পহেলা বৈশাখ ও আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা

প্রকাশ | ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:২১ | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:২৬

সাইদুর রহমান সাঈদ
ছবি: সংগৃহীত

পহেলা বৈশাখ—বাংলা বছরের প্রথম দিন—বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এটি শুধুমাত্র একটি দিন নয়, বরং বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতির শেকড়স্পর্শী চেতনার বহিঃপ্রকাশ। যুগ যুগ ধরে এই দিনটি বরণ করে নেওয়া হয় নতুন আশার আলোয়, পুরাতনকে পেছনে ফেলে সামনের পথচলার প্রত্যয়ে। কিন্তু বর্তমানে পহেলা বৈশাখের উদযাপন যেভাবে রূপ নিচ্ছে, তা একদিকে যেমন শহরমুখী ও উচ্চবিত্ত শ্রেণিনির্ভর হয়ে উঠছে, অন্যদিকে তেমনি এর মূল আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাচ্ছে।

পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মূল প্রেক্ষাপট ছিল কৃষিজীবী সমাজ। বাংলা সনের সূচনা ঘটে সম্রাট আকবরের আমলে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে। এ সময় কৃষকেরা নতুন বছরের শুরুতে জমির খাজনা প্রদান করত, পুরোনো দেনা-পাওনার হিসাব মিটিয়ে পরবর্তী বছরের প্রস্তুতি নিত। তাই এ দিনটি ছিল কৃষকদের কাছে আর্থিক ও সামাজিক পুনর্জীবনের প্রতীক। নববর্ষ মানেই ছিল নতুন ফসল ঘরে তোলা, হালখাতা খোলা, এবং নতুন করে যাত্রা শুরু করা।
কিন্তু সময়ের প্রবাহে এই উদ্দেশ্য অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। আজকের পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। শহরের নাগরিক সমাজে এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে সাজগোজ, বৈশাখী মেলা, খাবারদাবার ও বিনোদনের উৎসবে। অথচ গ্রামের কৃষক, যাদের হাত ধরে এই উৎসবের সূচনা, তারা যেন এই আয়োজনের বাইরেই পড়ে থাকে।

বর্তমানে পহেলা বৈশাখের উদযাপনে সবচেয়ে বড় বৈষম্যটি দেখা যায় শহর ও গ্রামের মধ্যকার ব্যবধানে। শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন দিবসটিকে ঘিরে নানান আড়ম্বর ও বিলাসিতায় মেতে ওঠে, তখন গ্রামের কৃষক হয়তো দিনমজুরিতে ব্যস্ত থাকে কিংবা নিজের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটায়। অথচ উৎসবটির মূলে ছিল তাদেরই শ্রম, তাদেরই জীবনচক্র।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের উচিত পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে সর্বজনীন রূপ দেওয়া। দেশের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীকে এই উৎসবের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে বৈশাখী উৎসব আয়োজন, কৃষকদের সম্মাননা প্রদান এবং কৃষিপণ্যভিত্তিক মেলা আয়োজনের মাধ্যমে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব।

পহেলা বৈশাখের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতারও গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই অর্থবছর নির্ধারিত হয় তাদের জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে। ভারতের মতো দেশগুলো তাদের নিজস্ব প্রশাসনিক ও কৃষিনির্ভর বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অর্থবছর নির্ধারণ করেছে। অথচ বাংলাদেশে এখনো ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের জুলাই-জুন ভিত্তিক অর্থবছর চালু রয়েছে, যা দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে সাংস্কৃতিকভাবে সংগতিপূর্ণ নয়।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। অর্থনীতির মূলভিত্তি এখনো কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আর কৃষি চক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনাবিন্দু হলো পহেলা বৈশাখ। এ সময় কৃষক ফসল ঘরে তোলে, পুরোনো দেনা-পাওনা চুকায় এবং নতুন উৎপাদন চক্রে প্রবেশ করে। সুতরাং এই দিনকে কেন্দ্র করে অর্থবছরের সূচনা করলে তা হবে বাস্তবতানির্ভর, সংস্কৃতিসম্মত ও কৃষিবান্ধব সিদ্ধান্ত।

ভবিষ্যতে সরকারের উচিত হবে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে একটি সংস্কৃতিসম্মত ও অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক নীতি নির্ধারণ করা। দেশের বাজেট প্রণয়নে এই ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যেন দেশের আর্থিক পরিকল্পনার সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা যায়।
সেই সঙ্গে পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে সার্বজনীন করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গ্রামের কৃষকদের যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসতে হবে।
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি দিন নয়—এটি বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এই উৎসবকে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে, কৃষকদের সম্মানিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং অর্থবছরের সঙ্গে একীভূত করে একটি বাস্তবসম্মত, সর্বজনীন ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক পহেলা বৈশাখ গড়ে তোলাই হোক আমাদের সামষ্টিক লক্ষ্য।

সাইদুর রহমান সাঈদ 
শিক্ষার্থী- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

যাযাদি/ এমএস