এখনো পরিবারই লড়ছে

খালেদা জিয়া ফের তিন ঘণ্টা সিসিইউতে

প্রকাশ | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:২০ | আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:৩১

হাসান মোল্লা

নিজের পরিবারের চেয়ে দলের স্বার্থকে বারবার এগিয়ে রাখতে দেখা গেছে বিএনপি চেয়াপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর দলের দুর্দিনে পরিবারের স্বার্থ তুচ্ছ করে পিতাহারা সন্তানদের চেয়ে দলকে বেশি সময় দিয়ে রাজপথের লড়াই করে দলকে বারবার ক্ষমতায় এনেছেন তিনি। আপসহীন পরিচিত পাওয়া এই নেত্রী দলের জন্য নিজের জীবন নিয়ে আপস করেছেন। দলের জন্য বারবার পরিবারকে পেছনে রাখলেও পরিবার কিন্তু তার দুর্দিনে সামনে থেকে লড়াই করছে। অথচ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা এই নেত্রীকে উন্নত চিকিৎসা পাইয়ে দিতে সরকারকে চাপে ফেলার মতো কোনো আন্দোলন দল করতে না পারলেও বিদেশে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কার্যকর এখনো লড়াই করে যাচ্ছে পরিবার। 

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার কারাভোগ শুরু হয়। দীর্ঘ ২ বছর এক মাস ১৭ দিন বন্দি থাকা বিএনপি প্রধানকে মুক্ত করতে আইনি লড়াই, নিরীহ গোছের আন্দোলন, কূটনৈতিক পর্যায়েসহ নানা মহলে দৌড়ঝাঁপ করে সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। সর্বশেষ জিয়া পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক দিক বিবেচনা করে শর্তসাপেক্ষে  মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার। শেষ গত মার্চে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ১২ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে শর্তসাপেক্ষে মুক্ত খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ। মুক্ত হওয়ার পর থেকে তাকে বারবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতা গুরুতর হলে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। গত ২২ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হাওয়ায় মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্ত করা হয়। গতকাল শুক্রবার বিকালে তার শারীরিক অবস্থার ফের অবনতি হলে তাকে কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তিন ঘণ্টা থাকার পর তাকে আবারও কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।

গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ড অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন  বলেন, ‘লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।’
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার তাকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে তার পরিবার। অনুমতি মিললেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী জার্মানি, যুক্তরাজ্য বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তারা। খালেদা জিয়াকে স্থায়ী মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর জন্য গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফের আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আবেদনটি দ্রুতই যাচাইবাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।

সরকার এ বিষয়ে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত পরিবারকে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি উল্লেখ করে খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার সংবাদ মাধ্যমকে জানান,  তারা অধীর আগ্রহে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন। 

পরিবারের সদস্যরা আশাবাদী, খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি পাবেন। আর তাই তারা বিশ্বের চার দেশে হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন।

এরই মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা সে বিষয়ে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। জবাবে জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে। পরিবারের এক সদস্য জানান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে তার উন্নত চিকিৎসা সম্ভব। তাই তারা ওই দেশগুলোয় খালেদা জিয়ার জন্য উপযুক্ত হাসপাতালের সন্ধান করছেন, যাতে তারা অনুমতি পাওয়ামাত্র অসুস্থ খালেদা জিয়াকে বাইরে নিতে পারেন।
চিকিৎসা বোর্ডের এক সদস্য বলেছেন, খালেদা জিয়ার এখন যে অবস্থা, তাতে তাকে বাইরে নেওয়া জরুরি।

সরকারের এক সূত্র মতে, সরকার খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি এখন অনেকটা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছে।
তবে গুঞ্জন রয়েছে, সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিলেও কিছু দেশের নাম উল্লেখ করে শর্ত দিতে চায়। সে ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড কিংবা এশিয়ার কোনো দেশে চিকিৎসা করাতে হবে। কিন্তু বিএনপি চায় জার্মানি কিংবা যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, বিএনপি চেয়ারপারসন আগে এসব দেশে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তা ছাড়া তার শরীরে যেসব রোগ রয়েছে এবং তার শরীরের বর্তমান যে পরিস্থিতি তার উপযুক্ত চিকিৎসা উল্লিখিত তিনটি দেশে সম্ভব।

এদিকে মুক্তি আন্দোলনের মতো খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর দাবি আদায়ের আন্দোলনেও ঢিলেঢালাভাবে করছে বিএনপি। দুই বছর ধরে জেলে থাকার পরেও মুক্তির ব্যাপারে সরকারকে চাপে ফেলার মতো কোনো আন্দোলন গড়তে যেমন পারেনি এবারেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আন্দোলনও জমাতে পারেনি দলটি। বহির্বিশ্বের চাপে কিছুটা বেকায়দায় থাকা সরকারকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে গত রোববার ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় বিএনপি। এই আলটিমেটামের দ্বিগুণেরও বেশি সময় শেষ হয়ে  হলেও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। আর বিএনপিও এ ব্যাপারে নতুন করে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণাও দেয়নি। ফলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও বেশ হতাশ।

যাযাদি/ এসএম