নারী সংরক্ষিত আসন নয়, চাই সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নারী নেতৃত্ব

প্রকাশ | ১৬ জুন ২০২৫, ১৭:৪৭

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
ছবি: যায়যায়দিন

আজকে যখন দেশে নারী নেতৃত্বের কথা বলা হচ্ছে, তখন আমাদের একবার থেমে ভাবতে হবে—এই নেতৃত্বটি আসলে কোথা থেকে আসছে? নারী কি সত্যিকার অর্থেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন, নাকি তাঁরা হয়ে উঠেছেন রাজনৈতিক কোটার অলঙ্কার মাত্র?

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বর্তমানে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে। এগুলোতে সরাসরি ভোট হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ আসনে তাদের অর্জিত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একটি ভাগ পায়, এবং নিজের পছন্দের নারীকে মনোনয়ন দিয়ে এমপি বানায়। অনেকাংশে এটি হয় ত্যাগী নেত্রীদের অবহেলার মঞ্চ, এবং প্রভাবশালী স্বামীদের স্ত্রীদের জন্য সংরক্ষিত ট্রফি।

এই পদ্ধতি যে কতটা অযৌক্তিক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জুলাই ২৪-এর গণআন্দোলন আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে—বাংলাদেশের তরুণ সমাজ কোটা নির্ভর পলিসি চায় না। তারা মেধা, শ্রম, এবং জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে নেতৃত্ব গড়ে উঠুক, এটাই চায়। সংরক্ষিত নারী আসন এখন আর নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক নয়, বরং এটি একটি গৃহস্থালী-সম্পৃক্ত ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে—‘অমুকের বউ’, ‘তমুকের আত্মীয়া’, কিংবা ব্যবসায়ী পরিবারের নামমাত্র প্রতিনিধি।

শফিক রেহমান একসময় এরশাদের ৩০টি সংরক্ষিত নারী আসনের পলিসিকে বিদ্রুপ করে লিখেছিলেন—‘সংসদে ৩০ সেট অলংকার’। সেই লেখার জেরে নিষিদ্ধ হয়েছিল ‘যায়যায়দিন’। অথচ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও প্রায় একই ধারায় চলছে এই অলঙ্কার স্থাপন।

প্রশ্ন হলো, তাহলে কী হবে? কীভাবে নারীদের সংসদে নিয়ে আসা যাবে, যাতে তাঁরা সম্মান নিয়ে নেতৃত্ব দিতে পারেন?

???? আমার প্রস্তাব: সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী আসন পূরণ করুন
সরকার চাইলে নারী নেতৃত্ব বিকাশে বাস্তবমুখী ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। যেমন:

১. আলাদা নারী নির্বাচনী এলাকা (Women’s Electoral Districts):

প্রতি ৩টি সাধারণ আসন মিলিয়ে একটি নারী আসনের জন্য একটি নতুন এলাকা নির্ধারণ করুন। এই আসনে শুধু নারী প্রার্থী দাঁড়াতে পারবেন, এবং ভোটার হবেন সাধারণ জনগণ—পুরুষ ও নারী উভয়ই।

২. সমান্তরাল ভোট (Parallel Ballot):

একইসাথে সাধারণ আসনের জন্য একজন প্রার্থী এবং নারী কোটা আসনের জন্য একজন নারী প্রার্থী—দুজনের জন্য পৃথক ব্যালট রাখা যেতে পারে। এতে করে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী এমপি নির্বাচন করা সম্ভব।

৩. সংরক্ষিত আসন তুলে দিয়ে রাজনৈতিক দলকে বাধ্য করুন:

প্রতিটি দলকে নির্বাচন কমিশনের নিয়মে বাধ্য করা যেতে পারে যাতে তারা ন্যূনতম ১/৩ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। এতে করে নারী প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এসে ভোট নিয়ে সংসদে প্রবেশ করবেন—যা সম্মানজনক ও টেকসই নেতৃত্ব নিশ্চিত করবে।

???? কেন এই পরিবর্তন জরুরি?
নারীর মর্যাদা রক্ষায়: একজন নারী সংসদ সদস্য যদি ভোট না নিয়ে, পরিচয়ের জোরে আসেন—তাঁর নিজেরই আত্মবিশ্বাস এবং গণমান্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে।
প্রতিনিধিত্বের সার্থকতা: যেসব নারী সংসদে আছেন, তাঁদের অধিকাংশই দেশের নারীদের বাস্তব সমস্যা, কর্মসংস্থান, নির্যাতন, কিংবা সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভূমিকা রাখেন না। কারণ, তাঁদের দায়বদ্ধতা থাকে না ভোটারদের কাছে।
পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্তি: রাজনীতির নারীদের বড় অংশ হয়ে উঠেছেন পরিবারের প্রতিনিধি, জনগণের নয়। এই ধারাকে থামাতে হলে কোটা ভিত্তিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
???? সংসদ নয়, চাই অংশগ্রহণমূলক সরকার
সবাইকে সংসদে ঢুকিয়ে দিয়ে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দরকার এমন একটি সরকার, যারা এক্সটার্নাল স্টেকহোল্ডারদের—নারী সংগঠন, সিভিল সোসাইটি, শিক্ষক, শ্রমিক, পেশাজীবী—সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়। সংসদ যেন শুধু এমপি রাখার জায়গা না হয়, বরং হয়ে উঠুক সৎ, জনপ্রিয় ও কাজ জানা প্রতিনিধিদের মঞ্চ।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষিত নারী আসন ব্যবস্থার বিলুপ্তির পক্ষে। অন্তত প্রথম ধাপে এটিকে সরাসরি নির্বাচনের আওতায় আনুন। নারী প্রার্থীরা জনগণের কাছে যান, ভোট চান, বিতর্কে অংশ নেন, মাঠে থাকেন—তাহলে তিনিই হবেন আমাদের প্রাপ্য নারী নেতৃত্ব।

আসুন, নারীর ক্ষমতায়নের নামে কৃত্রিম অলংকার নয়—প্রকৃত নেতৃত্বকে স্বাগত জানাই।

লেখক, 
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র