শিক্ষাতত্ত্ব : যুগভিত্তিক পরম্পরা
প্রকাশ | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:০২

১. শিক্ষার নীতিতত্ত্ব
একটি শিশুর মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার পথে পরিবার, শিক্ষা, ধর্ম, পুস্তক, প্রতিষ্ঠান আদর্শ নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখে। মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টি হলেও শিক্ষা, পুস্তক, প্রতিষ্ঠান, সভ্যতা, মানুষেরই তৈরি। মানুষের জন্ম এবং দুনিয়াদারির ইতিহাস হাজার বছরের পুরাতন কিন্তু শিক্ষার জ্ঞান ও তাকে ব্যবহার করে বিকশিত হবার প্রচেষ্টা হাজার বছরের আধুনিক। তবে বুদ্ধিবৃত্তির কিছু যৌক্তিক বিষয় দেখে ছুঁয়ে যে জানা, লেখা ও শেখার অনুভূতি তা-ই আলো, তা-ই জ্ঞান। এই আলোকপ্রাপ্তি অবশ্যই প্রকৃতিগত বটে। কে প্রথম জ্ঞানী আর কে বা তাঁর কাছ থেকে পাঠ নিয়েছিলো এমন হিসেব ইতিহাসের পৃষ্ঠাতে নেই। তবে ভূ-প্রকৃতির বিস্তর বিকাশ প্রক্রিয়ায় মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য, সৎ-শক্তির এবং মহত্ত্বে বলেই সকল ধর্মে ও মতে উল্লেখিত হয়েছে।
সেক্ষেত্রে “মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব”২ (আশরাফুল মাখলুকাত)। সেই শ্রেষ্ঠত্ব শারীরিক শক্তির নয়, মানসিক শক্তির এবং বুদ্ধির তারপরও আজ মানুষের ‘এ্যানিমেলিটি’ অর্থাৎ পশুত্ব হলো জন্মগুণ আর “র্যাশনালিটি” হলো অর্জিতগুণ, যে গুণে মানুষ হওয়ার শিক্ষা বেশি তা-ই অর্জিত এবং সহায়কগুণ। “জাতি-ধর্ম-রাষ্ট্র-ন্যায় সকলি যে মানুষের তরে/মানুষ সবার উর্ধ্বে নহে কিছু তাহার অধিক।”৩ অর্থাৎ এই পৃথিবী মানুষের জন্যে কোনো পশু বা দানবের জন্যে নয়। এই বোধের ওপরই মানব সভ্যতার অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। মানুষ তার প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা ভেঙ্গে গড়ে নিয়েছে আধুনিক জগৎ। সে জগতে রয়েছে-শিক্ষা, উদ্ভাবন, বিজ্ঞান, আবিষ্কার এবং প্রযুক্তির ব্যবহার আর সুফল।
এরই আলোকে মানুষ আজ ভিন্ন ভিন্ন ভূগোলের বাসিন্দা হয়েও জ্ঞান জগতের একই ছাতার নিচে বসবাস করছে। তাই মানুষ আজ আন্তর্জাতিকভাবেই “মানুষ” অর্থাৎ নৈতিক যোগ্যতায় বিনয়ী (সম্ভ্রান্ত) মানুষ। প্রাক চৈতন্য যুগেও চন্ডীদাসের পদে মানুষের কথা এসেছে। “শুনহ মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।”৪ অষ্টাদশ শতকে বাউল লালনও তাঁর গানে মানুষের প্রতি সম্মান দেখাতে বলেছেন। “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।”৫ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর কবিতাতে মানুষকে বড় করে তোলেন। “গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান”৬ বাণী দেয়ার যে শিক্ষা তা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক নয় তা বিবেকজাত, যা ধর্ম এবং শিক্ষাকে প্রভাবিত করেছে। মানুষের এই বিবেকই শেষপর্যন্ত কল্যাণকর সকল সিদ্ধান্তের শক্তির উৎস হয়ে রয়েছে। জনতন্ত্রের কল্যাণবোধ ধরেই আধুনিক রাষ্ট্র-ধারণা। এই কল্যাণরাষ্ট্র অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাই মানুষের সকল চাহিদা, সামষ্টিক চাহিদা সবই রাষ্ট্রের কাছে।
তবে পূর্বের ধারণাতে নেপোলিয়ান বলেছিলেন, If you give me an educated mother I shall give you an educated nation. অর্থাৎ আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি দেব। নেপোলিয়নের সেই মা'ই এখন এক একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখন রাষ্ট্রের কাছে জনগণের দাবি একটা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে নেই বা হচ্ছে না তা নয়। ছাত্রছাত্রী বাড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বাড়ছে পাশের হারও বাড়ছে এটা খুব গৌরবের কথা হলেও শিক্ষারনীতি হওয়া উচিত সংখ্যাতীতভাবে নয় গুণাতীতভাবে সাফল্য বিচারে। গুণাতীত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যে দায় তা-ই হচ্ছে ন্যায় বোধ এবং দেশপ্রেম, মানবপ্রেমের শক্তি ও চরিত্র।
২. ঔপনিবেশিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যবস্থা
ঔপনিবেশিক শিক্ষার কাল দুটি (ক) বৃটিশ আমল ১৭৫৭-১৯৪৭ (খ) পাকিস্তান আমল (১৯৪৭ - ১৯৭১)।
ক. বৃটিশ আমলের শিক্ষাব্যবস্থা
সেই আমলের শিক্ষাব্যবস্থার একটা স্লোাগান ছিলো যা প্রচলিত কবিতাতে সর্বত্র উচ্চারিত হয় “লেখাপড়া করে যে গাড়ী ঘোড়ায় চড়ে সে।”৮ শিক্ষা নিয়ে এমন কবিতা বিজ্ঞাপনের মতো শোনায়, আসলে এই বিজ্ঞাপনের মধ্যেই রয়েছে ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা, যা দেশ জাতির দায়িত্ব থেকে একজন মানুষকে স্বার্থপর হওয়ার প্রণোদনা যোগায়। “ইতিহাসের দিকে চোখ রেখে ঔপনিবেশিক শাসন আর শাসিতদের মুখোমুখি দাঁড় করালে যা দেখতে পাওয়া যায় তা হলো, জোর-জবরদস্তি, নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, বিকৃত মন-মানসিকতা আর সংঘাত।
এছাড়া রয়েছে শিক্ষার নামে রসিকতা করে স্বল্প সময়ের মধ্যে নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী, কাজের লোক, শ্রমিক, অফিস-কেরানি আর দোভাষী উৎপাদন। আর এগুলির উদ্দেশ্যই হচ্ছে উপনিবেশ ব্যবসাকে নিরুপদ্রব করা”৯ কথা সত্য ইংরেজ শাসকরা এমন উদ্দেশ্য নিয়েই তৎকালীন বাংলা এবং ভারতবর্ষে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এবং ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা পুস্তক রচনা ও অনুবাদ করে পরে তারা বিভিন্ন স্থানে আরও স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সবই ইংরেজ শাসকদের কাজ। “এন্ট্রাস থেকে শুরু করে (পরবর্তীকালে যা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষারূপে গণ্য হয়) স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত সমস্ত পরীক্ষা নেওয়ার একমাত্র অধিকর্তা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়” এর তত্ত্বাবধানে মোট ২৮৮ জন পরীক্ষার্থী প্রথম এন্ট্রাস পরীক্ষায় বসেছিলেন।”১০ এই এন্ট্রাস (প্রবেশিকা) পাশই তখনকার সময়ে কেরানি হওয়ার উপযুক্ত শিক্ষা। “১৮৮৯-৯৪ এই ছ'বছর সময়কালের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১১,৩৪০ জন এন্ট্রাস, ৪,৩৫৬ জন এফএ, ১,৬৯৫ জন বি,এ ও ২৭৬ জন অনার্স ও এম এ পাশ করেন।”১১ এই তথ্য থেকেই প্রমাণ হয় শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার দিকে গেছে কম, চাকুরিতে ঝুঁকেছে বেশি ইংরেজ আমলের এই শিক্ষা কর্মমুখী ছিলো না, ছিলো পুঁথিগত ভাষা শিক্ষা তবে মানুষ ছিলো কর্মমুখী।
তাই শিক্ষাতে মানবিকতা নৈর্ব্যক্তিকতা ছিলোনা, ছিলো আত্মভুক্ত হওয়া অর্থ্যাৎ শিক্ষাতে ছিলো ব্যক্তির সুবিধাবাদ এবং উন্নতি । তাই একশ্রেণীর বাঙালি শিক্ষিত যুবক সেই-শিক্ষা লাভে ইংরেজও বনে গিয়েছিলো, তারা পোশাকে-আশাকে ‘হ্যাটকোটে’ নিজেদের প্রদর্শন করতেও কুণ্ঠাবোধ করতো না। এই শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর থেকেই আবার শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশ ঘটে, স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই তৎকালীন কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলো। ইংরেজশাসিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক পর্যায় কাটিয়ে ওঠার পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলিম সাহিত্যিকদের সংগঠন ‘শিখা গোষ্ঠী’ প্রচলিত এই শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি ধরে কিছু সংস্কারের কথা ভাবেন এবং করেন। বিদ্যাসাগর বাংলাভাষায় পুস্তক ও ব্যাকরণ রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনের সাথে শিক্ষার সামঞ্জস্যের কথা বলেন। ‘শিখা গোষ্ঠী' শিক্ষাকে জ্ঞানের আলো হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। এই গোষ্ঠী মুসলিম সাহিত্য সমাজভুক্ত তাঁরাই শুরু করেছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন।
এই আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে শিখা পত্রিকার ঐতিহাসিক ভুমিকা রয়েছে। এই পত্রিকার মূলনীতি’ই ছিল “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট মুক্তি সেখানে অসম্ভব।”১২ জ্ঞান এবং শিক্ষা বিষয়ক এই বুদ্ধিদীপ্ত স্লোগান জনকল্যাণের দাবি হলেও তা বিদেশী শাসকদের কাছে উপেক্ষিত হয়। তবে স্বার্থপর এই শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে যে এ দাবি কেবলি কিছু বুদ্ধিজীবির দাবি মাত্র তাই শিক্ষা নিয়ে ইংরেজ শাসক আর নতুন ভাবনা কিংবা সংস্কারের পথে হাঁটেনি। তাদের কাছে গুরুত্বের বিষয় হয়ে ওঠে স্বরাজ আন্দোলন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের অগ্রগতি। স্বরাজ আন্দোলনের দ্বিধারা ছিলো, একটি গণতান্ত্রিক এবং অপরটি সশস্ত্র। গণতান্ত্রিক ধারার চাপ ধরেই ইংরেজশাসক ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিয়ে যায়। এই স্বাধীনতা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হয় বলেই হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সংঘাত শিক্ষিত সমাজের উক্তি বা বাণীতে বন্ধ করা যায়নি। জেগে ওঠে সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা হয়, কলকাতা, নোয়াখালি, বিহারসহ বিভিন্ন প্রদেশ এবং জেলাতে। পড়শির হাতে পড়শি খুন, দাদার হাতে ভাই এবং ভাইয়ের হাতে দাদা খুন হয় মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে শিক্ষিতসমাজ তা রুখে দিতে পারেনি। কারণ বৃটিশশাসিত শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর এমন গণমুখী মূল্যবোধ ছিলো না তবে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি হয়েছিলো যারা ইংরেজি ভাষা-সংস্কৃতির সেবা-চর্চাতে অগ্রগামী ছিলো। চতুর ইংরেজ তাদের দ্বারাই ঔপনিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হয়। তাই দেশভাগের ফলে ভারত পাকিস্তানের প্রশাসনে এই শ্রেণীকেই তারা সুকৌশলে আবার সংগঠিত করে গিয়েছিলো।
এই ইংরেজি পড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীটা সুবিধাবাদী এবং ক্ষমতাবাদী সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে দেশের ভেতরে বাইরে নানাভাবে ইংরেজ উপনিবেশবাদকে জি'য়ে রেখে তার গুণকীর্তন এখনও করে চলেছে। “ইংরেজ শাসনের সময়ে ইংরেজী শিক্ষাপ্রাপ্ত স্বামীর যোগ্য পতœী হইবার জন্য বাঙালী মেয়ে যেমন ইংরেজী না শিখিয়াও মানসিক ধর্মে পাশ্চাত্ত্য হইতে হইল, তেমনি পাশ্চাত্ত্য ধরণের কাপড়-চোপড় পরিয়া আচরণেও পাশ্চাত্ত্য হইতে হইল।”১৩ পারিবারিকভাবে এমন ইংরেজ অনুগামী শিক্ষিত শ্রেণী দেশভাগের পরও ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে রয়েছে। এই শ্রেণীর মানুষ তাঁদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার ফল দ্বারা দুটি দেশেই আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার স্বার্থে আমলাতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে।
খ. পাকিস্তানি আমলের শিক্ষাব্যবস্থা
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এর সময়সীমা। উল্লেখিত আলোচনাতে শিক্ষাব্যবস্থায় যে সংকট তা পাকিস্তান সরকারও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাদের রাজনৈতিক সংকট ধরেই শিক্ষাব্যবস্থার সংকট আরও ঘনীভূত হয়। সেই কারণেই তারা শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে ইংরেজদের শিক্ষাপদ্ধতি চালু রাখে যা বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে সমর্থিত না হয়ে অপ্রিয় হয়েছে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থায় দূর্বল শিক্ষানীতি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান শাসকশ্রেণীর কাছে একটি উপাদান হয়ে ওঠে। ফলে তারা রাজনৈতিকভাবে এ দেশকে দাবিয়ে রাখার জন্যে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আনে।
এই পরিবর্তন বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য ইতিবাচক ছিলো না। আবার পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘বাঙালি অংশীদারিত্ব’ ন্যায্যতা না পাওয়ার প্রেক্ষিতে নেতাদের মনে পাকিস্তান বিষয়ক নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। পাকিস্তানি সরকার খুব দ্রুত পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে শোষিত এবং শাসিত জনগোষ্ঠির আওতাভুক্ত করার নীতি কার্যকর করে।
তারই প্রথম আলামত ভাষা, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির ওপর ১৯৪৮, ১৯৫২ সালের আঘাত। শিক্ষার বাহন হলো ভাষা, সেই ভাষার ঘোষণা এলো উর্দূর “Urdu and Urdu should be the state language of Pakistan.” ১৪ এভাবে পাকিস্তানের জাতির পিতা মিঃ জিন্নাহ যখন উর্দূকে বাংলা ভাষার ওপর চাপিয়ে দেয়, তখন বাঙালি জনগোষ্ঠী সংগ্রামমুখী হয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল স্থানে প্রতিবাদ করে, প্রতিবাদী জনতার অনেকেই শহীদ হন। এভাবেই ভাষা আন্দোলন রূপ পায় রাজনৈতিক আন্দোলনের এই আন্দোলন ঠেকাবার জন্যে জারি হলো সেনাশাসন। ভাষার মতো সেনাশাসনও চেপে বসলো পূর্বপাকিস্তানের বাঙালির ওপর সুতরাং পাকিস্তানি শিক্ষাব্যবস্থায় নেমে এলো ফোর্থল্যাংঙ্গুয়েজের ভার। শিক্ষারভাষা উর্দু, বাংলা হলেও সিলেবাসে বই এলো ইংরেজি ও আরবি শিক্ষারও। স্কুলে স্কুলে গাইতে হলো “পাক সার জমিন সাদ বাদ।” ১৫ ইংরেজরা যেমন ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বাড়িয়ে ছিলো তেমনি আবার পাকিস্তান চাইলো উর্দূর গুরুত্ব তাই বেশি ভাষাশিক্ষার শিক্ষাব্যবস্থায় তৈরি হয়নি নীতিবান মানুষ, জ্ঞানী মানুষ। তারা বোঝেনি ভাষা আলাদা জ্ঞান নয়, ভাষা হচ্ছে মূলত মাধ্যম।
প্রতিটি ভাষাই সেই জাতির মাতৃভাষা। মাতৃভাষা জানলেই মানুষ শিক্ষিত বা জ্ঞানী হতে পারে না। একজন বৃটিশ মায়ের সন্তান ইংরেজিতে কথা বলবেই তাই বলে শিশুটি শিক্ষিত বা জ্ঞানী নয় আসলে মানুষ হতে হয়, সেক্ষেত্রে শিক্ষা এবং শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষার সামাজিক দায় মানবিক দায়, রাষ্ট্রিক সে দায়ে এলো বিপন্নতা। তবুও রাষ্ট্রশাসিত শিক্ষানীতিতে চালু থাকলো শিক্ষাব্যবস্থার চারটা স্তর-প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা। এভাবেই শিক্ষাব্যবস্থা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সিলেবাস, বই-পুস্তক, পরীক্ষা, ফলাফল সব কিছুতেই অগ্রগতি তৈরি হলেও মূলবিপত্তি আসে সিলেবাসে। ২৫ ভাগ ইসলামিকরণ+২৫ ভাগ পাকিস্তানিকরণ+২৫ ভাগ বিজ্ঞান+ ২৫ ভাগ ভূগোল, ইতিহাস এবং আন্তর্জাতিকতা = ১০০ ভাগ। পরীক্ষা পদ্ধতি ছিলো রচনাধর্মী (প্রবন্ধ প্রকৃতির), বড় প্রশ্নের বড় উত্তর হতো। বোর্ড পরীক্ষায়, ৫টি প্রশ্নের নম্বর বন্টন হতো ৫দ্ধ২০ =১০০ নম্বর, এ কারণেই ৫টা ৬টা করে প্রশ্ন মুখস্তের প্রচলন ছিলো। আবার ভালো শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জেনারেশন থেকে জেনারেশন নোট সংগ্রহ চলতো, চোখবন্ধ করে মুখস্তের প্রতিযোগিতা হতো। এই শিক্ষাব্যবস্থার দুটি মূল সমস্যা ছিলো, একটা সিলেবাস অন্যটা পরীক্ষা পদ্ধতি। প্রশ্নপত্র তৈরি থেকে উত্তরপত্রের মূল্যায়ণ এবং ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন যাপন করতো।
এই ব্যবস্থা একধরণের পিলোপাসিং খেলার মতো ছিলো। কারণ এই ব্যবস্থার সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন মানুষের সংযুক্তি ছিলো। যিনি সিলেবাস তৈরি করতেন তিনি পড়াতেন না, যিনি পড়াতেন তিনি প্রশ্ন তৈরি করতেন না, যিনি প্রশ্ন তৈরি করতেন তিনি পরীক্ষা নিতেন না, যিনি পরীক্ষা নিতেন তিনি উত্তরপত্র মূল্যায়ণ করতেন না আবার যাঁরা উত্তরপত্র মূল্যায়ণ করতেন তাঁরা ফলাফল তৈরি করতেন না। অর্থ্যাৎ এখানে কেবল শিক্ষার্থীর পরীক্ষা দেয়া ছাড়া আর কোন কিছুই নিশ্চয়তার ভেতর থাকেনি। পরবর্তী সকল কার্যক্রম ওই পিলোপাসিং সার্কেলে বসে থাকা উল্লিখিত মানুষগুলোর উপর ন্যাস্ত। তাই শিক্ষা এখনও জিম্মি হয়ে রয়েছে এমনই জটিলব্যবস্থার ওপর ফলে এদের একজনের গাফেলতি বা দুর্নীতির কারণেই শিক্ষার্থীদের ফলাফল বিপর্যয় বা ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছে বা ঘটছে। সে সময় নানা অজুহাতে সরকারি স্বার্থে অটোপাশেরও ব্যবস্থা হয়েছিলো। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম ছিল কয়েক মাইল হেঁটে স্কুল যেতে হতো, শিক্ষায় অনাগ্রহ ছিলো। চাকুরি ব্যবস্থার আকাল ছিলো বলে ভালো ফলাফল করা ছাত্ররা গ্রামের স্কুলে অগ্যতা শিক্ষকতা করতো। এমনই নানাবৈষম্য ধরে এসব শিক্ষার্থীরাই একদিন, একদিন করে প্রতিবাদ প্রতিরোধ থেকে বাঙালির স্বাধীনতাকে তরান্বিত করেছিলো।
৩. স্বাধীনতা-উত্তর শিক্ষাব্যবস্থা
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম একদশক ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুল কলেজের পুননির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকারের মনোযোগ বেশি ছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তীতে সরকারগন মুলতঃ প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙ্গে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। পাশাপাশি নারী শিক্ষার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়, মেয়ে শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা ও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সর্ম্পকে সরকারী উদ্যেগে প্রচারনা আরম্ভ হয়। স্বাধীনতা উত্তর ৩৭ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১ লাখ ৬২ হাজার শিক্ষককে সরকারিকরণের মাধ্যমে অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষারভার সরকার নিজ দায়িত্বে নেয়। ঔপনিবেশিক আমলের দীর্ঘদিনের গুরুত্বহীন শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি গুরুত্বে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং সরকারের নির্দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হিসেবে চালু হয়।
একইসাথে বেসরকারি স্কুলশিক্ষকদের ৭৫ টাকা আর কলেজ শিক্ষকদের ১০০ টাকা করে পারিতোষিক অনুদান চালু হয়। সাধ সাধ্যের মিল অমিল নিয়ে স্বাধীনতার ৫০-৫৩ বছরে শিক্ষাব্যবস্থায় এক দুই করে যে কিছু পরিবর্তন আসছে তা তো মানতেই হয়। সরকারি, বেসরকারি স্কুল, কলেজের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পাকিস্তানি আমলে যেখানে অনেক থানাতে ১টি কলেজও ছিলো না সেখানে এখন প্রতিটা উপজেলাতে ১৮ থেকে ২০টি কলেজ, স্কুল যেখানে ৪টি ছিলো সেখানে এখন ৪০-৫০টি হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৫ হাজার ১৩২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৪৮ লাখ ৯০ হাজার ২২৫ জন, শিক্ষক রয়েছে ৩ লাখ ২২ হাজার ৪৮৭ জন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৯ হাজার ৮৪৭টি, শিক্ষার্থী ৯১ লাখ ৬০ হাজার ৩৬৫ জন, শিক্ষক ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৩ জন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৪ হাজার ০৭টি, শিক্ষার্থী ৩৭ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৪ জন, শিক্ষক ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৩৭ জন। বিশ্ববিদ্যালয় (সরকারি-বেসরকারি) ১৩০টি, শিক্ষার্থী ৮ লাখ ২৪ হাজার ৭৬৯ জন, শিক্ষক ২৭ হাজার ৭৯৪ জন। বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে প্রায় ৫০হাজার, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ লাখ ৩৫ হাজার এবং শিক্ষক প্রায় ৩৫ হাজার।
এছাড়া দেশের বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি বেসকারি মাদ্রাসার সংখ্যাও কম নয়। পূর্বে ক্যাডেট কলেজের সংখ্যা যেখানে ৪টি ছিলো বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২টি এর মধ্যে ৯টি ছেলেদের এবং ৩টি মেয়েদের। বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হলেও বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সরকারি বিধিবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে বোর্ড, শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (ঘঈঞই), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় এসব প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশ শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক কর্তৃপক্ষ ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক, ভর্তিবিধি, পরীক্ষাপদ্ধতি, প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, পরীক্ষা ফলাফল তৈরি সার্বিক শৃঙ্খলা, বিভিন্ন কার্যক্রমের অনুমোদনসহ আর্থিক বিষয়াদির দেখভাল ও নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ।
এই সকল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারি বেসরকারি উভয় পর্যায়ে একই নীতিমালা প্রচারিত হয়ে থাকে তবে এর বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা কিংবা পরিবেশ গত কিছু বৈষম্য বা অনীহা ভিন্নতা সৃষ্টি করে। এই ভিন্নতা আবার রাজনীতি ও দুর্নীতি প্রভাবিতও বটে। সরকারি শিক্ষানীতির বদনাম আমরা যে ভাবেই উল্লেখ করি না কেনো এই বদনাম আসলে শিক্ষানীতির নয়, তা শিক্ষাবাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার বদনাম। যেমন প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তিতে তাদের দায়িত্ব লাভ করার কথা তারা সেভাবে না নির্বাচিত/দায়িত্ব প্রাপ্ত না হয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ে যখন দায়িত্ববান হয় তখন তারা সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে অনিয়মের প্রশ্রয় গ্রহন করে। সেই অনিয়ম শিক্ষক-নিয়োগ থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী ভর্তি এবং পরীক্ষার হ'লে তা নকল প্রবণতাতে বিস্তৃত। তবে এমন নকল প্রবণতার ধারণা এখন পাল্টেছে।
শিক্ষার্থীরা নকল ফেলে বই ধরেছে, তবে সে বই গাইডবই। “নকল ধরতে হয় সৎ ও যোগ্যকে বাঁচবার জন্যে, পেছন-দরজার সুযোগ নিয়ে ঢুকে পড়া অশুভ মানুষের অন্যায় তৎপরতা প্রতিহিত করার জন্যে পৃথিবীর জন্যে এক ন্যায়সংগত ও নিরাপত্তাপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলার জন্যে।”১৬ তাই শিক্ষা গ্রহণে বংশ এবং পরিবেশের কথা মনোবিজ্ঞানে বলা হলেও সেই পরিবেশ রক্ষায়, প্রশাসন, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরাই হচ্ছে তার মূল উপকরণ। শিক্ষার্থীদের আসন অনুযায়ী ভর্তি করাতে হবে, ক্লাসরুম আকর্ষণীয় হতে হবে, মূলবই পড়াতে হবে, সিলেবাস শেষ করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার কেন্দ্র থাকবে যাতে পরীক্ষার সময় অন্যক্লাসের নিয়মিত/ স্বাভাবিক ক্লাস নষ্ট না হয়। মোটামুটি এতটুকু উন্নতি হলে শিক্ষার পরিবেশ মানসম্মত বলে বিবেচিত হবে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন অবস্থা বিরাজ না করলেও অনেক ক্ষেত্রে এমন পরিবেশ দৃষ্টি গোচর হচ্ছে বৈকী। এ কারণেই শিক্ষার অগ্রগতিতে আজ পর্যন্ত এই ৫৩ বছরে সংখ্যাতত্তে¡ অনেক কিছু বাড়ালেও শিক্ষানীতির গুণতত্তে¡ ৩টি পরিবর্তন বেশি লক্ষণীয়। প্রথমটি নৈর্ব্যত্তিক পরীক্ষাপদ্ধতি, ফলাফল প্রকাশে গ্রেডিং পদ্ধতি।
দ্বিতীয়টি প্রাথমিক স্তরের পিএসসি (চঝঈ) ও জুনিয়র স্তরের জিএসসি (ঔঝঈ) বোর্ডপরীক্ষা এবং তৃতীয়টি তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি সকল বিভাগে আবশ্যিককরণ। এসব কারিকুলাম দীর্ঘদিন চললেও এখন থেকে আবার তা পরির্বতিত হয়েছে। বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা পুনরায় ঘোষনা দিয়েছেন পূর্বের রচনামূলক পদ্ধতিতে ফিরবার এবং নবম শ্রেণী থেকে বিভাগ করবার। নতুন বিশ্বব্যবস্থার সাথে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের তাল মিলাবার জন্যে সরকার যে উদ্যোগী কারিকুলাম গ্রহণ করেছে তা প্রশংসার বিষয়। পরীক্ষাকেন্দ্রিক এই শিক্ষাব্যবস্থার মুল বিষয় পাঠ্যবই পাঠ। প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে পাঠ্যবই ও রচনামূলক পদ্ধতির সাথে পরীক্ষার নীতিগত সর্ম্পক রয়েছে। কিন্তু জ্ঞান অর্জনের চাইতে পরীক্ষায় না¤¦ার অর্জনের ভ্রানÍ প্রবনতায় শিক্ষাথীরা পাঠ্য বইয়ের চাইতে গাইডবই পড়তে বেশী আগ্রহী হচ্ছে। গাইডবই মুলবইয়ের সংক্ষিপ্তরূপ। এই সংক্ষিপ্তরূপ শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও জ্ঞানের বি¯তৃতিকে সহায়তা করে না। তাই গাইডবই নির্ভর শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে শিক্ষালাভ করে বটে কিন্তু বৈশ্বিক এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে কর্মজীবনের প্রবেশলাভে সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের ভূমিকা আরো গঠনমূলক হওয়া প্রয়োজন। গাইডবই-বিরোধী, ভুমিকা রাখতে হবে।
“একটা দোকানদার? মুদি? আমাদের কাছে নোট কিনতে পাওয়া যায়? ছাত্রেরা টাকা নিয়ে এলে তা বিক্রি করা হয়? নিশ্চয় হয়? আমরাই বিক্রি করি। দেশের শ্রেষ্ঠ কলেজের শিক্ষকরাই বিক্রি করি। না হলে কোথা থেকে খবর পায় এরা? কীভাবে পায়?”১৭ গাইডবই এবং নোটবই সম্পর্কে এমন বিরূপ-ধারণা স্কুল স্তরের শিক্ষকদেরই হওয়া উচিত। সরকার শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং এবং গাইডবই, নোটবই বেআইনি করেছে, এই আইন শিক্ষকদেরই মেনে চলতে হবে। তাঁরা যদি এ দুটি বিষয়ে নির্লোভ হয়ে সরকারকে সহায়তা করে তা'হলেই শিক্ষার্থী তথা শিক্ষাব্যবস্থার শুদ্ধরূপ দৃশ্যমান হবে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত, বেসরকারী এবং আধাসরকারী ব্যবস্থা/ প্রতিষ্ঠানে বিন্যাস্ত। এইসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ওপরই মূলত জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক অগ্রগতি নির্ভর করে। তাই শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণসহ আরও ৫টা বিষয়ে দক্ষ হতে হবে : ক. মানসিক যোগ্যতা খ. শারীরিক যোগ্যতা গ. শিক্ষাগত যোগ্যতা ঘ. নিয়োগ যোগ্যতা ঙ. পেশাগত যোগ্যতা। উল্লিখিত গুণাবলীতে শিক্ষক সমাজ গুণী হয়ে উঠলেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আসবে। শিক্ষাব্যবস্থা কার্যত একটি যুগ-উপযোগী চলমান পদ্ধতি যা কালচক্রে পরিবর্তিত হয়েই সমসাময়িক হয়ে ওঠে।
তথ্যসূত্রঃ
১। অজিত কুমার গুহ/আনিসুজ্জামান, নতুন বাংলা রচনা, প্রকাশক-মল্লিক ব্রাদাস-২০০২, পৃষ্ঠা-৮৪০।
২। সুফী মোতাহার হোসেন, মাধ্যমিক বাঙলা সাহিত্য, ইস্ট পাকিস্তান স্কুল টেক্সবুক বোর্ড ১৯৬৮, পৃষ্ঠা-৭২।
৩। গোপাল হালদার, বাঙালা সাহিত্যের রূপরেখা (১ম খন্ড), মুক্তধারা, পৃষ্ঠা-৪৯।
৪। আহসানুল কবির, লালন কী কথা কয়, অর্পিতা প্রকাশনী- ২০১৭, পৃষ্ঠা-৪৩।
৫। কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল রচনাবলী (১ম খন্ড), বাংলা একাডেমী-১৯৯৬, পৃষ্ঠা-২৩৪।
৬। শাহনারা বেগম শানু (প্রকাশিকা), কারেন্ট ওয়ার্ল্ড এ্যালবাম, বিসিএস প্রকাশন-২০০১, পৃষ্ঠা-৪৪৭।
৭। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, মওলা ব্রাদার্স-১৯৯৯, পৃষ্ঠা-১৬১
৮। এমে সেজায়ার (ভাষান্তর: কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় ও সাজ্জাদ জহির), ঔপনিবেশিকতার মুখোশ উন্মোচন, প্রকৃতি প্রকাশ-২০১৪, পৃষ্ঠা-২৯।
৯। সমর মুখোপাধ্যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের লয়, 'দেশ' পত্রিকা, ২৯ নভেম্বর ১৯৮৬, পৃষ্ঠা-৭৩।
১০। স্বপন বসু, পুঙবে মেয়ে উড়বে ছাই, ‘দেশ' পত্রিকা, ১৯ অক্টোবর ১৯৯৬, পৃষ্ঠা- ৫৫।
১১। মাহবুবুল আলম, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, খান ব্রাদার্স-২০০০, পৃষ্টা-৩৫৬।
১২। নীরদচন্দ্র চৌধুরী, আত্মঘাতী বাঙালী, চয়নিকা প্রেস (কলকাতা) ১৯৯০, পৃষ্ঠা-৫০,৫১।
১৩। বাংলা একাডেমী সম্পাদিত, একুশের সংকলন ৮০' স্মৃতিচরণ, বাংলা একাডেমী প্রেস-১৯৮০, পৃষ্ঠা-৪১।
১৪। হুমায়ুন আজাদ, পাক সার জমিন সাদ বাদ, আগামী প্রকাশনী-২০০৩, পৃষ্ঠা-৫।
১৫। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, নিষ্ফলা মাঠের কৃষক, মওলা ব্রাদার্স-১৯৯৯, পৃষ্ঠা-১৬৩।
যাযাদি/ এস