যেভাবে ছাত্রলীগ দানবীয় হয়ে ওঠে

প্রকাশ | ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৭:৪২

যাযাদি ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মূল দাবিই ছিল নতুন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরের পাঁচ দশকে ক্রমে গড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ভেঙে  বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠন। এমন স্বপ্ন দেখেই হাজারো ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছেন। পঙ্গুত্ববরণ করেছেন আরও কয়েক হাজার মানুষ। হাত-পা, চোখ বা অন্য অঙ্গহানি হওয়া অনেকে এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। 

ফ্যাসিবাদী শাসন উৎখাতে রাস্তায় নামা মানুষকে যে বর্বর কায়দায় দমনের চেষ্টা করা হয়েছে তা স্বাধীন দেশে নজিরবিহীন ঘটনা। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে মানুষ হত্যার মতো নৃশংস কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে সহযোগী হয়েছিল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। 

অস্ত্র হাতে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে নামা এই সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে। 

ছাত্রলীগ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবি উঠেছিল আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পরই। এই দাবির প্রেক্ষিতে সরকার নির্বাহী ক্ষমতাবলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। 

যদিও নিষিদ্ধ করার এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলছেন, ছাত্রলীগের অপরাধ প্রমাণিত। গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের নিষিদ্ধ করা গেলে এটি আরও  টেকসই হতো। 

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার পক্ষে যারা বলছেন তাদের দাবি, এটি এখনই করার দরকার ছিল। কারণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়ানো এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে নয়া একটি বার্তা দেয়া হয়েছে। যে দাবি নিয়ে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছেন তা বাস্তবে রূপ দিতে ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতিতেও বড় পরিবর্তন দরকার। 

নতুন বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রায় তিন মাস হতে যাচ্ছে। এই সময়ে এসব দল ও সংগঠনের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন লক্ষণীয় নয়। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতীত চরিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। এটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখা মানুষকে হতাশায় ফেলেছে। 

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি থাকবে কী থাকবে না- এ নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি নয়, ছাত্রদের কল্যাণে ছাত্ররাজনীতি চলতে বাধা নেই- এটাও অনেকে বলছেন। কারণ অতীতে নানা আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা বড় ভূমিকা রেখেছে। ’২৪-এর গণআন্দোলনের মূলেও ছিলেন শিক্ষার্থীরা। আর এসব আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা ছিল। 

আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ১৫ বছরের শাসনে যে নজিরবিহীন সন্ত্রাসী ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করেছে তা আওয়ামী লীগের এমন পতনের জন্য একটি অন্যতম অনুষঙ্গও ছিল। অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ যে চরম ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছিল তার একটি বড় উদাহরণও ছিল এই ছাত্রলীগ। 

এক সময় ছাত্রলীগ করা নেতারা অনেকে এখন আওয়ামী লীগের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অতীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখা এসব নেতারাও ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে বিবেচনা করেন না। সংগঠনটির অতীত চরিত্রের সঙ্গে অতি সাম্প্রতিক চরিত্রের মিল খুঁজে পান না। তাদের ভাষায় এটি ছাত্রলীগের দুঃখজনক পরিণতি। 

১৯৪৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার এক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ছাত্রলীগের। তখন অবশ্য এই সংগঠনের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এর এক বছর পরে জন্ম হয় আওয়ামী লীগের। ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বড় ভূমিকা ছিল ছাত্রলীগের। 

এমনকি ’৯০- এর গণআন্দোলনেও সামনের সারিতে ছিল ছাত্রলীগ। যদিও স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই ছাত্রলীগের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক হয়। 

সর্বশেষ আওয়ামী লীগের টানা শাসনামলে ছাত্রলীগ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের শাসন জারি করেছিল। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠন প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালানোর মতো সাহসও পেতো না। 

হলগুলোতে এক অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। বিরুদ্ধ মতের শিক্ষার্থীদের শিবির বা জঙ্গি আখ্যা দিয়ে ইচ্ছেমতো পেটানো, পুলিশে দেয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব কাজ করেছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। কিন্তু কেউ এসব কাজকে অপরাধের চোখে দেখেনি। শাস্তি তো দূরের কথা। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে দানবীয় হয়ে ওঠা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

এযাবৎকালের ছাত্রলীগের অপকর্মের ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। দেশের নানা এলাকায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণের মতো ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে সময়ে সময়ে। দুর্নীতি ও চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের তৎকালীন কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনাও ঘটে।

ছাত্রলীগের দানবীয় আচরণের সর্বশেষ শিকার হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনে ছাত্রলীগ মারমুখী হয়ে ওঠার জেরেই আন্দোলন ব্যাপকতা পায়। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও মারধরের ঘটনায় সড়কে নেমে আসেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

যাযাদি/ এম