আইনে কি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ সম্ভব?
প্রকাশ | ০৯ মে ২০২৫, ২২:১০

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। শুক্রবার এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। যেখানে এই দাবিতে আন্দোলনে নামা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধারণের আহ্বানও জানানো হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে আওয়ামী লীগের বিচার ও দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে অবস্থানের ঘোষণা দেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
পরে আন্দোলনে যোগ দেন এনসিপি'র কেন্দ্রীয় নেতারাও। রাতভর বিক্ষোভ চলার পর শুক্রবার সকালে সেখানে যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীসহ আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের অবস্থান এবং কোন প্রক্রিয়া বা আইনের মাধ্যমে এর বাস্তবায়ন হতে পারে, এসব বিষয়ে বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা।
বিবৃতিতে যা বলছে সরকার
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও জনগণের পক্ষ থেকে স্বৈরশাসন ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে"।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, "এ ব্যাপারে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন বিবেচনায় রাখছে সরকার"।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনে নামা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরার আহ্বানও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, "জনদাবীর প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রচলিত আইনের অধীনে এরই মধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে"।
এছাড়া, সরকারের পক্ষে থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয় বিবৃতিতে।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ: কোন আইনে?
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, পলিটিক্যাল পার্টি অধ্যাদেশ- ১৯৭৮ এবং সন্ত্রাস বিরোধী আইন- ২০০৯, এই দুটি আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল বরখাস্ত, সাময়িক অথবা আজীবন নিষিদ্ধের সুযোগ রয়েছে। তবে এখানে অনেকগুলো বিষয়ে বিতর্ক বা বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।
মি. বড়ুয়া বলছেন, পলিটিক্যাল পার্টি অধ্যাদেশ- ১৯৭৮ এর বিধান অনুযায়ী, রাজনৈতিক দল বা তাদের কর্মকাণ্ড যদি বাতিল করতে হয়, তাহলে হাইকোর্টের কাছে রেফারেন্স আকারে পাঠাতে হয়- যা হাইকোর্ট মামলার মতো করে দুই পক্ষের শুনানী করেন।
বিধিমালা অনুযায়ী, দেশের স্বাধিনতা-সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ব্যত্যয়, সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার মতো কতগুলো নির্দিষ্ট বিষয়ে যদি সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকে তাহলেই হাইকোর্টে রেফারেন্স আকারে পাঠানো যায়। এরপর শুনানী করে যে সিদ্ধান্ত দেন, সেটিই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করে পরবর্তীতে সরকার তা প্রচার করে।
এছাড়া সন্ত্রাস দমন আইনেও এটি করার সুযোগ রয়েছে বলে জানান মি. বড়ুয়া। এই আইন অনুযায়ী, যদি কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত আছে, আর্থিক লেনদেন রয়েছে অথবা রাজনৈতিক দলটিকে সন্ত্রাসের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে- এমন অভিযোগ থাকে তাহলেও দলটিকে সাময়িক সময়ের জন্য বা চিরতরে নিষিদ্ধ করার সুযোগ আছে।
অবশ্য এক্ষেত্রে মানবতা বিরোধী অপরাধ কিংবা গণহত্যা চালিয়েছে কিনা- সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আইনের সব মানদণ্ডগুলো ঠিক থাকলে তবেই একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা যায় বা তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার আহসানুল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ যেভাবে ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ১৮ ধারা অনুযায়ী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল, সেভাবেই আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলছেন, এই আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা সত্ত্বা যদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর বলে সরকার মনে করে তাহলে ওই ব্যক্তি বা সত্ত্বাকে নিষিদ্ধ করতে পারে।
কিন্তু নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার এই বিষয়টি বিতর্কযোগ্য বলেও মনে করেন তিনি। কারণ ব্যক্তি বা সত্ত্বার মধ্যে আইনগতভাবে রাজনৈতিক দল পড়ে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এছাড়া পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮ সম্পর্কে মি. করিম বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর অথবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে সরকার মনে করে, তাহলে রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম সাময়িক অথবা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করা যেতে পারে। তবে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আদালতের ভূমিকা রয়েছে বলেও জানান মি. করিম।
এসব আইনে কি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ সম্ভব?
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো আইনের ধারার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, এটা বিতর্কযোগ্য বিষয়।
এক্ষেত্রে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে আনেন মি. বড়ুয়া। বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ব্যতিত- হলের সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ যে বিষয়গুলো ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে টিকবে না।
যদিও মি. বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যাসহ নানা কারণে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ একেবারে যে নেই তা নয়। তবে আইন দিয়ে নিষিদ্ধ করার বিপরীতে তাদেরকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলেই মনে করেন তিনি।
মি. বড়ুয়ার মতে, এই প্রশ্নটি যতটা না আইনী তার থেকে বেশি রাজনৈতিক। কারণ একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করলে কী হয়, সেটি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের আগেই দেখা গেছে। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করায় তারা আরো বেশি সংগঠিত হয়েছিল। যার মাধ্যমে তারা এমন একটি ভূমিকা রেখেছে, যা তারা আগের পনের বছরে পারেনি।
রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে তাদের আদর্শ নির্মূল করা সম্ভব হয় না বলেও মনে করেন মি. বড়ুয়া। এক্ষেত্রে পুরনো রাজনৈতিক দল হওয়ায় তাদের যে নেতা সমর্থকরা দেশ ও দেশের বাইরে রয়েছে তারা বরং সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে। নিষিদ্ধের এই রাজনীতির কারণে বরং আরেকটি সুযোগ তৈরী হবে তাদের জন্য।