি গ্রামে দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও স্বাধীনতার ৫১ বছরেও ছিল না কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা ডা. নুর মোহাম্মদের নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় করা হয়েছে। 

গত ১ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ তাঁর বাবা বীরমুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদের স্মৃতিতে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। নিজ অর্থায়নে পাঁচ বিঘা জমি কিনে টিনশেডের বিদ্যালয়টি নির্মাণ করেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। স্থানীয়রা বলেন, গ্রামের কাছাকাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে অনেক শিক্ষার্থী অকালে ঝড়ে পড়তো। প্রাথমিকের পর গ্রামের যেসব শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতো তাদের ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে নৌকাযোগে চারপাঁচ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়ে যেতো হতো তালেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ও নবাবগঞ্জের নয়াকান্দা হামিদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এছাড়া এখানে ভোটার সংখ্যা চার হাজারের অধিক। চরাঞ্চল এসব এলাকায় বাল্যবিয়ের প্রবণতাও বেশি। প্রাথমিকের গন্ডি পেরুলেই এখানকার মেয়েদের বিয়ের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। তারা বলেন, এই বিদ্যালয়ের ফলে সরাসরি উপকৃত হবেন তারা। তাদের সন্তানদের এখন থেকে আর ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে ধলেশ্বরী নদী পাড়ি দিয়ে স্কুল পর্যায়ে অন্যত্র পড়তে যেতে হবে না।

সরজমিনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার হোগলাগাতি চর এলাকায় ৫ বিঘা জায়গার ওপর প্রাথমিকভাবে টিনশেডে সবুজ রঙে সজ্জিত ৭টি শ্রেণিকক্ষ ও একটি অফিস রুম নিয়ে স্কুলটি যাত্রা শুরু করেছে। এখানে শিক্ষক রয়েছেন ১০ জন। অফিস রুমে চলছে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম। এসময় অভিভাবক সামসুর নাহার জুলি বলেন, এ নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমার মেয়ে সুমাইয়া আক্তারকে ষষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি করিয়েছি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পাশ করার পর মেয়েরে নিয়া অনেক চিন্তায় ছিলাম। বাড়ির কাছে কোনো হাইস্কুল ছিলো না। এখন বাড়ির কাছে স্কুল হইছে আমাদের চেয়ারম্যানের জন্য, একারণে আমরা পাঁচ গ্রামের মানুষ খুব খুশি। বীরমুক্তিযোদ্ধা ডা. নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবাইয়াদা বলেন, আমি এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছি। বিদ্যালয় থেকে নতুন বইও পেয়েছি। নতুন চেয়ার বেঞ্চে বসে পড়াশোনা করতে পারছি। এজন্যে অনেক খুশি লাগছে। আমাকে কষ্ট করে নদী পার হয়ে দূরে পড়তে যেতে হবে না। গ্রামে বিদ্যালয় হওয়ায় আমাদের কষ্ট দূর হয়েছে। প্রতিদিন নিয়মিত জাতীয় সংগীত গাওয়া ও অ্যাসেম্বলি হয়। স্কুল প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ইংরেজি শেখানোর জন্য শিক্ষকেরা তাদের উদ্বুদ্ধ করে আসছেন বলে রুবাইয়াদা জানান। উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে এ এলাকার কলেজ শিক্ষার্থী মোহন হাসান বলেন, আমাদের সময়ে গ্রামে কোন হাইস্কুল ছিলো না। ধলেশ্বরী নদী নৌকা পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হতো অন্য ইউনিয়নের স্কুলে। অনেক সময় কয়েকঘন্টার সড়ক পথ দিয়ে হেঁটে পড়তে যেতাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় আমাদের জন্যে আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে অনেকে পড়াশোনা করতে উৎসাহিত হবে। কমে যাবে ঝড়েপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। দূর্গম এলাকায় স্কুলটি পেয়ে আমাদের বাঁধ ভাঙা খুশি উপলব্ধি হচ্ছে। অবশেষে আমাদের গ্রামের শিক্ষার্থীদের কষ্টের অবসান হয়েছে। চর চামারদহ গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলার একটি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষক ইমরান পারভেজ বলেন, আমাদের এলাকায় পঞ্চম শ্রেণীর পরেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হতো। কাছাকাছি কোন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় অভিভবকেরা তাদের সন্তানদের দুরের স্কুলে পাঠাতে ভয় পেতো। এখানে হাই স্কুল হওয়াতে আমাদের সন্তানেরা এখন মাধ্যমিকের পড়াশোনা নিজ এলাকাতেই করতে পারবে। চর চামারদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহিদা খাতুন জানান, আমার স্কুলে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৪৫ জন। প্রাথমিক শেষে এসব শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিকে পড়াশোনা নিয়ে আগে যে শঙ্কা ছিলো তা দূর করবে নবনির্মিত এই মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

বিদ্যালয়টিকে আধুনিক মানসম্মত বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানিয়ে বীরমুক্তিযোদ্ধা ডা. নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবিদ হোসেন জানান, গত ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ১০ জন। বিদ্যালয়টিতে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান দেওয়া হবে হচ্ছে। তিনি বলেন, কলাতিয়া ও হযরতপুর ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামে প্রায় ১৫ হাজার মানুষের বসবাস। গ্রামগুলোতে দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও স্বাধীনতার ৫১ বছর ধরে ছিলো না কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিচ্ছিন্ন এই গ্রামগুলোতে আলো ছড়াচ্ছে একমাত্র মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়’। বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য একটা সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য দু’টি ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের মানুষ অনেক উপকৃত হয়েছে। কারণ এখানকার বেশিরভাগ মানুষই হতদরিদ্র। রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ কিছুই ছিলো না। এখন সেই অবস্থা নেই। নিজেদের অর্থায়নে এসব মাদ্রাসা, স্কুল, এতিমখানা, মসজিদ, বালিকা বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করেন তারা। গ্রামের মানুষ বিনামূল্যে এসব সেবা পায়। এছাড়া তারা সবসময়েই সাধারণ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। 

উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, কেরানীগঞ্জের ছিটমহল বলে খ্যাত ৫টি গ্রামের দু’শ থেকে ২৫০ শিক্ষার্থীকে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধলেশ্বরী নদী পাড়ি দিয়ে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া উচ্চবিদ্যালয় ও তালেপুর উচ্চবিদ্যালয়ে যেতে হতো। স্বাধীনতার পর এখানে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। তাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে পাঁচ বিঘা জমি কিনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। এতে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পাঁচ গ্রামের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থীরা যাতে ঝরে না পড়ে, সে জন্য এ উদ্যোগ।

যাযাদি/ এস