দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-অর্থনৈতিক রাজনীতি, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা - প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

প্রকাশ | ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:১৯

ব্রিগে. জেনারেল মো. নাসিমুল গনি
ছবি: যায়যায়দিন

গত ০৯-০৪-২০২৫ তারিখে যায় যায় দিন কাগজে “রাজনৈতিক নেতৃত্ব বনাম স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশ প্রেক্ষিত” প্রকাশের পর উপরোক্ত এই বিষয়টিকে জনগনকে জানানো ব্যক্তিগত দায়িত্ব মনে করছি। কেননা তাত্তি¡ক ও ঐতিহাসিকভাবে এখন বাংলাদেশ ইতিহাসের যুগ সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে। জুলাই ৩৬ গণ অভ‚্যথান/বিপ্লবের পরে বিষয়টির স্পষ্টতা জোরালোভাবে দেখা যাচ্ছে । দক্ষিণ এশিয়া বা সার্কভুক্ত দেশসমূহ (বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান) এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার মায়ানমারকে ঐতিহাসিকভাবে এক সূত্রে গাঁথা হিসাবে গণ্য করা যায়। এসব দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যা ১৯৭১ সালে অগণিত শহীদের আত্মদান ও মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে।

 

স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশ কমনওয়েলথ এর সদস্য (তাত্তি¡ক ও আইনগতভাবে অবৈধ) পদ গ্রহণ করলেও তা দক্ষিণ এশিয়ার ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনীতিতে ক্রীড়ানক হওয়ার একটি প্রচেষ্টা মাত্র। পূর্বের ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা (বর্তমানে মায়ানমার) অখন্ড বৃটিশ উপনেবেশিক শাসনে ছিল এবং ক্রমান্নয়ে ভারতবর্ষ হতে পৃথিকীকরণ করা হয় (আফগানিস্থান ১৮৮৬ ও ১৯২৩, ভ‚টান ১৯০৬, শ্রীলংকা ও বার্মা ১৯৩৫, পাকিস্তান ১৯৪৭)। ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ স্বাধীন সালে ডোমিনিয়ন স্টাটাসপ্রাপ্ত হয়ে এই ১৯৫০ সালে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। বার্মা এ্যাক্ট ১৯৪৮ এর মাধ্যমে বার্মা ইউনিয়নকে ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ও কমনওয়েলথের বাহিরে পৃথকভাবে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। মালদ্বীপ ব্রিটিশ প্রটেকটরেট ছিল এবং ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা পায়। নেপাল ১৯২৩ সালে ব্রিটিশদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে পরোক্ষ বৃটিশ প্রভাবাধীন রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদের রক্ষা করে। আফগানিস্তান গ্রেট গেম (রাশিয়া ও বৃটেন ১৮০০-১৮৪৪) এর অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং ১৯১৯ সালে বৃটিশ প্রটেকটরেট রাজ্য হতে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। বার্মা চৈনিক প্রভাবের বিপরীত বৃটিশ রাজ্যের পূর্ব পাখা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। 

বঙ্গ/বাংলা ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বিজয়ের মাধ্যমে বৃটিশরা (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী) এই ভারত উপমহাদেশে তাদের রাজনৈতিক, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, এবং পরিশেষে ধর্মীয় আধিপত্যের সূচনা করে। কলিকাতা তাদের রাজধানী বা সকল কর্মকাÐের কেন্দ্রভূমি ছিল। মোগল আমলে সুবা বাংলা তৎকালীন ভারতবর্ষে  সর্বাধিক পরিমান রাজস্ব প্রদান করতো এবং সমৃদ্ধশালী ছিল (পৃথিবীর প্রায় ১২% জিডিপি প্রদান করতো)। তৎকালীন বিশ্ব ইতিহাসে তার নিজস্ব অবস্থান, গৌরব এবং মর্যাদা ছিল। পরবতীতে কোম্পানী  শাসন ও শোষণের রোষানলে ক্রমান্নয়ে বাংলা দুর্বল হতে থাকে। বিবিধ ধরণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসন পদ্ধতি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির বিপরীতে বিভিন্ন আন্দোলন, প্রতিরোধ ও যুদ্ধ সত্তে¡ও কোম্পানী ভারতবর্ষকে শাসন করতে থাকে। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ/স্বাধীনতা  আন্দোলনের পর ভারতবর্ষকে বৃটিশ রাজা তাদের সা¤্রাজ্যের অংশ করে নেয়। বৃটিশরাজ নূতন আঙ্গিকে এই উপনিবেশকে সাজাতে শুরু করে। বিভিন্ন প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক নীতিমালা দ্বারা “ভাগ এবং শাসন করে” শাসন ব্যবস্থা চালু করে। তার অংশ হিসেবে ১৯০৫ সালে তথাকথিত প্রশাসনিক সুবিধা এবং বঞ্চিত মুসলিমদের সুবিধা প্রদানের জন্য বাংলাকে পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত করা হয়। এই বিভক্তি কলিকাতাকেন্দ্রীক হিন্দু বুদ্ধিজীবি, বনিক এবং ধর্মীয় নেতারা গ্রহণ করেননি এবং স্বদেশী স্বশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বৃটিশ শাসনের এই কার্যক্রম বন্ধ করতে চেয়েছিল। হিন্দুদের বিরুদ্ধাচরণের কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ স্থগিত করা হয়। বৃটিশ রাজাকে সমর্থনকারী অঞ্চলের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে কলিকাতা হতে দিল্লীতে ১৯১১ সালে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। একইভাবে ১৯২৭ সালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৩৫ সালে বার্মা এ্যাক্টের মাধ্যমে বার্মাকে ভারত হতে সম্পূর্ণ পৃথক প্রশাসনিক প্রদেশ করা হয়। 

ঐতিহাসিকভাবে বার্মা, ত্রিপুরা ও বাংলার সুলতানরা চট্রগ্রামসহ বাংলা, ত্রিপুরা ও উত্তর পূর্বাংশের অঞ্চলসমৃহের আধিপত্য নিয়ে প্রায়শই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতো বৃটিশ শাসনকালে উত্তরপূর্ব অঞ্চলের দূর্ধর্ষ পাহাড়ী নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠি যেমন মগ, নাগা, মিজো ইত্যাদির আক্রমন হতে সমতলভূমির অধিবাসীদের জন্য বাফার অঞ্চল হিসাবে ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্রগ্রাম এর সৃষ্টি করে। পরবতীতে ঐসব অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তারের কারণে আক্রমনের সম্ভাবনা হ্রাসের সাথে পার্বত্য চট্রগ্রামের রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব হ্্রাস পায়। ১৯৩৫ সালে ভারত ও বার্মা এ্যাক্টের পরবর্তীতে তৎকালীন ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনীতি ও ভৌগলিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ভারতের উত্তর পূর্ব অংশ, বার্মার পশ্চিম এবং বাংলার কিছু অংশ নিয়ে একটি “স্বতন্ত্র রাজকীয় কলোনী” (যাতে খ্রীষ্টীয় ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ রয়েছে) গঠনের পরিকল্পনা করা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  কারণে সফল করা সম্ভব হয়নি। 
আমরা যদি দক্ষিণ এশিয়ার দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো যে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এইসব উপনিবেশসমূহ পর্যায়ক্রমে বৃটিশ গণতান্ত্রিক ধারাকে অনুসরণ করে (যদিও বৃটেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল) নিজস্ব রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ধারাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। তবে এই গণতান্ত্রিক ধারা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের আদল নিয়েছে। নেপাল (২০০৮ পর্যন্ত এবং বর্তমানে মন্ত্রী শাসিত সরকার) ও ভুটানে রাজতন্ত্র চলমান।

 বাংলাদেশে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি সরকারের বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন হলেও সর্বশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার ছিল। সামরিক ও বেসামরিক ক্যু এর মাধ্যমে প্রশাসনিক দূর্নীতি ও কুশাসনের অভিযোগে পাকিস্তান, বাংলাদেশে ও বার্মায় বিভিন্ন সময়ে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে। পরবতীতে সাংবিধানিক ও আইনী প্রক্রিয়ায় পুণরায় গণতান্ত্রিক সরকার এসেছে। সকল ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিসমূহ এইসব ক্যুতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল বলে জানা যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও বার্মায় সমাজতান্ত্রিক ও অর্থনেতিক বাজার ব্যবস্থা চালুর ব্যবস্থা নেয়া হলেও বর্তমানে মুক্তবাজার অর্থনীতি চলমান রয়েছে। নেপাল স্বঘোষিত একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ মুসলিম প্রধান দেশ এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ইসলামিক রিপাবলিক। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ ও হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র হলেও হিন্দুত্ববাদ চালু করা বর্তমান মোদী সরকারের ঘোষিত দলীয় এজেন্ডা। শ্রীলংকা, মায়ানমার এবং ভুটানে বৌদ্ধ ধর্মের জনবসতির আধিক্য রয়েছে। বার্মা ও শ্রীলংকায় উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। এই দেশসমূহের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান পারমানবিক শক্তিধর। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তান কমপক্ষে চারবার প্রত্যক্ষ সামরিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এখনও দুই দেশ যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। ভারত শ্রীলংকা ও মালদ্বীপে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। নেপাল, ভ‚টান ও আফগানিস্তান ভ‚মি বেষ্টিত দেশ। অন্যান্য দেশসমূহ বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগর দ্বারা বেষ্টিত। শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ প্রকৃতপক্ষে দ্বীপ রাষ্ট্র। বাংলাদেশ ও মালদ্বীপে এককেন্দ্রীক ও অন্যান্য দেশে বহুকেন্দ্রীক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত। সকল দেশে ব্রিটিশ পদ্ধতির সামরিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে। তবে আফগানিস্থানে রাশিয়া এবং বার্মায় চৌনিক প্রভাব লক্ষনীয়। সকল দেশেই স্বাধীনতা পরবতীতে ব্রিটিশ আইনকানুন, বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সীমিত সংশোধনসহ চালু আছে।

বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচক যেমন জনসংখ্যা, বৃদ্ধি খাদ্য উৎপাদন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ভঙ্গুঁরতা দূর্নীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ, বাসস্থান, সুপেয় পানি, বিদুৎতের ব্যবস্থা, আমদানী ও রপ্তানী অনুপাত, উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি বিচারে সকল দেশসমূহ তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বিবেচিত। শুধুমাত্র শ্রীলংকায় শিক্ষার হার ৯৭% অধিক। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভৌগলিক ও জনবলে সর্ববৃহৎ এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে সকল সময় জাহির করতে চায়। ভারতের সাথে অন্য সকল দেশের ক‚টনৈতিক , অর্থনৈতিক, ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক বিরোধ বিদ্যমান। ১৯৩৫ সাল হতেই ভ‚প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে বার্মা, ভারতের উত্তরপূর্ব অংশ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব অংশের (এইসব অঞ্চল পাহাড়ী বনাঞ্চল ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এবং অত্যন্ত দুর্গম) ক্ষুদ্র নৃতাত্তি¡ক গৌষ্ঠির সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের আলোকে নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে।

উপরোক্ত ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ভ‚প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামরিক এবং সর্বোপরি উপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয়ার ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ধারার সৃষ্টি হয়। ১৯৯০ সাল পরবর্তী ¯œায়ুযুদ্ধ (আমেরিকা ও রাশিয়া)  এবং ১৯৯০ পরবর্তীতে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির উত্থানের ধারা সৃষ্টি হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আছেন। ভ‚রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘ, আসিয়ান, সার্ক, জিসিসি ইত্যাদি বিভিন্ন উপ বা আঞ্চলিক শক্তি বলয় ও সমন্বয়ের মাধ্যমে আমেরিকা বিশ্ব ব্যবস্থায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। আমেরিকার বিভিন্ন স্ট্যাটেজিক চিন্তার ফসল ও তার বাস্তবায়নই বর্তমান বিশ্বের ভ‚ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রধান বিবেচ্য বিষয়। রাশিয়া, চীন, জাপানসহ কিছু সীমিত অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির উথান হলেও প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে আমেরিকাকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করার পূর্নাঙ্গ সক্ষমতা অর্জন করেনি। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর ভিত্তিক বিভিন্ন শক্তির (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া) পদাচারণ ও গুরুত্ব দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার ভূ-অথনৈতিক রাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। 

চীন, ব্যতিত ভারত একমাত্র রাষ্ট্র যার ভ‚এলাকা, জনবল, অর্থনৈতিক ব্যাপ্তি, প্রযুক্তির সক্ষমতা, সামরিক শক্তি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে গড়ে উঠতে সহায়ক হচ্ছে। কিন্তু জ্বালানী ও খনিজ সম্পদের সীমাবদ্ধতা, উপনিবেশিক শক্তির ন্যায় স্বাধীনতা পরবর্তীতে রাজনৈতিক কৌশল, আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্রমান্নয়ে স্ট্রাটেজিক পার্টনার সবার চেষ্টা ভারতকে এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। মার্কিন নীতি, চীনের সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্ধিতা এবং ভারত - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্ট্রাটেজিক অংশীদারীত্বের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত প্রতিবেশীদের সাথে বন্ধুত্বমুলক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের অনুঘটক হিসাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। 

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অদূরদর্শী রাষ্ট্র চেতনা ,অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং প্রকৃত দ্বিজাতি তত্তে¡র সফল বাস্তবায়নের ফসল বাংলাদেশ। সাময়িকভাবে ভারতের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থের বাস্তবায়ন হলেও এ দেশের জনগণ ঐতিহাসিক সত্য ও বাস্তবতাকে নিশ্চিত করেছে। ছোট ভ‚খন্ড, অর্থনৈতিক, ভৌগলিক ও রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ শত বাধা, বিপত্তি সত্তে¡ও ভারত ও অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের বিপরীতে বিশ্বের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় অর্থনীতি, ভ‚-রাজনৈতিক অনুঘটক, বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা, তরুণ জনশক্তির উৎস ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হয়েছে। জুলাই ৩৬ বিপ্লবের মাধ্যমে ননট্রাডিশনাল নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে পদদলিত করার প্রচেষ্টায় ছাত্র জনতা সৈনিকের অভুতপূর্ব গণঅভ‚্যত্থান ও বিপ্লব সারা বিশ্বের মানুষ ও শক্তিবলয়কে আশ্চর্যান্বিত করেছে। একই সাথে ড. মোহাম্মাদ ইউনুস কর্তৃক দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ এবং গৃহিত নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা বিশ্বে মেহনতী, বঞ্চিত মানুষ এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহকে নূতন আশার বার্তা দিয়েছে। এই বিপ্লব আঞ্চলিক ও বিশ্বের ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে করেছে সুদৃঢ়। আঞ্চলিক ভূ-অর্থনৈতিক রাজনীতির অন্যতম খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভ‚ত হবার বিশেষ সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে।

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, ভারতের উত্তর পূর্বের সাতটি রাজ্য এবং বার্মার রাখাইন স্টেট (বিশেষত রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অবস্থানের কারণে), বৃটিশ রাজত্বের সময়কালীন ঐতিহাসিক সত্য ও বাস্তবতা এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘটনাসমূহ পারস্পারিক সম্পর্কযুক্ত এবং কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনৈতিক এই সত্য এখন সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হয়েছে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল, ভারতের উত্তর পূর্বের সাতটি রাজ্য এবং বার্মার পশ্চিম অংশ বিশেষত: চিন ও রাখাইন প্রদেশ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূ-অর্থনৈতিক রাজনীতির নূতন রনাঙ্গণ। এই রনাঙ্গনের প্রতিটি কার্যক্রমের সাথে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং বিশ্বের পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিসমূহ নূতন আঙ্গিকে এই যুদ্ধে জড়িত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রের বার্মা এ্যাক্ট (২০২২) এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা অনুমোদন এ্যাক্ট (২০২৩) এর মাধ্যমে বিশ্বে একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট এই যুদ্ধ ও রনাঙ্গনের সৃষ্টি করেছে। চীনসহ অন্যান্য বিশ্ব শক্তিসমূহ (ইসরাইলসহ) এবং সম্ভাবনাময় আঞ্চলিক শক্তি ভারত এই যুদ্ধ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এই রনাঙ্গনের  সাথে বিভিন্ন দেশ ও শক্তির রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় স্বার্থ জড়িত। 

রোহিঙ্গাদের জোরপৃর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করায় বার্মা এবং বাংলাদেশ বিশেষত: ২০১৭ সাল হতে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। বার্মার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থবিরতা ভেঙ্গে ফেলতে এবং বার্মিজ  আর্মির ব্যর্থতায় রাখাইন রাজ্য তাদের স্বাধীকার আন্দোলনে সফল হবার উপক্রম হয়েছে। বার্মা এ্যাক্ট ২০২২ ও ২৩ এর সফল বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পূনর্বাসন প্রয়োজন। ভৌগলিক বাস্তবতায় শুধুমাত্র বাংলাদেশের পক্ষেই এই বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করা সম্ভব। এই যুদ্ধে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে পারলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রাখাইন রাজ্য ভৌগলিক ও ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের অংশ ছিল। চট্টগ্রামও পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে দীর্ঘদিন যাবৎ বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি বিদ্যমান। এ কথা সার্কভূক্ত সকল দেশ বিশ^াস করে যে আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত ভারত এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও শান্তিরক্ষার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলশ্রæতিতে দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারতের উত্তর রাজ্যসমূহের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অত্যন্ত সদিষ্ঠা থাকা সত্তেও বাংলাদেশ ভারতের ক্ষেত্রে সহযোগীতামূলক দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বর্তমানে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনীতির অংশীদার। এই সত্যটি ভারত স্বীকার করতে রাজী নয়। বিশ্বায়নের এই যুগে ভারত বাংলাদেশের বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নরম (ঝড়ভঃ চড়বিৎ) শক্তি হিসাবে আবিভর্‚ত হওয়াকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। 

অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক স্ট্যাটেজিক অংশীদার হিসেবে ভারতের অনুভ‚তি ও অনুরোধের কাছে কিছুটা বাধ্য হয়েই যুক্তরাষ্ট্রকে সুর মেলাতে হয়। বাংলাদেশকে ছোট রাষ্ট্র হিসাবে উপেক্ষা ও অনাদর করার অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তীতে ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বৃটিশ রাজ্য কর্তৃক বার্মা, ভারতের উত্তরপূর্ব অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামসহ পরিকল্পিত “রাজকীয় কলোনী” এবং একটি খ্রীষ্টিয় রাষ্ট্র সৃষ্টির নূতন রুপ আমেরিকার বার্মা এ্যাক্ট ২০২২ ও জাতীয় নিরাপত্তা অনুমোদন এ্যাক্ট ২০২৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাই বাংলাদেশকে ভারসাম্যমূলক অবস্থান সুনিশ্চিত করতে হবে। 

বর্তমান ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে প্রতিটি দেশকে তাদের জাতীয় স্বার্থসমুহ চিহ্নিত করতে হয়। অতপর রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব সঠিকভাবে দেশের জনগনকে সম্পক্ত করে জাতীয় নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি ও সংরক্ষন করতে থাকে। বাংলাদেশের ভেগৈলিক অবস্থান এবং ভূ-অর্থনৈতিক রাজনীতিতে অপূর্ব ভ‚মিকার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে এই চরম সত্যকে অনুধাবন করতে হবে। অত:পর তদানুযায়ী বিবিধ নীতিমালা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বের এই ছোট দেশকে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-অর্থনৈতিক রাজনীতিতে ক্রীড়ানক হিসাবে ব্যবহার করার জন্য সকল পক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা জারী রেখেছে। এটি একটি বিশাল জাতীয় দায়িত্ব। বিশেষতঃ জুলাই ৩৬ বিপ্লবের পরে অন্তবর্তীকালীন সরকারের গুরুদায়িত্ব হলো জাতীয় স্বার্থসমূহ রক্ষা করা। 

বার্মা এ্যাক্ট ২০২২ ও জাতীয় প্রতিরক্ষা অনুমোদন এ্যাক্ট ২০২৩ এর সমর্থনের ফলে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে চিন ও রাখাইন স্টেটে আরাকান আর্মি মায়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত সফলতা পেয়েছে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের মহাসচিব, শান্তিরক্ষা মিশনের আন্ডার সেক্রেটারি, প্রশান্তি মহাসাগর কমান্ডের সহকারী সামরিক কমাÐার, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুইজন এ্যাসিসট্যান্ট আন্ডার সেক্রেটারিসহ বিভিন্ন প্রতিনিধিদলের সাথে মতবিনিময় ও সমন্বয় চলমান আছে। ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাথে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংক্রান্ত উচ্চ প্রতিনিধির সাক্ষাৎ (পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা) হয়েছে। ড. মোহাম্মদ ইউনুসের চীন সফরের সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগীতা চাওয়া হয়েছে। ড. মোহাম্মদ ইউনুসের সাথে মায়নমারের সামরিক জান্তার সাক্ষাৎ ও আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান রাশিয়া সফর করে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগীতা বৃদ্ধির অনুরোধ করেছে। একই সাথে আরাকান আর্মির সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে সদিচ্ছা প্রকাশ করেছে। বান্দরবন সীমান্তের ১০ কি: মি: অভ্যন্তরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের উপস্থিতিতে আরাকান আর্মির স্থানীয় নেতৃত্ব স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে অংশ নিয়েছে। আরাকান আর্মি প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও রোহিঙ্গা শরনার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যাপারে সদিচ্ছা প্রকাশ করেছে। সকলের সহযোগীতায় একটি “মানবিক করিডর” স্থাপনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এমন সময়ের অপেক্ষায়। সবই ঠিক আছে কিন্তু দেশবাসী সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের অবস্থান ও ভ‚মিকা নিয়ে শংকিত। প্রকৃত কারণ হলো, যে কোন সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসযোগ্য উৎস হতে এই অঞ্চলের বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে যথাসময়ে জনগণকে জানানো হচ্ছে না। বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি বিপদজনক প্রক্রিয়া ও অবস্থা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কেননা এররকম পরিস্থিতিতে বিবিধ সুবিধাভোগীরা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। 

ভারতের মনিপুর রাজ্যে পরিস্থিতির অবনতির কারণে রাষ্টপতির শাসন জারী হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে বিগত স্বৈরাচারীর সরকারের সমর্থনে উত্তরপূর্ব রাজ্যসমূহের সাথে রেল, সড়ক ও নৌপরিবহনে জন্য বিবিধ প্রকল্পসমূহ ভারত সরকার স্থগিত করেছে। আরাকান আর্মির  সাথে বাংলাদেশের জুলাই ৩৬ বিপ্লবের পর ভারত সরকার কুটনৈতিক ও গোয়েন্দা যোগাযোগ সাম্প্রসারিত করেছে। মনিপুর রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইজরাইল এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন শংকা প্রকাশ করেছে। উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান ও রাশিয়া সাথে মায়ানমারে সামরিক জান্তার সম্পর্ক ও সহযোগীতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট সুবিধাদি উভয় পক্ষ বাতিল করেছে। নেপাল ও ভুটান পণ্য আমদানী ও রপ্তানীর ক্ষেত্রে সৈয়দপুর বিমানবন্দর এবং চট্রগ্রাম ও মংলা বন্দর সুবিধাদি ব্যবহারে অধিকতর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। 

স্বৈরাচারী হাসিনা ও তার দোসরদের ভারতে আশ্রয়, সহযোগীতা, প্রপাগান্ডা এবং গোয়েন্দা অপারেশন পরিচালনার মাধ্যমে ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণ ও অন্তবর্তীকালীন সরকারের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। পাবর্ত্য চট্রগ্রাম শান্তিচুক্তি (১৯৯৭) পরবর্তীতে বিভিন্ন সন্ত্রাসীদলের সৃষ্টি এবং ভারতের সহযোগীতা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তায় বিরাট হুমকী হিসবে চলমান রয়েছে।

বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক এই ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দ্বন্ধে বাংলাদেশকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, মানবিক এবং সামরিক শক্তিতে স্বনির্ভর ও ন্যায়ের পক্ষের যোদ্ধা হিসাবে অবস্থান নিশ্চিত করে দেশবাসী ও বিশ্বব্যাসীর নিকট তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদেরকে প্রতিটি পদক্ষেপে স্বকীয়তা বজায় রেখে জাতিসংঘের উপর আস্থা ও নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে। আসিয়ান ও সার্কের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় মায়নমায়ের স্বাধীনতা  ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরত: নূতন মায়ানমার গঠনে সহায়তা করতে হবে। ভ‚-অর্থনৈতিক রাজনীতির ডামাডালে দক্ষিণ এশিয়ায় যদি একটি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হয় (দক্ষিণপূর্বে বাংলাদেশের প্রতিবেশী) তার স্থিতিশীলতা রক্ষায় বার্মা এ্যাক্ট ২০২২ ও জাতীয় প্রতিরক্ষা অনুমোদন এ্যাক্ট ২০২৩ সহায়ক হলেও ভারত, চীন, মায়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার পূর্বের ঐতিহাসিক যুদ্ধসমূহ নতুন আঙ্গিঁকে দক্ষিণ এশিয়ায় নুতনভাবে আবিভর্‚ত হবে। দীর্ঘদিনের বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের জাতিসত্ত¡া নিশ্চিকরণ, নিরাপদে প্রত্যাবর্তন এবং তাদের সামগ্রিক পুর্নবাসনের সফলতার উপরে এই এলাকার স্থিতিশীলতা ও শান্তি নির্ভরশীল। 

ঐতিহাসিকভাবে এটি স্বীকৃত যে বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় ও প্রতিবেশীর প্রতি সংবেদনশীল, মানবিক এবং সকল সময় বন্ধুত্বের হাত বাড়িতে দেয়। ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে প্রকৃতির সৌন্দর্যের ভরপুর এই শান্তিপূর্ণ এলাকাকে আমরা আর অস্থির করতে চাই না। বাংলাদেশকে তার আপন শক্তি, সক্ষমতা, আদর্শ এবং বাস্তবতাকে গ্রহণ করে জনগনকে সাথে নিয়ে চলতে হবে। জুলাই বিপ্লব আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে ১৯৭১ সালের ন্যায় দ্বিতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অন্য কোন দেশ বা শক্তির উপর নির্ভরশীল হবার প্রয়োজন নাই। বাংলাদেশের যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে তা আপন মহিমায় ভাস্কর হয়ে উঠবে। তাই ড. মোহাম্মদ ইউনুসকে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে সঠিকভাবে দিক নির্দেশনা দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থ হবার কোন সুযোগ নাই। কেননা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক, ভূ-অর্থনৈতিক রাজনীতিতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র হিসাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বর্তমান নেতৃত্ব ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের জনগণ এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা বিস্মিত করার যে কোন অপচেষ্টা রুখে দিবে। তারা প্রমান করবে যে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং তারা নিজেরাই দেশের নিরাপত্তা প্রদানে সক্ষম। 

ব্রিগে. জেনারেল মো. নাসিমুল গনি পিএইচডি, এএফবিøউসি, পিএসসি (অব.)