আন্তর্জাতিক ধরিত্রী দিবস: প্লাস্টিকের পৃথিবী ও মানুষের অস্তিত্ব

প্রকাশ | ২১ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:৪৩

যাযাদি ডেস্ক

পৃথিবীর  উপরিভাগের তিন চতুর্থাংশই পানিতে ঢাকা যা আছে হিমবাহ, জলাভূমি, লেক, নদী, সাগর কিংবা মহাসাগরের আকারে।তবে বিশ্বের পানির ৯৭ ভাগই মহাসাগরের লবণাক্ত পানি। মহাবিশ্বে পৃথিবী একমাত্র নভোমণ্ডলীয় স্থান, যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। 

পৃথিবীতে তালিকাভুক্ত প্রাণির প্রজাতির সংখ্যা এখন ১২ লাখ।যদিও এটিকে মোট প্রাণির একটি সামান্য অংশ বলে মনে করা হয়।২০১১ সালে বিজ্ঞানীরা ধারণা দিয়েছিলেন যে প্রাকৃতিক বিশ্বে সর্বমোট প্রায় ৮৭ লাখ প্রজাতি আছে। এই পৃথিবীর গঠন হয়েছিলো প্রায় চার দশমিক পাঁচ বিলিয়ন বছর আগে এবং এর সম্পদ, ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস ও এর কক্ষপথের কারণেই এখানে লাখ লাখ বছর ধরে প্রাণের অস্তিত্ব টিকে আছে।

এই ধরিত্রী মায়ের মতই তার সন্তান মানুষদের পরম মমতা, আদর,যত্নে ও স্নেহে লালনপালন করেন। বায়ু, মাটি, জল দিয়ে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করছে কে ধরিত্রী। অনেকটা আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ এর মত। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সবকিছু দান করে বদান্যতা ও উদারতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন। মাতৃতুল্য পৃথিবী মানুষের জন্য এত কিছু করার পরও মায়ের জন্য মানুষ আমরা কি করেছি বা করছি? যদি বলি মায়ের এত আদর পেয়েও মাকে আদর যত্ন না করে উল্টো অবজ্ঞা, অবহেলা ও নির্বিচারে ক্ষতি করছি।

মাতৃতুল্য পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে ২২ এপ্রিল ধরিত্রী দিবস প্রতিবছর উদযাপিত হচ্ছে। সর্বপ্রথম ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে দিবসটি পালিত হয়, এবং বর্তমানে আর্থ ডে নেটওয়ার্ক কর্তৃক বিশ্বব্যাপী সমন্বিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে ১৯৩ টির ও বেশি দেশে প্রতিবছর পালিত হয়।১৯৭০ সালের ২২শে এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শহরগুলোতে রাস্তায় নেমে এসেছিলো প্রায় দু কোটি মানুষ। তারা মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার প্রতিবাদ করেছিলো। 

এটিকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাতেই জাতিসংঘ দিনটিকে ধরিত্রী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনটিতে মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসন ধরিত্রী দিবসের প্রচলন করেন। ধরণীর অনেক দেশেই সরকারিভাবে এই দিবস পালিত  হয়। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে বসন্তকালে আর দক্ষিণ গোলার্ধে শরতে ধরিত্রী দিবস পালিত হয়। এই দিবস ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো 

ধরিত্রী দিবসে এ বছরের প্রতিপাদ্য গ্রহ বনাম প্লাস্টিক। এলেন ম্যাক আর্থার ফাউন্ডেশনের মতে, শুধু প্লাস্টিক প্যাকেটের উৎপাদনেই ২০২০ সালে ১৪৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্রয়োজন হয়েছে। এই পরিমাণ বিশ্বব্যাপী মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় প্রায় ২৮ শতাংশ। 

শুধু ২০২০ সালেই বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক শিল্প থেকে ১.৮ বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমপরিমাণ গ্যাস বের হয়েছে, যা কি না ৩৮০টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ও প্যাকেটজাতকরণের সমান। পরিবেশে প্লাস্টিকের প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং বিধ্বংসী।

সমুদ্র যেন প্লাস্টিক বর্জ্যের এক বিশাল ভান্ডার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এতে করে বিপর্যস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র। জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ৮ মিলিয়নেরও বেশি মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতি বছর সমুদ্রে প্রবেশ করে। এই প্লাস্টিক দূষণ সামুদ্রিক প্রাণীদের জন্য বিশাল হুমকির রূপ নেয়, কেন না তারা প্রায়ই ভুল করে প্লাস্টিককে খাবার মনে করে বা বিভিন্নভাবে তাদের শরীর প্লাস্টিকের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।ভূমি,মাটি ও বায়ু দূষণ এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের দীর্ঘস্থায়িত্বের  কারণে মানবজাতির হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।টিআইবির মতে,বৈশ্বিক মোট প্লাস্টিক দূষণের ২.৪৭ শতাংশ হয় বাংলাদেশে।বিবিসির গবেষণায় দৃশ্যমান পৃথিবীর দ্রুতই পরিণত হচ্ছে প্লাস্টিকের গ্রহে।

জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এই দিনটি পালন করা হয়।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, বাংলাদেশে চলমান তীব্র তাপদাহ, পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক শহর দুবাইয়ের স্মরণকালের প্রকাণ্ড বন্যায় নাজেহাল অবস্থা, ইউরোপ ও আমেরিকায় তীব্র তাপদাহ, দাবানল ঘন ঘন এল নিনোর প্রভাব ধরিত্রী রক্ষার গুরুত্ব খুবই প্রাসঙ্গিক এবং রুঢ় বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব এখন নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে, পৃথিবীকে সুরক্ষিত ও বাসযোগ্য রাখতে বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালন করা হয় এবং পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পরিবেশ ও জলবায়ুর গুরুত্ব কতখানি, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে বার্তা দেওয়া হয়।

আমাদের অস্তিত্বের জন্যই এ পৃথিবী টিকে সন্তান  থাকা প্রয়োজন। মাতৃস্নেহে গড়ে তোলা সন্তান যদি মাকে রক্ষা না করে তাহলে কে করবে? গ্রিন হাউজ গ্যাস নি:সরণ কমানো, অবাধে বন উজাড় ও নির্বিচারে বন্যপ্রাণী হত্যা বন্ধ করতে হবে। 

শিল্পোন্নত দেশগুলোই পরিবেশ দূষণ ও পৃথিবী ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হলেও প্যারিস চুক্তি, কিয়োটো প্রটোকল,বাসের কনভেনশন সহ আন্তর্জাতিক পরিবেশ রক্ষার চুক্তি গুলো মেনে চলতে তাদের মধ্যে গড়িমসি দেখা যায়।জলবায়ু তহবিলে ১০০ বিলিয়ন ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যাপারেও তৎপরতা দেখা যায় না।বর্তমানে লক্ষণীয় পরিবেশের বিরূপ প্রভাব আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ধরিত্রীর প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল না হলে মানবজাতির অস্তিত্ব বিলীন হবে।

প্লাস্টিক রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।প্লাস্টিক দূষণে Reuse ,Reduse,Recycle,Recover, নীতি সর্বতোভাবে কার্যকর করতে হবে।এছাড়াও প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন, ব্যবহার হ্রাস ও প্লাস্টিক বর্জ্যের সুষ্ঠু  ব্যবস্থাপনার জন্য প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ বিধিমালা প্রণয়ন করা। ২) পলিথিনের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপনন নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আইনি কাঠামো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। ৩) প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি ও প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যের শুল্ক হ্রাস করা।৪)প্লাস্টিকের বদলে পাট উৎপাদনে প্রনোদনা ও ডক্টর মোবারক খান উৎপাদিত পচনশীল পলিব্যাগ প্রকল্পে আরো বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। 

কার্বন কর প্রচলন, প্লাস্টিকের বদলে পচনশীল পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব সবুজ জ্বালানি ব্যবহার,সবুজ ইন্ডাস্ট্রির ব্যবহারে প্রণোদনা প্রদান করতে হবে।

লেখক: সাইফুল ইসলাম (স্বপ্নীল)
শিক্ষক, প্রাণিবিদ ও কলামিস্ট