গাজীপুরে মেয়র প্রার্থীদের ‌নাগরিক সংলাপ -এ আনলো সুজন

প্রকাশ | ০৩ মে ২০২৩, ২৩:৪০

গাজীপুর প্রতিনিধি

আসন্ন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের ’এক টেবিল’-এ নাগরিক সংলাপের আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। বুধবার দুপুরে গাজীপুর প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ওই সংলাপে আওয়ামীলীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাহ্ খান, বিএনপি পরিবারের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহানূর ইসলাম, আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল্লাহ্ আল মামুন মন্ডল ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী আতাউর রহমানসহ ৭ মেয়র প্রার্থী অংশ নেন। তবে মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়দা খাতুন সংলাপে অংশ নেননি। এতে পেশাজীবী ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দও অংশ নেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের নাগরিক সংলাপে যোগ দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনকে অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাগিদ দেন। অন্য দিকে আওয়ামীলীগের প্রার্থী সিটি করর্পোরেশনে জনগণকে সংম্পক্ত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চান। সুষ্ঠ ভোট অনুষ্ঠিত করতে ক্ষমতাশীন দলের প্রতি আহবান জানায় সুজনের কেন্দ্রীয় নেতারা।  সুশাসনের জন্য নাগরিকের আয়োজনে গাজীপুর সিটি করর্পোরেশন নির্বাচনে প্রত্যাশা ও করনীয় শীর্ষক নাগরিক সম্মেলনে এক টেবিলে বসে নাগরিকদের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটের কথা শুনেছেন মেয়র প্রার্থীরা। পরে উপস্থিত নাগরিকদের প্রার্থীরা গাজীপুর সিটির বিভিন্ন সমস্যা সমাধান কল্পে নাগরিকদের জন্য প্রতিশ্রুতি তথা আশ^াসের কথা শোনান।

আওয়ামীলীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান, সিটি করর্পোরেশনে জনগণকে সংম্পক্ত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চান। অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান বলেন, একটি অর্গানোগ্রাম ছাড়া সিটি করপোরেশন চলছে। এটা কোনো অবস্থাতেই হতে পারে না। সার্ভিস রোল ছাড়া ১০ বছর যাবৎ সিটি করপোরেশন চলছে। আমি নির্বাচিত হতে পারলে প্রথমেই ৬ মাসের মধ্যে একটি অর্গানোগ্রাম এবং একটি সার্ভিস রোল তৈরি করা হবে।

সম্মেলেনে যোগ দেয়নি সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। এতে উপস্থিত নাগরিকরা বিগত ১০ বছরেও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পাড়ায় সাধারণ ভোটার ও নাগরিক সমাজ উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র’র সহ-সভাপতি জিয়াউল কবির বলেন, শ্রমিকরাই সিটির বৃহৎ অংশ। নিম্ন আয়ের পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেতন নিয়ে তাদের নির্বিঘ্নে ঘরে ফেরার নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বাস্তমুখী উদ্যোগ ও প্রকল্প গ্রহনের দাবি জনান।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, টঙ্গী সাংগঠনিক শাখার সভাপতি আনোয়ারা বেগম নারী অধিকার, হয়রানী মুক্ত, তড়িৎসেবা নিশ্চিতকরণে সিটি করপোরেশনের ভ’মিকা দেখতে চান।

গাজীপুর বিএম কলেজের সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান আকাশ’র জানান, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে যেসব পেশাজীবীরা ভোট গ্রহণের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদেরকে যেন কোন কিছুতে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা না হয়। তাদের আইশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক অথবা কোন না কোনো অদৃশ্য চাপে যেন তাঁর দায়িত্বটা অনৈতিকভাবে পালনের জন্য বাধ্য করা না হয়।

গাজীপুর ইমাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আবু বকর বলেন ইমামরা যেন মসজিদে সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ার জন্য তারা আলোচনা করতে পারে সেই নিশ্চয়তা চান। সিটি কর্পোরেশন যেন ইমামদের প্রতি দায়িত্ববান হোন।

গাজীপুর বেসরকারী হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সমিতির আব্দুস সালাম বলেন, আমাদের এ নগরীর হাসপাতালের বর্জ্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে ফেলা হয়। মেডিকেল বর্জ্য অপসারনের বিষয়টি আমাদের গাজীপুরেই যেন অপসারণ করতে পারি সে ব্যবস্থা করতে হবে।    

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান প্রার্থীদের এসব প্রতিশ্রুতির আশ^াস দেয়ার আগে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিগত সিটি নির্বাচনের মত ভোট কারচুপির নির্বাচন আর দেখতে চান না তাঁরা। আগে সুষ্ঠু নির্বাচন পরে হলো উন্নয়নের বিষয়। সুষ্ঠ ভোট করতে  তিনি সুজন ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি সহযোগিতার অনুরোধ জানান। এ সিটি গঠনের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার বৈষম্য করেছে। এ সিটির প্রথম নির্বাচিত মেয়রকে তার দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি। তাকে নির্যাতন করে জেলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় মেয়রকেও তারদায়িত্ব পালন করতে দেয়নি। অতএব আমি মনে করি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন একটি সুন্দর, সঠিক এবং পরিবেশ বান্ধব সিটি হোক এটা কেন্দ্রীয় সরকার চায় না। কেনা চায় না সেটা আমি জানি না। গাজীপুর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ফুসফুস তথা এদেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি গাজীপুর। গাজীপুরে এখানো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়নি। মন্ত্রী-এমপিরা রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা ব্যবহার করে প্রচারণা চালানোর অভিযোগ করেন। শুরু থেকে আমরা আলামত ভালো দেখছি না। আমি স্পষ্ট বলতে চাই আমরা নির্বাচনে এসেছি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। শিল্প অধ্যুষিত এ জেলায় শ্রমিকদের বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেতে হবে।      

গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি গত ৫ বছর আগে থেকে মেয়র প্রার্থীতা ঘোষনা দিয়েছি। ঘোষনার পর থকে নগরের ৫৭ টি ওয়ার্ডে ৫৭ হাজারের বেশি সমস্যা আমি খুঁজে পেয়েছি।

স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন মন্ডল বলেন, আমি মনে করি যেখানে হাজার কোটি টাকা বাজেট আমাদের সিটি কর্পোরেশনে রয়েছে সেখান থেকে শ্রমিকদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মান শুরু করে দেওয়া হলেও যেন একটি প্রক্রিয়া আমরা করতে পারি যেন শ্রমিক কলোনী হিসেবে প্রতিবন্ধি ও পিছিয়ে পড়া শ্রমিকদের বসবাসের জন্য ব্যবস্থা করতে পারি। এ নগরের সর্বোচ্চ আয় শিল্প-কলকারখানা এবং শ্রমিকের ঘাম জড়ানো অংশ থেকে আসে। বাংলাদেশের সর্বোচ্য রপ্তানী আয় আসে গাজীপুর থেকে। গাজীপুরের সমৃদ্ধ যে অর্থনীতি এটাও এখানকার শ্রমিকের ঘাম জড়ানো অর্থ থেকে। সরকারের কাছে বিশেষ আবেদন থাকবে শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকার জন্য এখান থেকে রাষ্ট্রের যে আয় হয়, তার একটা নির্দিষ্ট অংক যেন উন্নয়নের জন্য গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনকে দেয়া হয়। প্রাইভেট হাসপাতালের বর্জ্য বিশেষভাবে অপসারনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বায়ু দুষণ, শব্দ দূষন, পানি দূষন, নদী দূষন এবং দূষনমুক্ত নগরী গড়ে তুলতে হলে আগে বুকে ধারণ এবং মনে লালন করতে হবে। আগে সিটির উন্নয়ন করতে হবে। পরে পর্যায়ক্রমে সকল পেশাজীবী ও নগরবাসীর উন্নয়ন করা হবে। সিটি কর্পোরেশনে একটি অবাধ তথ্য সেন্টার থাকতে হবে যেন প্রতিদিন কি কাজ হচ্ছে এবং দুর্নীতি হলেই সেখানে থেকে যেন গণমাধ্যম কর্র্মীরা স্বাধীনভাবে তথ্য নিয়ে তা প্রকাশ করে নগরবাসীকে জানাতে পারবে। তিনি আরো বলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদবিাসী, উপজাতি ও মুসলিম সকল বর্ণ পেশার মানুষের জন্য মেহনতি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি শান্তির নগরী গড়ে তোলাই আমার মূল লক্ষ্য। আমি বিজয়ী হলে সকল প্রার্থীর সহযোগীতা নিয়ে সিটিকে আধুনিক ও স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তুলবো।


সুজনের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ভোট চুরি করে নির্বাচিত হওয়া যায়, তবে মানসিক তৃপ্তি আসে না। জনগণকে দেখলে মুখ লুকায় ওসব প্রার্থীরা। তাই সুষ্ঠ ভোট অনুষ্ঠিত করতে ক্ষমতাশীন দলের প্রতি আহবান জানান সুজনের কেন্দ্রীয় এই নেতা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রত্যাশা অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি, সকল দল ও প্রাথূদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, কালো টাকা ও পেশী শক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা বাহীনীসহ নির্বাচনে দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং ভোট কেন্দ্রে অনিয়ম হলে সেই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা ও প্রয়োজনে ফলাফল বাতিল করা।

সকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচণ অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগীতা দেওয়া এবং রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশ করেন যে কোনো মূল্যে  বিজয়ী হওয়ার মনোভাব ত্যাগ করে নির্বাচনকে একটি প্রতিযোগীতা হিসেবে গ্রহণ করা।

তিনি প্রার্থী ও সমর্থকদের কাছে প্রত্যাশা করেন, যথাযথভাবে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা, অর্থ বা কোনো কিছুর বিনিময়ে ভোট ক্রয় না করা, ভোটার বা প্রার্থীদের সমর্থকদের ভয়-ভীতি প্রদর্শণ না করা এবং যেকোন ফলাফল স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া।

স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহানুর ইসলাম  রনি বলেন, নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহীনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আমাদের কিছু প্রত্যাশা রয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের হালচাল তুলে ধরে বলেন সেই নির্বাচনে কতটা দুর্ণীতি, অনিয়ম হয়েছে আপনারা জানেন। বেলা ১১ টার পর থেকে আমাদের এজেন্ট পর্যন্ত উঠয়ে নেয়া হয়েছে। এবারের নির্বাচনে যদি এমন হয় তাহলে আমরা আপনাদের কাছে কি প্রত্যাশা করতে পারি। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব না। নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহীনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিশ্চিত করতে হবে যেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। আমার মনে হয় সুজনের নাগরিক সংলাপে আমরা যারা মেয়র প্রার্থী উপস্থিত হয়েছে তাদের সবার একটাই আশা যেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আমি কথা দিচ্ছি এ নগরের মানুষকে এবং মানুষের চাহিদাকে সামনে রেখে সকলের সহযোগীতায় এ নগরকে ঢেলে যেভাবে সাজাতে হয় সেভাবেই সাজাবো।


সংলাপ অনুষ্ঠানে সুজনের প্রধান সমন্বয়ক দীলিপ সরকার, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, সংঠনটির গাজীপুর কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আমজাদ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির অংশ নেন ।