আজ বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস

বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ ও পুনর্বাসন নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

জাহিদ হাসান

রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব শহরে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে জলাতঙ্কভীতি বাড়ছে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে কুকুর অপসারণের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন হয়েছে। অন্যদিকে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় অনেকে পাল্টা অবস্থান নিয়েছে। ফলে বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ ও পুনর্বাসন নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো বিপাকে পড়েছে। এতে অনেকে জলাতঙ্ক নির্মূল কার্যক্রম উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন। কুকুর অপসারণের পক্ষে অবস্থান নেওয়া জনসাধারণের অভিযোগ সরকারের জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী শুধু ঢাকাতেই ৪৮ হাজার ৫১২টি বেওয়ারিশ কুকুর রয়েছে। দেশে প্রতি বছর সাড়ে ৩ লাখ মানুষ কুকুরের কামড়ের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া প্রত্যেক জেলায় জলাতঙ্ক নির্মূল কেন্দ্রের প্রতিটিতে গড়ে ১৫ জন আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা বলছেন, জলাতঙ্ক একটি ভয়ংকর মরণব্যাধি। এ রোগে মৃতু্যর হার শতভাগ। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ কুকুর, বিড়াল, শিয়ালের কামড় বা আঁচড়ের শিকার হয়ে থাকেন। এছাড়া প্রায় ২৫ হাজার গৃহপালিত গবাদি পশু এ রোগের শিকার হয়। ফলে বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ সময়ের দাবি হয়ে পড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে কুকুরসহ অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর কামড়ে জলাতঙ্ক রোগের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে আজ সোমবার (২৮ সেপ্টেম্বর) অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো দেশেও বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস-২০২০ পালিত হচ্ছে। অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য ও প্রাণী সংরক্ষণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্যক্তিদের দাবি, টিকার মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ সম্ভব। রোগটি নির্মূল করতে হলে প্রয়োজন কুকুরকে জলাতঙ্ক থেকে নিরাপদ করা। কারণ কোনো এলাকার শতকরা ৭০ ভাগ কুকুরকে ব্যাপকহারে টিকা দিলে ওই এলাকার কুকুরের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়। তিন বছরে পর পর ৩ রাউন্ড টিকা দিলে কুকুর থেকে মানুষ বা কুকুর ও অন্যান্য প্রাণীতে সংক্রমণের হার শূন্যের কোটায় নেমে আসে। যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। পক্ষ-বিপক্ষের কারণে চলতি মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটির বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ কার্যক্রম শুরু করে। তবে গত ১৭ সেপ্টেম্বর দুটি দেশীয় প্রাণী কল্যাণ সংস্থা কোর্টে রিট করলে গতকাল হাইকোর্ট দক্ষিণ সিটির বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে রিট আবেদনের শুনানি মুলতবি করেছে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডা. মো. রিদুয়ান পাশা যায়যায়দিনকে বলেন, জলাতঙ্ক নির্মূলের জন্য ২০১০ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্ট্র্যাটেজি পস্নান করা হয়। সেখানে ২০১২ সালের মধ্যে কুকুরের রেজিস্ট্রেশন ও ভ্যাক্সিনেশন সম্পন্ন করতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে ৩ স্তরের পরিকল্পনা করা হয়। এখন পর্যন্ত যা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এছাড়া কুকুরের কামড়ে মানুষের জলাতঙ্কে আক্রান্ত বন্ধে ও হিংস্র প্রাণীদের শরীরের জলাতঙ্ক নির্মূলকরণের কাজ বাস্তবয়নে ৫টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। যার কার্যক্রম সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। মূলত পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়ন ঘাটতিতে এমনটা হচ্ছে। তাই এখনই কুকুরকে টিকাদান ও খোঁজাকরণে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এজন্য স্বল্প সময়ের প্রকল্পের অধীনে ভেটেরিনারিয়ান নিয়োগের মাধ্যমে নগর, শহর, মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের কুকুরের টিকাদান ও খোঁজাকরণ কার্যক্রম বাড়াতে হবে। রবিনহুড এনিমেল রেসকিউ অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা আফজাল হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে নগর কর্তৃপক্ষ একটি আধুনিক শহরের প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে ক্ষমতায় বসলেও মশার সমস্যা, জলজট, যানজটের মতো সমস্যা না দেখে বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ ও স্থানান্তর প্রকল্প বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় টানা ২৯ মাস ও উত্তরে ৯ মাস ধরে কুকুর বন্ধ্যাকরণের কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে সরকার তাদের দায়িত্ব দিলে জবাবদিহিতার মাধ্যমে তারা কাজ করবে বলে মন্তব্য করেন। জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কেন্দ্র সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে প্রতিদিন ঢাকা ও আশপাশের এলাকার ২০০ থেকে ৩০০ কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত রোগীকে সেবা দেওয়া হচ্ছে। ২০১৮ সালে হাসপাতালটিতে ৮১ হাজার এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৩৬ হাজার মানুষ সেবা নিয়েছে। জলাতঙ্ক প্রতিরোধে সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তবে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা কর্তৃক যায়যায়দিনকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে সারাদেশে ৬৭টি কেন্দ্রের মাধ্যমে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ইনজেকশন এন্টির্ যাবিস ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। ২০১২ সালে বিনামূল্যে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার রোগীর বেশি টিকা পেয়েছে। যা ২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪০৯ এ উন্নীত হয়েছে। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে জলাতঙ্ক মুক্ত করার লক্ষ্যে ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ এবং নির্মূল কর্মসূচি বাস্তবায়ন চলছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের সব জেলার জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত রোগীর আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সিডিসি কর্তৃক সারাদেশে প্রায় ৩ লাখ ভায়াল ভ্যাকসিন দেশের বিভিন্ন জেলা সদর হাসপাতাল ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে প্রদান করা হয়েছে। এদিকে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উপলক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে 'এন্ডর্ যাবিস :কোলাবরেট, ভ্যাকসিনেট' অর্থাৎ 'জলাতঙ্ক নির্মূলে টিকাদান, পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ান'। দিবসটিকে সামনে রেখে জলাতঙ্কের ভয়াবহতা উপলব্ধি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধ ও নির্মূলের লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির আওতায় জাতীয় পর্যায়ে, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে একযোগে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে সেমিনার, মুক্ত আলোচনা, জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।