আওয়ামী লীগের ছাড়ই জাপা’র ভরসা!

প্রকাশ | ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৫২

রেজা মাহমুদ

গত দুই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের আসন ছাড়ে ভর করে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয়েছিল জাতীয় পার্টি। তবে এবারে জাতীয় পার্টি সে সুবিধা পাচ্ছে না। মূলত বিএনপি ভোটে না আসায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে কৌশলগত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এবার দলে মনোনয়ন না পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতেই বিপাকে জাতীয় পার্টিসহ মহাজোটের দলগুলোর প্রার্থীরা। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি এবারও বিএনপি নির্বচনে না আসে তাহলে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কমতে পারে। এটাই ক্ষমতাসীন দলের মূল চ্যালেঞ্জ। তাই দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেব নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগও করে দিয়েছে। এছাড়াও গত দুই নির্বাচনে মহাজোটের দগুলোকে যেসব আসন ছাড় দেওয়া হয়েছিল সেখানে হেভিওয়েট প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। 

দেখা গেছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানসহ কো-চেয়ারম্যান পদের নেতাদের বিপরীতে ঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাঈদ খোকন ও সালমান এফ রহমানের মতো হেভিওয়েটরা। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির ঘাঁটি খ্যাত রংপুরেও দলীয় কোন্দলের কারণে সেখানে মনোনয়ন পাননি বর্তমান দুই এমপি। 

ফলে মহাজোটের দলগুলো বিশেষ করে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের অনেক আসনেই নির্বাচিত হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর। যদি এই সময়ের মধ্যে আসন ছাড় না দেওয়া হয় তাহলে জাতীয় পার্টির নির্বাচনী হিসাব বদলে যেতে পারে। তবে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, শেষ মুহূর্তে হলেও কিছু আসনে তারা ছাড় পাবেন। 

অন্যদিকে জাতীয় পার্টির বিভক্তিতে সম্ভাব্য আসন ছাড়ের সংখ্যাকে প্রভাবিত করছে বলেও মনে করেন দুই পক্ষের নেতারা। ২৮৯টি আসনের নির্বাচনে এককভাবে প্রার্থী দিলেও মনোনয়ন পাননি দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও বর্তমান সংসদ সদস্য এরশাদ পুত্র সাদ এরশাদ। ফলে অনেকটাই নির্বাচনে না যাওয়ার পরিস্থিতি রওশনপন্থি নেতাদের। পার্টির নেতারা জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল না থাকলে জাতীয় পার্টি অন্তত ৩০টি আসনে ছাড় পেত। কিন্তু পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, সেই সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ। 
জানতে চাইলে রওশনপন্থি নেতা গোলাম মশি বলেছেন, সময় শেষের পথে কিন্তু সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। এমনকি এরশাদ পুত্র যে আসনের এমপি সে আসনও তারা দখলে নিয়েছে। অন্যদিকে মশিউর রহমান রাঙাসহ পার্টির রওশনপন্থি অনেক নেতার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার না করায় তাদের নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের গ্রিন সিগনাল পেলে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন তারা।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব প্রায় ৩০০ আসনে প্রার্থী দিলেও ভোটে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও মনোনয়ন না পাওয়া দলের প্রভাবশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না বলে মত প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টির অনেক প্রার্থী। রওশনপন্থিদের মতো তাদেরও প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রী কিছু আসন ছাড়বেন। তবে এই ছাড় প্রকাশ্যে নাও হতে পারে। 

জি এম কাদেরের অনুসারী জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা মনে করেন,  শেষ মুহূর্তে হলেও গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর ডাক আসবে। সেক্ষেত্রে জি এম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে সমঝোতা হলে পার্টির জন্য ভালো হবে। এছাড়াও জাতীয় পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক প্রার্থী আসন ছাড় না পেলে নির্বাচনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। 

পার্টির সিনিয়র নেতারা জানান, তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত জোটে ছাড় দেওয়া আসনে নৌকার প্রার্থী না দেওয়ার আশ্বাস ছিল ক্ষমতাসীন দলের। এমনকি এসব আসনে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী যেন না হন, কেন্দ্র থেকে সেই নির্দেশও দেওয়া হবে। কিন্তু এখন মনোনয়ন না পাওয়া নেতারাও স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। ফলে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর সঙ্গে লড়তে হবে তাদের। আপাত দৃষ্টিতে যা অসম্ভব বলেও মনে করেন তারা। 

এদিকে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের আসনেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের রংপুর-৩ ও ঢাকা-১৭ আসনের মনোনয়ন পেয়েছেন। এর বিপরীতে রংপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল, যা এরশাদের নির্বাচনী আসন হিসেবে পরিচিত। এরশাদের পর এই আসনে সংসদ সদস্য হন তার পুত্র সাদ এরশাদ। কিন্তু সেই উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি। 
এছাড়াও এরশাদের আরেক নির্বাচনী আসন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-১৭ আসন থেকেও মনোনয়ন কিনেছেন জি এম কাদের। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মোহাম্মদ আলী আরাফাত। জাতীয় পার্টির নির্ভরযোগ্য আরেক আসন রংপুর-১। রওশনপন্থি মশিউর রহমান রাঙ্গা এই আসনের এমপি হওয়ায় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তার স্থলে মনোনয়ন পেয়েছেন জি এম কাদেরের বড় ভাই মোজাম্মেল হোসেন লালুর ছেলে আসিফ শাহরিয়ার। দলীয় মনোনয়ন না  পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন রাঙ্গা। ফলে রংপুরের এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করীম রাজু তুলনামূলকভাবে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। 

এর বাইরে জাতীয় পার্টি ঢাকা-৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সানজিদা খানমের সঙ্গে। চ্যালেঞ্জে পড়তে পারেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি পেয়েছেন ঢাকা-৬-এর মনোনয়ন। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছেন সাবেক মেয়র ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ মোহাম্মাদ হানিফের ছেলে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। জাতীয় পার্টির আরেক কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলামের বিপরীতে ঢাকা-১ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এছাড়াও পটুয়াখালী-১ আসনে মনোনয়ন পাওয়া জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারকে প্রতিযোগিতা করতে হবে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনের সঙ্গে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ আসন ছাড় দিলেও জাতীয় পার্টি আগের মতো ছাড় নাও পেতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, নতুন রাজনৈতিক দল ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) নির্বাচনে গেলে তাদের বেশ কিছু আসন ছাড়া হতে পারে। 
মঙ্গলবার আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে সমঝোতা হলে জোটকে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একই ইঙ্গিত দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ডক্টর হাছান মাহমুদ। ফলে এটা স্পষ্ট অতীতের দুই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি যে পরিমাণ আসন ছাড় পেয়েছে এবার সেই ছাড় পাবে না। এছাড়াও আসন ছাড়ে সমঝোতার শর্ত রয়েছে ক্ষমতাসীনদের।

যাযাদি/ এস