আশুরা: অশ্রুর আরশে জেগে থাকা আত্মত্যাগের অনন্ত দিবস

প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০২৫, ০৯:২৬

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রতিটি জাতির ইতিহাসে কিছু দিন থাকে যেগুলো ক্যালেন্ডারের পাতায় নয়, বরং স্মৃতির প্রহরে প্রহরে দগদগে হয়ে জেগে থাকে। 

ইসলামি জগতে এমন একটি দিন হলো আশুরা—মহররমের দশম দিন। এ দিন কোনো কেবল তারিখ নয়, এটি এক করুণ কাব্যের নাম, যার প্রতিটি চরণ রক্তে লেখা, প্রতিটি পঙ্‌ক্তি ব্যথায় মোড়ানো। এই দিন একদিকে যেমন মুক্তির উল্লাস, অন্যদিকে তেমনি আর্তনাদের অনুরণন।

আশুরা—এক দিকে নবুয়তের ইতিহাসের সুবর্ণ আলোকবর্তিকা, আরেক দিকে মানবতার রক্তাক্ত ব্যঞ্জনা। এ দিনে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর প্রিয় নবীদের মুক্তি দিয়েছেন, আবার এ দিনেই মদীনার মাটি থেকে অনেক দূরে, ফোরাত নদীর তীরে, বালুর তপ্ত প্রান্তরে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল রাসূলের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.)-এর পবিত্র দেহ।

এই আশুরা আমাদের দেয় দ্বিধায় বিভক্ত হৃদয়ের সামনে এক অবিচল আলোকস্তম্ভ—এক দিকে চেয়ো, দেখবে মুসা (আ.) সমুদ্র দ্বিখণ্ডিত করে নিয়ে যাচ্ছেন মুক্তির দিকে; অন্য দিকে চেয়ো, দেখবে হুসাইন (রা.)-এর কণ্ঠনালী ছিন্ন করে প্রতিষ্ঠা করছেন সত্য ও ন্যায়ের শেষ স্তম্ভ।

মহররমের এই মহিমান্বিত দিনটি যখন কুরআনে উচ্চারিত হয়, তখন তা সম্মানিত মাসগুলোর অন্যতম হিসেবে উল্লিখিত হয়—“আল্লাহর নিকট মাসসমূহ বারোটি… এর মধ্যে চারটি সম্মানিত।” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ৩৬)। এ সম্মানিত মাসের প্রথমটি মহররম, আর আশুরা তার সর্বোচ্চ তকমা।

মদিনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) লক্ষ্য করলেন, ইহুদিরা আশুরার রোজা পালন করছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা জানাল, এই দিনেই মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা মুক্তি পেয়েছিলেন ফিরআউনের জুলুম থেকে। রাসূল (সা.) বললেন, “আমরাই তো মুসার প্রতি অধিক হকদার।” এবং তিনি রোজা রাখলেন, আদেশ দিলেন উম্মতকেও।

কিন্তু ইতিহাস থেমে থাকে না একটি পর্বে। সময় পেরিয়ে যায়, চেতনার জোয়ারে নিয়ে আসে এক এমন এক ঝড়, যার নাম কারবালা। ৬১ হিজরি, মহররমের ১০ তারিখ, ইতিহাসের বুক চিরে ছুটে আসে এক মহা ট্র্যাজেডি।

সেদিন ছিল না কোনো রাজকীয় রথ, ছিল না শানশওকতের বাহার। ছিল ক্ষুধা, পিপাসা, শিশুর কান্না, নারীর আর্তনাদ। তবু সেই দৃশ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল এক প্রাচীন বিশ্বাস—“জীবন যাবে, কিন্তু সত্য মাথা নত করবে না।”

ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কণ্ঠে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল কুরআনের আয়াত—"বলুন, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু—all are for Allah..." তিনি জানতেন, যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে সে হয়তো হারায় প্রাণ, কিন্তু পায় অনন্ত প্রতিষ্ঠা।

কারবালা আমাদের শেখায় যে, সংখ্যায় বড় হলেই জয়ী হওয়া যায় না; জয় হয় সেই জায়গায়, যেখানে থাকে নৈতিক দৃঢ়তা। ইয়াজিদের হাজারো সৈন্য এক মুহূর্তের জন্যও হুসাইনের সাহস ভাঙতে পারেনি। বরং হুসাইনের এক ফোঁটা রক্ত গোটা মানবজাতিকে চিরকাল মনে করিয়ে দিয়েছে—শহীদরা মরেন না, তারা ইতিহাসের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

আশুরা মানেই কেবল শোক নয়। এটি আত্মার এক পরিশুদ্ধ যাত্রা। রাসূল (সা.) বলেন, “আশুরার রোজা পালন করলে তা পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়।” এই রোজা কেবল খাদ্য বর্জনের নাম নয়; এটি মনের ময়লা ধুয়ে ফেলার এক আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া। এই দিনে আল্লাহ তাঁর বান্দার অন্তরের দিকে তাকান, যারা হুসাইনের মত বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, আর ইয়াজিদের মত অন্যায়ের পাশে চুপ করে না থাকে।

হুসাইন (রা.) কাঁদতে শেখান না, প্রতিবাদ করতে শেখান। তাঁর জীবন একটি জীবন্ত কবিতা, যেখানে প্রতিটি স্তবক একটি করে সংগ্রাম, প্রতিটি অলংকার একটি করে আত্মত্যাগ। কারবালার বালুয়ায় যে রক্ত ঝরেছিল, তা মিশে গেছে ইসলামের আত্মায়। তাই তো কেউ বলেন—“ইসলাম বেঁচে আছে হুসাইনের রক্তে।”

এই দিনে আমাদের অশ্রু ঝরে ঠিকই, কিন্তু সেই অশ্রু হতে হবে শুদ্ধতার প্রতীক। আমরা কাঁদব, কিন্তু সেই কান্না হবে প্রতিজ্ঞার কান্না—“আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াব, হুসাইনের চেতনায় জ্বলব।”

আশুরা আমাদের কাছে এক আত্মজিজ্ঞাসা। আমরা কী হুসাইনের পথে চলছি, না ইয়াজিদের পথে নিঃশব্দে হাঁটছি? আমরা কি সত্য বলছি, নাকি সুবিধাবাদে নত হচ্ছি?

কারবালার ময়দান আমাদের বলে দেয়—একজন মানুষ, যদি তাঁর সঙ্গে থাকে আল্লাহর ভয় আর সাহস, তবে সে একাই একটি উম্মাহ। ইমাম হুসাইন (রা.)-এর পরিবারসহ ৭২ জন সঙ্গী আজ কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে চিরজাগরুক, আর ইয়াজিদের হাজারো সৈন্য ইতিহাসের অন্ধকার গলিতে হারিয়ে গেছে।

আশুরার শিক্ষা আজও নতুন করে দরজায় কড়া নাড়ে। আমাদের ঘরে, সমাজে, রাষ্ট্রে যখন অন্যায়ের বিষাক্ত বাষ্প ছড়িয়ে পড়ে, তখন আশুরা বলে—জেগে ওঠো, প্রতিবাদ করো, আত্মা দিয়ে নির্মাণ করো সত্যের মিনার।

এই দিনে রোজা রাখো, হৃদয় পবিত্র করো, জীবন বিশুদ্ধ করো। নিজের ভেতরের ইয়াজিদকে হত্যা করো, আর জাগাও হুসাইনের চেতনা।

আশুরা তাই একটি আহ্বান—আল্লাহর প্রতি ফিরে যাওয়ার, রাসূলের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার, শহীদ হুসাইনের পথ অনুসরণে দৃঢ় হওয়ার।

এই আহ্বান সময়ের সীমানা পেরিয়ে অনন্তে পৌঁছায়। যতদিন অন্যায় থাকবে, ততদিন হুসাইনের নাম উচ্চারিত হবে আত্মার স্পর্ধায়। যতদিন নির্যাতিত হবে সত্য, ততদিন আশুরার মাটিতে প্রতিধ্বনিত হবে—

“হে ফোরাত! তুমি সাক্ষী থাকো, আমরা হুসাইনের সৈনিক, এবং চিরকালই থাকব।”

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর
✆ +201503184718
[email protected]