সহযোগিদের বিশেষ প্রতিবেদন
রাজধানী মেহেরপুর, হেডকোয়ার্টার রাশিয়া
প্রকাশ | ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৩০ | আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৭

কালবেলা
রাজধানী মেহেরপুর, হেডকোয়ার্টার রাশিয়া
খান মাহমুদ আল রাফি, মেহেরপুর : মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বিশ্বনাথপুর-শিবপুর সড়কে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে একটি নির্মাণাধীন বাগানবাড়ি দেখালেন স্থানীয় আবুল হোসেন। বাহারি কারুকার্যখচিত রাজকীয় ঢঙের বাগানবাড়িটি বানাচ্ছেন মোরশেদ আলম লিপু। মাত্র ২৮ বছর বয়সী লিপুর দৃশ্যমান কোনো আয়ের তথ্য এলাকাবাসীর জানা নেই। অথচ তিনি কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বাগানবাড়িতে পাশাপাশি তিনটি আলিশান ভবন করেছেন। তৈরি করেছেন রাজকীয় ফটক। তার আছে কোটি টাকা ব্যয়ের কৃষি খামার, গরুর খামার ও মাছের ঘের। লিপু চলাফেরা করেন হালফ্যাশনের বিলাসবহুল গাড়িতে।
তার বহরে থাকে আট থেকে ১০টি প্রাইভেট গাড়ি ও ২৫ থেকে ৩০টি মোটরসাইকেল। থাকে তাগড়া তাগড়া বডিগার্ডের দল। লিপু যেন স্থানীয় যুবকদের ক্রেজ। শুধু নিজেই নয়; আত্মীয়স্বজনের নামেও রয়েছে বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। সবাই জানতে চান তার শনৈ শনৈ উন্নতির রহস্য কী? কেউ কেউ মনে করছেন তিনি বুঝি রূপকথার সেই আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন; ‘আদেশ’ করা মাত্রই জিন তার সব করে দিচ্ছে। কিন্তু লিপুর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্যানুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। লিপু আসলে একজন অনলাইন জুয়ার নিয়ন্ত্রক। মেহেরপুরে সেই অনলাইন জুয়ার রাজধানী হলেও হেডকোয়ার্টার সুদূর রাশিয়ায়। সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয় অনলাইন জুয়ার কারবার।
মুজিবনগর উপজেলার আরেক গ্রাম কোমরপুর। একসময়ের হতদরিদ্র মানুষের বসবাস থাকা ওই গ্রামটির পরিচিতি এখন কোটিপতিদের গ্রাম হিসেবে। এই গ্রামে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মইনুদ্দিন। স্থানীয়দের কাছে তার পরিচিতি ‘ময়না মেম্বার’ নামে। তিনি আবার মহাজনপুর ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা। ময়না মেম্বারের অপর ভাই মশিউর রহমান মহাজনপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও মুজিবনগর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি। ময়না মেম্বার বর্তমানে মহাজনপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কোমরপুরে ময়না মেম্বারের তিনটি বিলাসবহুল বাড়ি। তিনটিই যেন রাজপ্রাসাদ। মেহেরপুর শহরের নীলমণি হল পাড়ায় মিমি বেকারির পাশে ছয়তলা একটি বিলাসবহুল ভবনও আছে তার। কোমরপুর স্কুলপাড়ায় বানাচ্ছেন আরেকটি নতুন বাড়ি। স্থানীয় তথ্য বলছে, তিনিও অনলাইন জুয়ার এজেন্ট।
শুধু ময়না মেম্বার বা লিপুই নন, মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর ও গাংনী—এ তিন উপজেলায় অনলাইন জুয়ার এজেন্ট, মাস্টার এজেন্ট ও সাব-এজেন্ট আছেন তিন শতাধিক। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক। একদিকে এজেন্টরা যেমন কোটিপতি, তেমনি অনলাইন জুয়া খেলে সর্বস্ব হারাচ্ছে বহু তরুণ যুবক। তারা অনলাইন জুয়া খেলার টাকা সংগ্রহের জন্য চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
যেভাবে শুরু: মেহেরপুরের মানুষ কীভাবে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়েছে, তার সঠিক বিবরণ পাওয়া যায়নি। লোকমুখে জানা যায়, মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর ও কোমরপুর গ্রামের প্রায় অর্ধশত যুবক রাশিয়া প্রবাসী। তারাই সেখান থেকে অনলাইন জুয়ার কারবার করতে স্থানীয় তরুণদের প্রলুব্ধ করে। তাদের মাধ্যমে সেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় অনলাইন জুয়া। স্থানীয়রা আরও জানান, ২০১৭ সালের শুরুতে মুজিবনগর উপজেলার জনৈক মাহফুজুর রহমান ওরফে নবাবের হাত ধরে মেহেরপুরে অনলাইন জুয়া শুরু করেন। তার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে জেলার গ্রামে গ্রামে, পাড়ামহল্লা ও বাড়িতে বাড়িতে। ‘ওয়ান এক্সবেট, মেলবেটসহ শতাধিক জুয়ার সাইট ব্যবহার করে চলছে অনলাইন জুয়ার কার্যক্রম। এসব জুয়া নিয়ন্ত্রণ হয় সুদূর রাশিয়া থেকে। জুয়ার চ্যানেল পরিচালনা করে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে রাশিয়ায়। সেখানে রাশিয়ান লোকদের সঙ্গে মিলে জুয়া পরিচালনা করে কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি। যাদের কয়েকজনের গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরে।
এ ছাড়া কভিড লকডাউনের সময় এই জুয়ার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে জুয়ার বিস্তৃতি ঘটে বেশি। ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর অনলাইনে জুয়ার কারবারের সঙ্গে জড়িত একটি চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা হলো অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মুরশিদ আলম লিপু, স্বপন মাহমুদ, নাজমুল হক, আসলাম উদ্দিন, শিশির মোল্লা, সাদিক, মাসুম রানা, মাহফুজুর রহমান নবাব ও নবাবের স্ত্রী মনিরা আক্তার মিলি। তখন প্রথম মেহেরপুরে অনলাইন জুয়া এবং অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্ট সম্পর্কে তথ্য সামনে আসে। ওই সময় সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সিআইডির নজরদারির ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন খেলা কেন্দ্র করে তারা রাশিয়াভিত্তিক বেটিং ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে জুয়ার কারবার পরিচালনা করেন। আর লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট সিম। মেহেরপুরের কয়েকটি বিকাশ নগদ এজেন্ট ও ডিপোর ম্যানেজারের সম্পৃক্ততার কথা জানায় সিআইডি।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শুধু মেহেরপুর জেলা থেকে মাসে ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় অনলাইন জুয়ায়। অনলাইন জুয়ার এই আসরে প্রথম পর্যায়ে কেউ কেউ লাভবান হয়ে পরবর্তী সময়ে লোভে পড়ে সহায়-সম্বল খুইয়েছেন। অনেক অনলাইন জুয়াড়ি লেনদেন নিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছেন। এলাকায় গুঞ্জন আছে, এজেন্ট ব্যাংকিং এজেন্টকে গুলি করে হত্যার নেপথ্যেও ছিল অনলাইন জুয়া।
পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন মন্ত্রীপত্নী মোনালিসা:
২০২১ সালে সিআইডি কর্তৃক গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের একজন মন্ত্রীর স্ত্রীর তদবিরে জামিন হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তারা ওই মন্ত্রীর স্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতায় অনলাইন জুয়ার কারবার পুরো জেলায় বিস্তৃত করেন। যারা জুয়া ছড়াতে কাজ করেন, তারা হলেন মুজিবনগর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আমাম হোসেন মিলু, তার ভাতিজা মেহেরপুর ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সালাম বাঁধন, মিলুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মইনুদ্দিন ওরফে ময়না ও স্বপন মাহমুদ। এই চক্রটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের স্ত্রী মোনালিসাকে হীরার হারসহ নিয়মিত উপঢৌকন উপহার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিশন দিতেন। তার ছত্রছায়ায় দ্রুত জেলায় বিস্তার হয় অনলাইন জুয়ার কারবার। জুলাই বিপ্লবের পর আগের পৃষ্ঠপোষকের স্থলে শুধু নতুন পৃষ্ঠপোষক এসেছে স্থানীয়দের দাবি। এখন স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতা অনলাইন জুয়ার মূল পৃষ্ঠপোষক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বৃহস্পতিবার আমাম হোসেন মিলুর মেহেরপুরের বাড়িতে অনলাইন জুয়ার এজেন্টদের মিটিং হতো। সেখান থেকে নির্ধারিত হারে চাঁদা তুলে প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও কিছু গণমাধ্যম কর্মীকে দেওয়া হতো।
পুলিশ বলছে, গত কয়েক বছরে জেলায় পৃথক ৪৮টি মামলায় মোট ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করে সোপর্দ করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে জামিনে বেরিরে ফের আগের কারবারে ফিরে যায়। ইতঃপূর্বে মেহেরপুর জেলা থেকে গ্রেপ্তারকৃত ১৪ জন শীর্ষ অনলাইন জুয়াড়িকে অনলাইন জুয়ার ‘মাফিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। নিয়মিত মামলার পাশাপাশি তাদের অর্থ পাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তদন্ত করতে মেহেরপুর জেলা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেও (বিএফআইইউতে) পাঠানো হয়। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে, তারা হলেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার গাড়াডোব গ্রামের কিয়ামুদ্দিনের ছেলে আনোয়ার, গাংনী পৌর এলাকার আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে শহীদুজ্জামান শিপু, মেহেরপুর সদর উপজেলার বলিয়ারপুর গ্রামের মুসা আলীর ছেলে মাসুদ রহমান, মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের সোনা গাইনের ছেলে মাহফুজুর রহমান নবাব, শিবপুর গ্রামের জিনারুল গাজীর ছেলে লিপু গাজী ওরফে মোরশেদ আলম লিপু, কোমরপুর গ্রামের মজিবুর রহমানের ছেলে মুকুল ইসলাম, গোপালপুর গ্রামের বিল্লাল গড়াইয়ের ছেলে দেলোয়ার হোসেন দিপু, মহাজনপুর গ্রামের মাদার মাস্টারের ছেলে মোস্তাক নাহিদ অনিক, কোমরপুরের নাটুদহ গ্রামের সাহাজুল সরদার ওরপে বিলু সরদারের ছেলে শামীম রেজা, কোমরপুর গ্রামের ইমাদুল হকের ছেলে রাজু আহম্মদ রাজন, কোমরপুর গ্রামের আনারুল ইসলামের ছেলে সাইফুল ইসলাম রুবেল, কোমরপুরের নাটুদহ গ্রামের মধু হালদারের ছেলে প্রসেনজিৎ হালদার, মহাজনপুরের আব্দুর রশিদের ছেলে সাদ্দাম হোসেন ও শিবপুর গ্রামের শাহাজুল শেখের ছেলে বিজয় শেখ।
জড়িয়েছে পুলিশও:
মেহেরপুর জেলার তিন থানা পুলিশেরও বেশকিছু অপেশাদার ও লোভী কর্মকর্তা অনলাইন জুয়ায় জড়িয়েছেন। পুলিশ সদর ও রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় থেকে নানাভাবে সতর্ক করার পরও তারা অনলাইন জুয়ার কারবারে সম্পৃক্ত রয়েছেন। সম্প্রতি অনলাইন জুয়ায় জড়িত এক পুলিশ সদস্যের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। ওই কর্মকর্তাকে আগস্ট-পরবর্তী সময়ে মৌলভীবাজারে বদলি করা হয়েছে। আলোচিত ওই কর্মকর্তা হচ্ছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজমল হোসেন। তিনি তার এক অধস্তন এসআই সাহেব আলীর সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজমল হোসেন নিজেকে ‘অনলাইন জুয়া চ্যানেলের একক মালিক’ বলেও দাবি করে। এ ঘটনায় জেলাজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় তৈরি হয। ওই কল রেকর্ডে তৎকালীন মুজিবনগর থানায় কর্মরত এসআই ইকবালসহ কয়েকজন এসআই এমনকি কনস্টেবলরাও সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিলে। এসআই ইকবাল বেশ কয়েকটি অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনিও নতুন গাড়ি কিনে তাতে চলাফেরা করেন। তার বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করলে এই প্রতিবেদককে ‘বাঁশ দিয়ে রাস্তায় টানিয়ে রাখার হুমকি দেন।’
গ্রামভিত্তিক অনলাইন জুয়ার এজেন্ট যারা:
মুজিবনগরের কোমরপুর গ্রামের অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টরা হলেন ময়না মেম্বার, মাদার মাস্টার, মাবুদ মেম্বার, জামান মাস্টার, মুকুল, শামীম, প্রসেনজিৎ হালদার, উজ্জ্বল, রুবেল, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি সাইফুল ইসলাম, মজিবরের ছেলে শুভ, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ সভাপতি বাঁধনের মামাতো ভাই রাশিয়া ফেরত অনিক, ছোট মিঠু, বাসার বিশ্বাস ও তার ছেলে সজীব, ভোলাসহ অনেকে।
গোপালপুর গ্রামের অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টরা হচ্ছেন নুরুল মাস্টার ওরফে লালন মাস্টার, স্বপন মাহমুদ, সিসিটিভি বিক্রেতা স্বপন, দেলোয়ার হোসেন দিপু, শিশির, আফ্রিকা ফেরত বিল্লাল, রয়েল সাকিবসহ অনেকে।
যতারপুর গ্রামের অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টরা হচ্ছেন ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি বাঁধন, সোহাগ (যতারপুর ব্রিজের নিচে রড সিমেন্টের দোকান রয়েছে), কটা, মাসুম, আশিক, আওয়ামী লীগ নেতা ও মুজিবনগর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আমাম হোসেন মিলু ও তার ভাই শিলুসহ অনেক।
ইসলামপুর গ্রামের অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টরা হচ্ছেন জনি ও মেহেদী পুরোনো এজেন্ট হলেও বর্তমানে নতুন অনেক এজেন্ট তৈরি হয়েছে। মহাজনপুর গ্রামের ক্যাসিনো এজেন্টরা হচ্ছেন হেলাল, মিঠু ও হিটু, গাংনীতে রাসেল, শিপু ও সজীব। জানা গেছে, শিপু মূলত অনলাইন জুয়ার খেলোয়াড়। জুয়া খেলে সে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে।
আলমপুরের মানিক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, বামুন্দি বাজারের রাসেল মিয়া, হেমায়েতপুর বাজারে আনোয়ার হোসেন, মেহেরপুর শহরের স্যামসাং শোরুমের সাবেক কর্মচারী ইমরান, মুজিবনগরে শিবপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা রফা গাইনের ছেলে পরাগ। মেহেরপুর পৌর শহরের শেখ পাড়ার মো. নিপুন, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের সভাপতি মো. নাসিম খান, আশিকুর রহমান আশা ও সজল শেখ।
এদের মধ্যে ২০২৪ সালে দুদকের একটি দল মেহেরপুর যায় ছয় অনলাইন কারবারির জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের উৎস সম্পর্কে তদন্ত করতে। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের জন্য সেই দল যাদের সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছিল, তারা হলেন শেখ পাড়ার আমানুল্লাহর ছেলে আশিকুর রহমান আশিক, মান্নান খানের ছেলে ফাহাদ খান, গোপাল শেখের ছেলে সুজন শেখ, মারুফ হোসেন পনির, আফসারের ছেলে শিশির ও মৃত জালাল মীরের ছেলে শিপন মীর।
যেভাবে টাকা পাচার হচ্ছে:
অনলাইন জুয়ার টাকা মূলত পাচার হয় অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। আর এই হুন্ডিতে সহায়তা করা হয় দুটি চ্যানেল থেকে। একটি হলো মোবাইল ব্যাংকিং, অন্যটি কোর ব্যাংকিং ডিপোজিটের অনলাইন ট্রান্সফারে। এই দুই মাধ্যমে কোর ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমে টাকা চলে যাচ্ছে হুন্ডি কারবারিদের হাতে। হুন্ডির মাধ্যমে এই টাকা চলে যাচ্ছে দুবাই, মালয়শিয়া, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর ও লেবাননে। সেখান থেকে টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে রূপান্তরিত হয়ে ইউএসডিটি হয়ে ভার্চুয়াল রূপে বাংলাদেশে ফিরে আসে।
আবার অন্য একটি প্রক্রিয়া হলো জুয়া সাইটের দেশীয় এজেন্টরা প্রথমে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে। এরপর ওই টাকা অনলাইনভিত্তিক ‘বাইন্যান্স’ নামক অ্যাপে বিনিয়োগ করা হয়। সেখানে ডিলাররা টাকাকে ডলারে রূপান্তর করে বিনিয়োগ করে। এরপর তা ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিট কয়েনে রূপান্তর করে জুয়ার সাইট মালিকের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
ইউএসডিটি হয়ে যেভাবে জুয়াতে:
হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সির রূপ নিয়ে ভার্চুয়াল ইউএসডিটি হয়ে এজেন্টের অ্যাকাউন্টে ফেরত আসে। কিন্তু ওই টাকা বাংলাদেশে থাকছে না। বাংলাদেশ থেকে টাকা তোলাও সম্ভব নয়। রাশিয়া থেকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত বেটিং সাইটগুলোতে এজেন্টরা প্রি-পেমেন্ট হিসেবে এই ভার্চুয়াল ইউএসডিটি পান। সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরিচালিত বেটিং সাইটগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে দেশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নগদ, বিকাশ, রকেট, উপায়সহ বিভিন্ন এজেন্ট সিম। এজেন্ট সিমগুলোতে যখনই কোনো জুয়াড়ি জুয়ার অ্যাপসের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে বাংলাদেশি টাকা ডিপোজিট করে, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে এজেন্টের অ্যাকাউন্ট থেকে ইউএসডিটি মাইনাস ছুঁতে থাকে। এভাবে যখন ইউএসডিটি শূন্য হয়ে যায়, তখনই এজেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং থেকে তার উত্তোলিত টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে ইউএসডিটি রিফিল করে। এভাবেই চক্রাকারে চলতে থাকে দিনের পর দিন অর্থ পাচার।
মূল নিয়ন্ত্রণ রাশিয়া থেকে:
জানা গেছে, এজেন্ট হলেও অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত রাশিয়া থেকে। মুজিবনগর উপজেলার বাসিন্দা অর্ধশত প্রবাসী সেখান থেকে জুয়ার সাইট নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা জুয়ার সাইট ও অ্যাপস স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ব্যবহার করে প্রত্যেক এজেন্ট মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন। রেডি অ্যাপস ও ম্যানেজমেন্ট অ্যাপসের মাধ্যমে মেহেরপুরে দীর্ঘদিন থেকে অনলাইন জুয়া চলে। দুটি অ্যাপসই রাশিয়ার তৈরি। এর মধ্যে রেডি অ্যাপস রাশিয়া থেকে আর ম্যানেজমেন্ট অ্যাপস আর্থিক লেনদেন বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত হয়। ম্যানেজমেন্ট অ্যাপসটি রাশিয়া থেকে পরিচালিত রেডি অ্যাপসের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো কাজ করতে পারে না। ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ মূলত বিভিন্ন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের এজেন্ট সিম ব্যবহার করে মেইন সাইট, এজেন্ট ও জুয়াড়িদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত করে। সূত্র জানিয়েছে, ম্যানেজমেন্ট অ্যাপের মেইন চ্যানেল মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপস নগদ। এ ছাড়া সেকেন্ডারি চ্যানেল হিসেবে রয়েছে বিকাশ, রকেট, উপায় এবং ট্রাস্ট এজিয়াটা। মূলত ওয়ান এক্স বেট, মেলবেট, মোস্ট বেট, টি-টোয়েন্টি বেট ও টোয়েন্টি ফোর বেট অনলাইন জুয়ার সাইটগুলোর এজেন্ট ডিলারশিপ হিসেবে ভূমিকা রাখে রেডি অ্যাপ। অ্যাপটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও ডেক্সটপে ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশের আইনে মানি লন্ডারিং ও এর শাস্তি:
বাংলাদেশে প্রচলিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধের শাস্তি রাখা হয়েছে অন্যূন ৪ (চার) বছর এবং সর্বাধিক ১২ (বারো) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ (দশ) লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।
কয়েক এজেন্টের বক্তব্য :
অনলাইন জুয়ার এজেন্ট দুবাই প্রবাসী মাহফুজুর রহমান নবাব বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে বিএনপির রাজনীতির করি। এ কারণে আমাকে ফাঁসাতে আমাম হোসেন মিলু ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ফরহাদ হোসেন ও তার স্ত্রী মোনালিসাকে ম্যানেজ করে মিলু আমাকে এমন একটি মামলায় যাদের সঙ্গে ফাঁসানো হয়েছে, তাদের সঙ্গে আমার চলাফেরা ছিল না। যে ৯ জনের জবানবন্দির ভিত্তিতে আমাকে আসামি করা হয়, তাদের আমি চিনতামই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিয়ের পর হানিমুনে কক্সবাজার ছিলাম। সেখান থেকে ধরে এনে আমাকে ওই মামলায় আটক দেখানো হয়। এখন আওয়ামী লীগ সরকার নেই, আপনারা প্রয়োজনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা সিআইডির এসআই মুরাদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।’
কালবেলার সঙ্গে কথা হয় অপর অনলাইন ক্যাসিন এজেন্ট মোরশেদ আলম লিপুর। তিনি বলেন, ‘সিআইডিতে আমার বিরুদ্ধে কোনো মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত চলছে কি না, আমার জানা নেই। মোবাইল খুললেই পদে পদে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখা যায়, ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওতেও একই অবস্থা, এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার আগে অনলাইন জুয়া বন্ধ করা নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। আর কোন কোন চ্যানেলে, কীভাবে টাকা দেশের বাইরে যায়, সেটা সঠিক খবরও আপনারা এখন পর্যন্ত তুলে ধরতে পারেননি।’
অপর এজেন্ট দেলোয়ার হোসেন দিপুর কাছে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাকে বারবার মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। কয়দিন আগেও একটি মামলায় আমাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এসেছি। এবার আমি মামলার এজাহারকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মেহেরপুর পুলিশ সুপার, খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি এবং আইজিপির কাছে অভিযোগ করব। আর মানি লন্ডারিং ইস্যুতে সিআইডি থেকে আমাকে একবার আমার একটি সিমের বিস্তারিত দিতে বলেছিল। সেটা দেওয়ার পর আমাকে আর কিছু জানানো হয়নি।’
পুলিশের বক্তব্য:
অনলাইন জুয়ার ভয়ংকর রূপ নিয়ে জানতে চাইলে মেহেরপুর জেলা পুলিশ সুপার মাকসুদা আক্তার খানম বলেন, ‘২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ৩০(২) ধারা মোতাবেক অনলাইন জুয়ার অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাদের অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থাৎ মামলা নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিতক্রমে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হলে ওই ধারাটি অধর্তব্য করা হয়। ফলে অনলাইন জুয়ার আসামিদের গ্রেপ্তার বা তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আর মানি লন্ডারিং একটি অর্গানাইজ ক্রাইম। বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি এই ধরনের মামলা তদন্ত করে থাকে। মানি লন্ডারিং তদন্ত সিআইডি করে এজন্য আমাদের মামলাগুলো তদন্তের গতি কমার কোনো বিষয় বা সুযোগ নেই।’
বিশেষজ্ঞ মত:
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিলুর রহমান খান বলেন, ‘আইন পরিবর্তনের ফলে অনলাইন জুয়াড়ি ও জুয়ার এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না, এ কথাটা ঠিক নয়। অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সংবিধানে ও প্রচলিত বিধিবিধানে পর্যাপ্ত আইন এবং সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। সদিচ্ছা থাকলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দেশের বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে জুয়াড়ি ও ক্যাসিনো এজেন্টদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে।’
সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সিপিবি নেতা অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান বলেন, ‘অনলাইন জুয়ায় যুবসমাজ আর্থিক প্রলোভনে পড়ে রাষ্ট্রের আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। তারা রাষ্ট্রের আইন পরিপন্থি কাজ করছেন। এখন আবার দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু কিশোর কোটিপতি হয়ে উঠছে, এটা অবশ্যই দৃষ্টিকটু। কথিত আছে মেহেরপুরের একটি গ্রামের অর্ধশত যুবক রাশিয়ায় বসবাস করে। সেখান থেকে বাংলাদেশের অনলাইন জুয়াড়ি ও অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্ট এর মধ্যে সমন্বয় করে।’
যা বললেন জেলা জামাতের আমির:
মেহেরপুর জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা তাজ উদ্দিন খান বলেন, ‘জুয়া খেলা’ আমাদের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অনলাইন জুয়ার কারণে নতুন প্রজন্ম কীভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেটা কল্পনাতীত। এখান থেকেই মাদক ও নারী সংক্রান্ত অপকর্মগুলোর সূত্রপাত হচ্ছে। উচ্চাভিলাষী চিন্তাভাবনার কারণে যুবকরা পথভ্রষ্ট হচ্ছে। আমার কাছে এমন তথ্যও আছে, এই অনলাইন জুয়ার জন্য অনেকে তার বাপ-দাদার সম্পদ ও জমি বন্ধক রেখে কিংবা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমি চাই, চিহ্নিত ও প্রকৃত অপরাধীদের যেন দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা হয়। অনলাইন জুয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৃত অপরাধীদের যেন দ্রুত গ্রেপ্তার করা হোক। একই সঙ্গে অন্যায়ভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করলে আমরা সেটা প্রতিবাদ করব।’
মানবজমিন
গাজীপুরে রেহানা পরিবারের বিপুল সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক
মারুফ কিবরিয়া, গাজীপুর থেকে ফিরে
গাজীপুরে একের পর এক রিসোর্ট ও বাগানবাড়ির সন্ধান মিলছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা পরিবারের সদস্যদের। বিভিন্ন সময়ে কেনা এসব রিসোর্ট ও বাগানবাড়ি করা হয় অবসর সময় কাটানোর জন্য। সরকার পতনের পর কয়েকটি রিসোর্ট ও বাগানবাড়িতে বিক্ষুব্ধ মানুষের হামলার ঘটনাও ঘটে। যুক্তরাজ্যে রেহানাকন্যা টিউলিপের বিরুদ্ধে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ ওঠা এবং তার পদত্যাগের পর দেশেও রেহানা পরিবারের সদস্যদের সম্পদের খোঁজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য মিলেছে।
গাজীপুর মহানগরীর কানাইয়া। জয়দেবপুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এলাকাটি। কাঁচা-পাকা রাস্তা আর সারি সারি গাছপালা। অনেকটা সবুজে ঘেরা এই কানাইয়ায় গড়ে উঠেছে শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও সদ্য পদত্যাগ করা বৃটিশমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের নামে একটি বাগানবাড়ি। প্রায় ৩৫ বিঘার ওপর নির্মিত বাগানবাড়িতে কী নেই! বাংলো, পুকুর, হরেক রকমের ফুল ও ফলের গাছ। এর নামকরণও করা হয়েছে টিউলিপের নামে ‘টিউলিপ’স টেরিটরি’।
সরজমিন ঘুরে জানা যায়, শুধু টিউলিপ সিদ্দিকের নামে বাগানবাড়ি নয়, গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে দেড়শ’ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের সম্পদ রয়েছে শেখ রেহানা পরিবারের। বাংলো, পুকুর আর সবুজে ঘেরা এসব বাগানবাড়ি নির্মাণ করে রাখা হয়েছে শুধুমাত্র নিজেদের একান্ত সময় কাটানোর জন্য।
বাগানবাড়ির দায়িত্বরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর কেউই আসেননি টিউিলিপ’স টেরিটরিতে। তারা আরও জানান, শেখ রেহানার স্বামী শফিক সিদ্দিক এ বাগানবাড়ি তত্ত্বাবধান করেন। দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষী ও মালিকদের বেতন-ভাতাও তিনি পরিশোধ করেন।
সরজমিনে আরও জানা যায়, টিউলিপ’স টেরিটরির দায়িত্বে রয়েছেন একজন নিরাপত্তারক্ষী আর দু’জন মালি। রোববার সেখানে গিয়ে নিরাপত্তারক্ষী আবদুর রহিম ও মালি নজরুল ভূঁইয়ার দেখা মেলে।
নজরুল ভূঁইয়া জানান, তিন বছর ধরে টিউলিপ’স টেরিটরির মালির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, এই বাগানবাড়ির মালিক শফিক সিদ্দিক। স্যার এখানে আসেন না। আগে পরিবারের সদস্যরা সবাই আসতেন আবার চলে যেতেন। ৫ই আগস্টের পর তারা আর কেউ আসেনিন।
বেতন কীভাবে পান জানতে চাইলে নজরুল বলেন, বেতন আগেও স্যার পাঠিয়ে দিতেন এখনো ওভাবেই দেন।
বাগানবাড়িটির দায়িত্বে থাকা আবদুর রহিম বলেন, আমি পাঁচ বছর ধরে এখানে থাকি। গণ্ডগোলের পর থেকে কেউ আসেনি। ৫ই আগস্ট কারা যেন এসে দুটো বাংলো ভাঙচুর করে। গ্লাস ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়ে গেছে। ভেতরে আসবাবপত্র ছিল লুটপাট করছে। আমরা তো নিরীহ মানুষ কাউকে কিছু বলতে পারিনি।
কানাইয়া এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের আগেও এই বাগানবাড়ি ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। বাইরে থেকে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা নিরাপত্তা দিতেন। এ ছাড়া যেদিন শেখ রেহানা পরিবারের সদস্যরা বেড়াতে আসতেন সরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হতো।
স্থানীয় বাসিন্দা ওয়াদুদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এখানে বাগানটা ১৭ থেকে ১৮ বছর ধরে দেখছি। শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানাদের। এলাকার মানুষের কাছ থেকে জমি কিনে কিনে বিশাল বাগানবাড়ি বানিয়েছে। যারা কাজকর্ম করতো তাদের কাছে শুনেছি পার্কের মতো সুন্দর করে সাজানো। আমরা লোকাল মানুষ কখনো ঢুকতে পারিনি।
আবদুস সোবহান নামে এক বাসিন্দা বলেন, এই জায়গা আনুমানিক ৩৫ বিঘার ওপর আছে।
কানাইয়ার বাসিন্দা হাফিজ উদ্দিন বলেন, আমরা গরিব মানুষ। কথা বললে যদি কোনো বিপদ হয়। এই বাগানবাড়ি শেখ রেহানার মেয়েদের নামে বানানো। আসল মালিক তার স্বামী শফিক সিদ্দিক।
এদিকে গাজীপুর মহানগরীর বাঙালগাছ এলাকায় ২৫ বিঘা জমির ওপর বাগানবিলাস, ২৩ বিঘা জমির ওপর ফাওকাল বাগানবাড়ি, ১৫ থেকে ১৬ বিঘা জমির ওপর কালিয়াকৈরে মৌচাকের বাগানবাড়ির তথ্য পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান দল।
সূত্র জানায়, স্থানীয়রা এগুলো শেখ রেহানার বাগানবাড়ি বলেন জানতেন, তবে এগুলোর মালিকানায় রয়েছেন তার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিক, দেবর তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও তাদের নিকট আত্মীয়-স্বজনের।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুর মহানগরীর ফাওকাল এলাকায় বাংলাদেশ সমরাস্ত্র ও টাকশালের পাশেই ২৩ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি বাগানবাড়ি। বড় সীমানা প্রাচীরে ঘেরা, ভেতরে নান্দনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে সেখানে। ২০১২ সালে সনাতন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় অনিল ও অক্ষয়দের থেকে কিনে এই বাংলো তৈরি করা হয়। ৩৫ লাখ টাকা বিঘা মূল্য ১৪ বিঘা জমি ক্রয় করা হয় এবং কাগজপত্রে সমস্যা থাকায় ৮ বিঘার কোনো দাম দেয়া হয়নি। বর্তমানে সেখানকার বিঘা প্রতি জমির মূল্য আড়াই কোটি টাকা। জমিটি স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ী স্বপনের মধ্যস্থতায় কেনেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও শেখ রেহানার দেবর তারিক সিদ্দিক।
মহানগরীর বাঙালগাছ এলাকায় প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি বাংলো বাড়ি। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘বাগান বিলাস’। কয়েকশ’ গাছ নিয়ে বাংলোর ভেতরে চমৎকার পরিবেশ। অবকাশ যাপনের জন্য আছে তিন রুমের একটি দোচালা ঘর। পাশেই ছোট আরেকটি ঘর। সামনে বড় পুকুর, বিল। এ ছাড়া একটি ওয়াচ-টাওয়ারও রয়েছে ভেতরে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণের পূর্ব পাশে অবস্থিত ১৫-১৬ বিঘা জমির ওপরে আরেকটি বাংলো রয়েছে। যেটি শেখ রেহানার। প্রতি বছর শেখ রেহানার পরিবারের সদস্যরা একান্ত সময় কাটাতে আসতেন। এ ছাড়াও সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিয়মিত বৈঠক করতেন এখানে।
দুদক জানায়, টিউলিপ’স টেরিটরিসহ শেখ রেহানা পরিবারের বেশ কিছু স্থাপনার তথ্য পাওয়া গেছে সংস্থাটির অনুসন্ধানে। এসব স্থাপনার আনুমানিক মূল্য ১৬৫ কোটি টাকার বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত চারটি বাগানবাড়ির তথ্য আমাদের অনুসন্ধানে রয়েছে। এগুলো সরজমিন দেখা হচ্ছে।
ইত্তেফাক
এক মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক দলের ঘোষণা ছাত্রদের
আবির হাকিম
দেশের রাজনীতিতে নতুন দল নিয়ে আসছে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। আসন্ন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধেই এ দলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে বলে জানা গেছে। জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহিদ আবু সাইদের বাড়ি থেকে লংমার্চ শুরু করে চট্টগ্রামের শহিদ ওয়াসিমের বাড়ি পর্যন্ত লংমার্চ করে এ দলের ঘোষণা দেওয়া হবে। সম্প্রতি নাগরিক কমিটির বাংলামোটরস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দল গঠনের সার্বিক কার্যক্রম, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন এবং দেশের রাজনৈতিক অবস্থাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
নতুন দল গঠনের বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, ‘দেশের সাধারণ মানুষ একটা নতুন রাজনৈতিক শক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা আমরা লক্ষ্য করেছি এবং তার কিছু প্রস্তুতি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সারা দেশে আমাদের কলেবর বৃদ্ধি করেছি। দেশে চলমান দীর্ঘদিনের অপরাজনীতির বিপরীতে আমরা একটা নতুন রাজনৈতিক ভাষা নির্মাণের চেষ্টা করেছি। আমরা বিশ্বাস করি দেশের মানুষই আমাদের মন থেকে গ্রহণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আশা করি ফেব্রুয়ারির মধ্যেই এ দলের আত্মপ্রকাশ হবে।’
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সারা দেশে নাগরিক কমিটির জেলা ও উপজেলা কমিটি শেষ করেই এ দলের ঘোষণা দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে এ দল ঘোষণাকে সামনে রেখে দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ করছে ১৭ সদস্যের বিশেষ টিম। এ টিমের মধ্যে নাগরিক কমিটির সদস্য, ছাত্রনেতা, সাবেক আমলা এবং সাংবাদিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা রয়েছেন।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা জাতীয় নাগরিক কমিটির অন্যতম এক শীর্ষনেতা জানিয়েছেন, চলতি মাসের ২৮ তারিখে রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেওয়ার বিষয়ে অধিকাংশ সদস্য মত দেন। পরবর্তী সময়ে রংপুরে শহিদ আবু সাঈদের বাড়ি থেকে চট্টগ্রামের শহিদ ওয়াসিমের বাড়ি পর্যন্ত লংমার্চ করে দল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রংপুরে লংমার্চ শুরু করার আগে অথবা চট্টগ্রামে লংমার্চ শেষ করে দল ঘোষণা হতে পারে। ঐ নেতা আরো জানান, যেহেতু অন্তত পনের দিনব্যাপী সারা দেশে এই লংমার্চ অনুষ্ঠিত হবে, তাই লংমার্চের শুরুতেই দল ঘোষণা করে লংমার্চের সময়ে তৃণমূলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে দলের প্রচারণা করতে সুবিধা হবে এমন আলোচনায় লংমার্চের শুরুতেই দল ঘোষণা করার বিষয়ে মত দিয়েছেন বৈঠকে থাকা অধিকাংশ সদস্য।
নাগরিক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত মোট ২১০টি উপজেলায় কমিটি করা হয়েছে এবং ওয়ার্ড পর্যায়েও কমিটি করার কাজ চলছে। দল গঠনের সঙ্গে জড়িত নেতারা বলছেন তরুণদের পাশাপাশি নতুন এ রাজনৈতিক দলে যুক্ত হবেন সাবেক আমলা, রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করা হবে। নেতাদের দাবি, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন তারা। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই নতুন দল ঘোষণা করা হবে। তবে নতুন রাজনৈতিক দলের নাম কী হবে? এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ছাত্রনেতারা বলছেন, ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে বেশি ভূমিকা রেখেছেন দেশের তরুণরা। তাই নতুন দল গঠনে তরুণদের কাজে লাগাতে চান জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। ফলে কমিটি গঠনে তরুণদের আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত দলের কাঠামো কিংবা নেতৃত্বে কারা আসছেন সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৭ সদস্যের বিশেষ টিম বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাদের পরামর্শ আমলে নিয়ে দলের গঠনতন্ত্র এবং ঘোষণাপত্র তৈরি করবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সহ-মুখপাত্র সালেহ উদ্দিন সিফাত বলেন, আমাদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজ চলমান, তবে নতুন দল ঘোষণার দিন তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায় সব জেলায় নানা শ্রেণি পেশার নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছি। জুলাই অভ্যুত্থানে প্রকাশিত জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে সবাই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
সমকাল
মেডিকেল কলেজে ভর্তি : পরীক্ষার নীতিমালাতেই ভুল
তবিবুর রহমান : সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার নীতিমালায় ভুল রয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংশোধিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়েছে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায়। গত রোববার পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বিষয়টি নজরে আসে। এ নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। ভর্তি পরীক্ষায় কোটা বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভও করেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে কোটা বিষয়ে ভুলের দায় নিচ্ছে না চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)।
বিএমডিসির ২০২৪ সালের নীতিমালায় মেডিকেল ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ২ শতাংশ ছিল। তবে এবার ৫ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৫ সালের পরীক্ষার জন্য গত ২১ ডিসেম্বর বিএমডিসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নীতিমালার ৯.১.১ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২৩ জুলাই ২০২৪ তারিখের স্মারক অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য মোট আসনের ৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকিবে। তবে এই কোটার আসন শূন্য থাকিলে সাধারণ মেধা তালিকা হইতে মেধা ও পছন্দক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে এই কোটার আসন পূরণ করা যাইবে।’
সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নিয়ে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটায়। ২১ জুলাই আপিল বিভাগ রায় দেন, সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য ২ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়। দেখা গেছে, সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার কোটার বিধি আর মেডিকেল ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিধি এক। আদতে চাকরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কোটার এই প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে মেডিকেলে ভর্তির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
নতুন নীতিমালায় বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত আলীর সই রয়েছে। তবে তিনিও এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাতে পারেননি। নতুন বিধিমালায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ কেন করা হলো– জানতে চাইলে লিয়াকত আলী সমকালকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসির প্রতিনিধিদের নিয়ে একাধিক মিটিং করে নতুন বিধিমালা করা হয়েছে। কোটা ৫ শতাংশ কেন করা হলো, সে বিষয়ে এখন বলতে পারব না। কারণ সেই মিটিংয়ে আমি ছিলাম না।’
কোটা বাতিল ও ফল পুনঃপ্রকাশের দাবি
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় থাকা কোটা বাতিল এবং রোববার প্রকাশিত ফল বাতিল করে আবারও প্রকাশের দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ কয়েকটি মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ কর্মসূচি পালন করেন। সকাল ৯টা থেকে সর্বস্তরের মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থী, চিকিৎসকবৃন্দ এবং সর্বস্তরের শিক্ষার্থীবৃন্দ ব্যানারে তাদের অবস্থান নিতে দেখা যায়। দুপুরেও তারা সেখানে ছিলেন। তাদের দাবি, কোটা থাকায় অনেক যোগ্য শিক্ষার্থী মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাননি। অবিলম্বে কোটা বাতিল করতে হবে।
এদিকে চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পুনর্বিবেচনা করে ফের প্রকাশের দাবিতে গতকাল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৬৮৬ আবেদন
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এবার সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ১ লাখ ৩১ হাজার ৭২৯ প্রার্থী অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য ৫ হাজার ৩৭২ জন প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। মেধায় আবেদন করেন ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৪ জন। তাদের মধ্যে পাস করেছেন ৫৯ হাজার ৫৫৪ জন। এবার ৩০৮টি কোটার আসনের বিপরীতে আবেদন করেন ১ হাজার ৮৮৭ জন। তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের নির্ধারিত ২৬৯টি আসনে এবার আবেদন পড়ে ৬৮৬টি। পাস করেছেন ১৯৩ জন। সেই হিসাবে মুক্তিযোদ্ধার ২৮ শতাংশ আসন এখনও ফাঁকা। এগুলো মেধা তালিকা থেকে পূরণ হবে।
কোটায় উত্তীর্ণদের ভর্তি সনদ বাছাইয়ের পর
বিএমডিসি প্রণীত ভর্তি নীতিমালার ৯.৩ নম্বর অনুচ্ছেদে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তান এবং পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর কোটার আসনে নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা কেন্দ্রীয় ভর্তি কমিটি যাচাই-বাছাইপূর্বক অনুমোদনক্রমে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করার কথা উল্লেখ রয়েছে। সে অনুযায়ী যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কোটায় উত্তীর্ণদের ২৭, ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি কাগজপত্র নিয়ে ডাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক রুবীনা ইয়াসমীন।
তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার এত বছর পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার কথা নয়। যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পাস করেছেন, তাদের তথ্য বিশেষভাবে যাচাই-বাছাই করা ছাড়া কিছু বলা যাবে না। সে জন্য এসব শিক্ষার্থীকে অধিদপ্তরে সরাসরি আসতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের অনলাইনে আপলোড করতে বলা হয়েছে কাগজপত্র।
গতকাল বিকেলে এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষাও প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী হয়েছে। তার পরও এটা তদন্ত করা হবে। সেখানে যদি কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে, তাহলে সেটা দেখা হবে। এমবিবিএস পরীক্ষায় মূল কোটা থাকবে কিনা, সেই নীতিগত সিদ্ধান্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়, রাষ্ট্রের।