নির্বাচনে হেরে ‘বিব্রত’ বোধ করছেন আ’লীগের সঙ্গীরা
প্রকাশ | ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:০০
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ও মিত্র দলের নেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ দিয়েছিল, তারা সে কথা রাখেনি। নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের অনেকেই এখন ‘বিব্রত’ এবং ‘প্রতারিত’ বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন। খবর বিবিসি বাংলা।
বিএনপিবিহীন এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আরও ২৬টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। এসব দলের মধ্যে ক্ষমতাসীনদের ১৫ বছরের জোটসঙ্গী জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টি যেমন ছিল, তেমনি ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জাতীয় পার্টিও।
এ ছাড়া ‘কিংসপার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি-সহ কয়েকটি ছোট দলকেও এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে দেখা গেছে।
নির্বাচনের আগে এসব দলের নেতারা ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে’ ভোট হবে বলে প্রচারণা চালালেও ভোটের ফলাফল দেখার পর এখন তারা উল্টো সুরে কথা বলছেন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘জনগণের ভোটে নয়, কারচুপির ভোটে আমাকে পরাজিত করা হয়েছে।’
এদিকে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের মিত্র জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্ট, এমনকি ‘কিংসপার্টি’গুলোর পক্ষ থেকেও। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আরও আসন পেতেন বলে দাবি করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
তবে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়া আওয়ামী লীগ অবশ্য জোটসঙ্গী ও মিত্রদের এসব কথায় মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘হেরে গেলে অনেকেই অনেক কথা বলার চেষ্টা করেন।’
উল্লেখ্য, বিএনপি-বিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২২টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ। এরপর সবচেয়ে বেশি ৬২টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের অধিকাংশই আবার আওয়ামী লীগেরই নেতা। কাজেই সহজভাবে বললে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে কেবল জাতীয় পার্টি ১১টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয় পেয়েছে। ফলে জাতীয় পার্টির জন্য এখন নতুন সংসদে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার ব্যাপারটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এদিকে রাজশাহী-২ আসনে টানা গত ১৫ বছর সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি এবারও আসনটিতে জোটের প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরেছেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিকুর রহমানের কাছে।
যদিও নির্বাচনের এই ফলাফল তিনি মেনে নেননি। অনিয়ম ও ভোট কারচুপির বিস্তর অভিযোগ তুলে ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে। ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অরাজকতা ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে তারা এই নির্বাচন করেছে।’
নির্বাচনে কী কী ধরনের অনিয়ম করা হয়েছে, তার একটি ফর্দ তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছেন বাদশা। সেখানে তার প্রধান দু’টি অভিযোগের একটি হচ্ছে- ভোটারদের মধ্যে যারা টিসিবি সুবিধা পান, তাদের কার্ড আটকে রেখে আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিকুর রহমানকে ভোট দিতে চাপ দেওয়া হয়েছে। আর দ্বিতীয় অভিযোগটি হচ্ছে- তার সমর্থকরা যাতে ভোটকেন্দ্রে না যান, সেজন্য নির্বাচনের দিন সকালে তাদের ‘হুমকি ও ভয়ভীতি’ দেখানো হয়েছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের জানিয়েছিলেন কী-না, এমন প্রশ্নের জবাবে বাদশা বলেন, ‘শতবার জানিয়েছি। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছি বলেছে, কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই দেখা যায়নি।’
ফজলে হোসেন বাদশার মতো একই ঘটনা ঘটেছে ১৪-দলীয় জোটের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে।
আওয়ামী লীগের জোট সঙ্গী হয়ে অতীতে মি. ইনু টানা তিন মেয়াদে কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, এমনকি মন্ত্রিত্বও পেয়েছেন একবার। অথচ সেই একই আসনে এবার নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেও তিনি স্বতন্ত্রপ্রার্থী কামারুল আরেফিনের কাছে পরাজিত হয়েছেন ২৩ হাজারেরও বেশি ভোটে।
আরেফিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতা, যাকে নিজ এলাকার বাইরে সেভাবে কেউ চেনেন না। অন্যদিকে, ইনু জাতীয় পর্যায়ের একজন সুপরিচিত প্রার্থী। কাজেই একজন উপজেলা পর্যায়ের নেতার কাছে ‘সুপরিচিত’ নেতার পরাজিত হওয়াটার ঘটনা সারা দেশেই বেশ আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে।
আর এতে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, ‘আমি বিব্রত হয়েছি। একটু বিব্রত হয়েছি।’
কিন্তু ক্ষমতাসীন দল থেকে যাকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, তাকে কেন এমন ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হলো? এ প্রশ্নের জবাবে ইনু বলেন, ‘জনগণ আমার পক্ষে ছিল, কিন্তু এখানে ১৮টি কেন্দ্রে ভোট কারচুপির মাধ্যমে আমাকে পরাজিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমাকে দলগতভাবে সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু তাদের ভেতরের একটি বড় অংশ আমার বিপক্ষে কাজ করেছে। তারাই এসব ঘটিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা বাকিদের সঙ্গে আলোচনা করব। জোটনেত্রী তখন কী নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সেটি দেখে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’
এদিকে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে জিতেছে এবং সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয়েছে।
এর মাধ্যমে তারা ২০০৮ সালে ২৭টি আসন, ২০১৪ সালে ২৯টি এবং ২০১৮ সালে ২২টি আসন পেয়েছিল। ফলে এবারও তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন গিয়েছিল।
দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, এবারও তাদের বিশ্বাস ছিল অন্তত দুই ডজন আসনে তারা বিজয়ী হবে এবং নতুন সংসদে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পাবে। কিন্তু নির্বাচন শেষে দেখা যাচ্ছে, দলটি এককভাবে জয় পেয়েছে মাত্র ১১টি আসনে।
নির্বাচনে নিজেদের এই পরিণতির জন্য এখন ক্ষমতাসীনদেরই দুষছেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তিনি বলেন, ‘উনারা (আওয়ামী লীগ) বলেছিলেন যে, সবখানে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি।’
নির্বাচনে ‘ব্যাপক ভোটকারচুপি’র অভিযোগ তুলে দলটির চেয়ারম্যান বলছেন, ভোট ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হলে তারা আরও বেশি আসন পেতেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বলছি না যে সবখানে বিজয়ী হতাম, কিন্তু আরও অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশটি আসনে ভালো রকম প্রতিদ্ব›িদ্বতা হতো।’
জিএম কাদের আরও বলেন, ‘কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল যেখানে আমাদের এবং নৌকার প্রার্থী ছিল, সেখানে লাঞ্চের পর থেকে ঢালাওভাবে সব ভোটকেন্দ্র দখল করে তারা ভোট দিয়েছে।’
এ ছাড়া নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে ২৬টি আসনে ছাড় দেওয়া হয়েছিল, সেখানেও এখন ‘ষড়যন্ত্রের’ গন্ধ পাচ্ছে জাতীয় পার্টি। এ বিষয়ে জিএম কাদের বলেন, ‘আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আলাপ-আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু তারা নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে আসন ভাগাভাগির কথা জানালো। এটা ইচ্ছাকৃত, নাকি ভুল জানি না। তবে নানাভাবে আমরা একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গেছি।’
‘প্রতারিত’ বোধ করছে কিংস পার্টিগুলো
এদিকে এবারের নির্বাচনে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি শুরু থেকেই বেশ আলোচনায় ছিল। ক্ষমতাসীনদের সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তারাও ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হবে’ বলে প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, দলগুলোর অধিকাংশ প্রার্থীই জামানত হারিয়েছেন।
ফলে এখন তাদের সুরও পাল্টাতে শুরু করেছে। নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে এবার ভোটে দাঁড়িয়ে জামানত হারিয়েছেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার। তার আসনে প্রায় পৌনে চার লাখ ভোটারের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভোটার ভোট দিয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তিনি পেয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ১৯০ ভোট। তিনিও এখন ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলছেন।
তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘যত ভোট পড়েছে বলে দেখানো হচ্ছে, সেটা হাস্যকর। বাস্তবে এতো পড়েনি। এটা কোনো নির্বাচনই হয়নি।’
একই কথা বলছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনি ফরিদপুর-১ আসন থেকে নির্বাচনে করে জামানত হারিয়েছেন। আসনটিতে গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হলেও সেটি মানতে নারাজ তিনি।
শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর বলেন, ‘মাঠে আমরা যে চিত্র দেখেছি, তাতে ১২ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা না। ম্যাকানিজম করে ভোট বাড়ানো হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ কী বলছে?
ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে জোটসঙ্গী ও মিত্র দলের নেতারা আওয়ামী লীগকে সরাসরি প্রতিশ্রæতি ভঙ্গের জন্য দায়ী করলেও সেটি নিয়ে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না ক্ষমতাসীনদের। ভোটে হেরে যাওয়ার ব্যর্থতা ঢাকতেই মিত্ররা এমন ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগ তুলছেন বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘জনগণ ভোট না দিলে সে দায় আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপানোর কোনো সুযোগ নেই।’
আওয়ামী লীগের ভাষ্য হচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। নাছিম বলেন, ‘নিবাচন যে সুষ্ঠু-সুন্দর হয়েছে, সেটা সবাই দেখেছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও বলেছে। কাজেই এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে শোভনীয় নয়। এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা উচিত।’
যাযাদি/ এসএম