পোশাক শিল্পে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারের অপরিহার্যতা
প্রকাশ | ২৮ জুন ২০২৫, ১০:০৯

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্প মানেই ছিল সেলাই মেশিনের একটানা শব্দ। কিন্তু সেই চেনা শব্দের পাশে এখন জায়গা নিচ্ছে কম্পিউটারের নিরব অ্যালগরিদম আর কাপড়ের ভেতরে লুকানো ন্যানো প্রযুক্তির অদৃশ্য শক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), স্মার্ট কারখানা এবং আধুনিক উপাদানে তৈরি কাপড় বিশ্ব পোশাক শিল্পের চেহারাই পাল্টে দিচ্ছে। এই দ্রুত পরিবর্তনের মুখে বাংলাদেশ আজ এক বড় প্রশ্নের মুখোমুখি—আমরা কি বদলাতে পারব, নাকি পেছনে পড়ে যাব?
দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পোশাক খাত এগিয়েছে কম খরচে শ্রম, বড় আকারের উৎপাদন ও দ্রুত সরবরাহের ওপর ভর করে। এই মডেলই বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক করেছে। কিন্তু সময় বদলেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারা এখন শুধু সস্তা পণ্য চান না—তারা চাইছেন দ্রুত ডেলিভারি, নিখুঁত গুণগত মান, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত থাকুক। আর এসব চাহিদা পূরণে এআই এখন একটি অপরিহার্য প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে। এআই প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক কারখানায় ত্রুটি শনাক্তের হার ৯৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে এবং উৎপাদন দক্ষতা বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ইন্টারনেট-ভিত্তিক প্রযুক্তি (আইওটি) ব্যবহারে অপচয় কমেছে, সময় বাঁচছে। তবে প্রযুক্তিগত এই অগ্রগতির পেছনে লুকিয়ে আছে একটি কঠিন বাস্তবতা—চাকরি হারানোর ঝুঁকি।
গবেষণায় দেখা গেছে, অটোমেশনের ফলে পোশাক খাতে কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। সোয়েটার উৎপাদন ও কাটিং সেক্টরে এই হার আরও বেশি। অনেক বড় প্রতিষ্ঠান যেমন বেক্সিমকো ইতোমধ্যে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। বাংলাদেশের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির জন্য এটি একটি গভীর সংকেত।
এদিকে বৈশ্বিক বাজারেও আসছে নতুন বাধা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গ্রিন ডিল ও কার্বন বর্ডার ট্যাক্সের মতো উদ্যোগ বলছে, যেসব কারখানা পরিবেশ দূষণ করছে বা শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছে না, তারা বাজার হারাবে। টিকে থাকতে হলে চাই পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, ডিজিটাল স্বচ্ছতা এবং নৈতিকতার প্রতিশ্রুতি। ভিয়েতনাম, ভারত ও তুরস্ক ইতোমধ্যে এগিয়ে গেছে স্মার্ট ফ্যাক্টরি, ব্লকচেইন এবং ডিজিটাল ডিজাইনের পথে। অথচ বাংলাদেশের প্রস্তুতি সূচক মাত্র ০.৩৮—অত্যন্ত নিচু।
এই সংকটের মাঝেও আছে এক বিশাল সম্ভাবনা—ন্যানো প্রযুক্তি। অতি ক্ষুদ্র কণাকে কাপড়ের আঁশে মিশিয়ে এমন ফ্যাব্রিক তৈরি হচ্ছে যা পানি বা দাগ প্রতিরোধ করে, ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে এবং সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মিও প্রতিহত করে। এসব আধুনিক পোশাকের চাহিদা বিশ্বজুড়ে বাড়ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ন্যানো টেক্সটাইল বাজার ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে পূর্বাভাস। বাংলাদেশ চাইলে এই উচ্চ-মূল্যের বাজারে প্রবেশ করতে পারে—শুধু দরকার এখনই পদক্ষেপ নেওয়া।
বর্তমান ফ্যাশন শিল্প শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়, বরং আরও বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও নৈতিকভাবে জবাবদিহিমূলক। জেনারেটিভ এআই এখন এমন ডিজাইন তৈরি করতে পারে যা আগে মানুষের কল্পনার বাইরে ছিল। ক্রেতারা এখন পছন্দের পোশাক নিজের মাপ অনুযায়ী অর্ডার করছেন, যা কয়েক দিনের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে। পাশ্চাত্য ক্রেতারা আরও এগোচ্ছেন ‘নৈতিক এআই’-এর দিকে, যা শ্রম অধিকার ও পরিবেশগত প্রভাব পর্যবেক্ষণে সক্ষম। বাংলাদেশের প্রচলিত গণ-উৎপাদন ব্যবস্থা যদি এই বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারে, তাহলে ক্ষতির আশঙ্কা খুবই বাস্তব। এই রূপান্তর মোকাবিলায় বাংলাদেশের সামনে তিনটি প্রধান করণীয়—প্রথমত, উন্নত এআই ও ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ; দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের আধুনিক দক্ষতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া; এবং তৃতীয়ত, ন্যানো ও ব্লকচেইন প্রযুক্তিকে উৎপাদনের অংশ করা। এর পাশাপাশি দরকার সরকার, শিল্পপতি ও উন্নয়ন অংশীদারদের সমন্বিত উদ্যোগ, যার মাধ্যমে তৈরি হবে উদ্ভাবনকেন্দ্র, টেকসই উৎপাদন পদ্ধতি এবং নৈতিক ব্যবসার কাঠামো।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বহু বছর ধরে আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কিন্তু এখন শুধু কম মজুরি আর বেশি উৎপাদনে আর টিকে থাকা যাবে না। দরকার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, দ্রুত সিদ্ধান্ত এবং সম্মিলিত প্রয়াস। কারণ বিশ্ব ফ্যাশন এখন বুদ্ধিমত্তা, নিখুঁততা, পরিবেশ সচেতনতা এবং ব্যক্তিগত পছন্দনির্ভর সেবার দিকে এগোচ্ছে। আমরা যদি এখনই প্রস্তুতি না নিই, তাহলে প্রতিযোগিতার এই রেশ ধরে রাখা কঠিন হবে। ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে না। সেটি তৈরি হচ্ছে—এই মুহূর্তে, আমাদের সঙ্গে অথবা আমাদের ছাড়া।
লেখক : গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র