আ.লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ : প্রয়োজনীয়তা, চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা
প্রকাশ | ২১ মার্চ ২০২৫, ১৬:৫১

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংসকারী একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে দলটি একাধিকবার জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে, হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা ও গুম করেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, এবং দেশের আর্থিক সম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেছে।
একটি বড় অংশ মনে করে, আওয়ামী লীগকে যদি আবারও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়, তাহলে তারা পুনরায় ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করবে, বিরোধীদের দমন করবে, এবং নিজেদের অপরাধ ধামাচাপা দেবে। ফলে, এই দলটিকে নিষিদ্ধ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
### *কেন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত?*
বিগত এক দশকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। নিষেধাজ্ঞার দাবির পক্ষে যেসব কারণ তুলে ধরা হচ্ছে, সেগুলো হলো—
1. *ভোটাধিকার হরণ ও গণতন্ত্র ধ্বংস* – ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল নজিরবিহীন প্রহসন। জনগণের ভোটাধিকারকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।
2. *মানবাধিকার লঙ্ঘন* – বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন এবং বিরোধীদের দমন করা হয়েছে।
3. *অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও লুটপাট* – ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগ উঠেছে, যা দেশের অর্থনীতিকে চরমভাবে দুর্বল করেছে।
4. *সাংবাদিকতা ও বাকস্বাধীনতা দমন* – বিরোধী মত দমনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে।
5. *সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অস্থিরতা* – ২০০৯ সালে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।
6. *ধর্মীয় নিপীড়ন* – শাপলা চত্বরের ঘটনায় হাজার হাজার আলেম-ওলামার হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
### *নিষেধাজ্ঞার আইনি ভিত্তি কী হতে পারে?*
যদি কোনো দল সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করে, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করে, এবং রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দেয়, তবে সেই দলকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব। একাধিক আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে ফ্যাসিবাদী বা চরমপন্থী দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে—
- *নাৎসি পার্টি নিষিদ্ধ (জার্মানি)* – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
-
- *বাকশাল নিষিদ্ধ (বাংলাদেশ)* – ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও পরে তা বাতিল করা হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হলে তাদের নিরপরাধ নেতাকর্মীদের কী হবে? আইনানুগভাবে নিরপরাধ ব্যক্তিদের অন্য দলে যোগ দেওয়ার সুযোগ থাকবে। তারা চাইলে নতুন দল গঠন করতে পারবেন।
*নিষেধাজ্ঞার বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ*
তবে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা কোনো সহজ কাজ নয়। রাজনৈতিকভাবে এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু। আন্তর্জাতিক মহল, কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং প্রশাসনের কিছু অংশ দলটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারে।
যদি দলটি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে অবশিষ্ট নেতাকর্মীরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে? নতুন দলে যুক্ত হলে সেটি কি আবার আওয়ামী লীগের ছায়া হয়ে দাঁড়াবে? এসব প্রশ্নের উত্তরও খুঁজতে হবে।
*ড. ইউনুসের ভূমিকা কী হতে পারে?*
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ওপর এই মুহূর্তে বড় ধরনের দায়িত্ব এসেছে। তিনি যদি সত্যিই নিরপেক্ষ থাকেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষের হন, তাহলে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের উদ্যোগ নিতে পারেন। আন্তর্জাতিক মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকায় এই সিদ্ধান্ত বৈধতা পেতে পারে। তিনি চাইলে সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করে আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ঐক্যমত গঠন করতে পারেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার রাজনৈতিক বিভাজন দেখা গেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো দীর্ঘমেয়াদি দুঃশাসনের নজির বিরল। এই দলটি যদি সত্যিই রাষ্ট্র ধ্বংসের মূল কারণ হয়ে থাকে, তাহলে আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। জনগণের মতামতকেও প্রাধান্য দিতে হবে।
তবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে এর ফলে নতুন সংঘাতের সৃষ্টি হবে না। প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য চাই স্বচ্ছ বিচারিক প্রক্রিয়া, ন্যায়বিচার, এবং একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংস্কার। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত কিনা—এটি এখন একটি বড় প্রশ্ন, যার উত্তর সময়ই দেবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র
যাযাদি/ এস