পাঠক মত

ডে কেয়ার বিড়ম্বনায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নারী

প্রকাশ | ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০ | আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:৫৪

আহমেদ মুনীর তাঈফ শিক্ষাথীর্, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের নারী সমাজের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই অধিকাংশ নারীর জীবন তাদের পরম্পরার ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বাজারব্যবস্থা, উৎপাদনশীল খাত কিংবা স্থানীয় সরকারের মতো গুরুত্বপূণর্ ক্ষেত্রগুলোতে তাদের অংশগ্রহণের তেমন উল্লেখযোগ্য সুযোগ ছিল না। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণের মতো গুরুত্বপূণর্ বিষয়গুলোতে যতদিন পযর্ন্ত নারীর সবার্ত্মক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না যায় ততদিন পযর্ন্ত তাদের মধ্যকার উন্নত উৎপাদনশীলতার অপার সম্ভাবনাগুলো থেকে সমাজ বঞ্চিত হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে স্বাধীনতা-পরবতীর্ সময়ে নারীর এই দুরাবস্থার উন্নয়নে সরকারি বেসরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে নারীসমাজে ব্যাপক পরিবতর্ন এবং সাফল্য লক্ষণীয়। নারীর রাজ নৈতিক ক্ষমতায়ন, উন্নতর কমর্ প্রত্যাশা সবোর্পরি উন্নত শিক্ষা এবং তাদের অধিকার আদায় সমন্ধে এক বৈপ্লবিক পরিবতর্ন এসেছে। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের প্রথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেয়েদের অংশগ্রহণ প্রায় পুরুষের সমানুপাতিক হয়ে দঁাড়িয়েছে যা আমাদের জন্য দারুণ এক শুভ সংবাদ। স্বস্তির সংবাদ এই যে, বতর্মানে বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষাথীের্দর বিরাট একটা অংশই নারী। তবে অস্বস্তির সংবাদ হচ্ছে, এই বিরাট একটা অংশের জন্য এখনও নেই তাদের প্রয়োজনীয় পযার্প্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা যার মধ্যে অন্যতম হলো ডে কেয়ারের বা দিবা যতœ কেন্দ্রের অভাব। আমাদের দেশে ১৮ বছরের আগেই ৬৪ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়ে যায়। যেখানে ১৯ বছরের বয়সের মধ্যেই গভর্বতীর সংখ্যা দঁাড়ায় ৫৭ শতাংশে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েরা সচেতনতার দিক থেকে কিংবা ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে অনেকে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। আবার অনেকেই অধ্যয়নরত অবস্থাতেই পারিবারিক বা বিভিন্ন সামাজিক কারণেও বিয়ে করে ফেলেন এবং কাঙ্খিত বা অনাকাক্সিক্ষতভাবেই মা হওয়ার সৌভাগ্য অজর্ন করেন। একজন নবজাতকের জন্য মায়ের পরম স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা আর আদর যতœ অত্যন্ত গুরুত্বপূণর্ বিষয় যা তার সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অপরিহাযর্। মা হিসেবে একজন শীক্ষাথীর্ যখন তার সন্তানের দেখাশুনায় আত্মনিয়োগ করেন তখন তার পক্ষে আর স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা কিংবা নিয়মিত ক্লাস করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। অন্তত প্রথম ৬ মাস একজন মায়ের পক্ষে সন্তানের দেখাশোনা করে অন্য কাজে সময় দেয়াটা প্রায় দুঃসাধ্য বিষয়ই বলা যায়। প্রসব পূবর্ এবং পরবতীর্ কিছুদিন একজন মায়ের স্বাভাবিকভাবেই পূণর্ বিশ্রাম নেয়া অত্যন্ত জরুরি। ফলে এই দীঘর্ সময়ে এমনিতেই তারা পড়াশোনায় বেশ পিছিয়ে পড়েন। কিন্তু সন্তানকে দেখাশুনার পাশাপাশি যখন নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার শারীরিক সক্ষমতা অজর্ন করেন তখন চাইলেও তারা দ্রæত পড়াশোনায় ফিরতে পারছেন না। অথার্ৎ সন্তানের নিদির্ষ্ট একটা বয়সে এসে তাকে দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানির মতো পরিবারের আপনজনদের কাছে রেখে একজন শিক্ষাথীর্ নিয়মিত ক্লাসে যোগ দিতে পারেন। কিন্তু আমাদের এই আধুনিক সমাজব্যবস্থায় যৌথ পরিবারের প্রথা প্রায় বিলুপ্তির পথে কিংবা পরিবারের সবাই কমর্জীবী হওয়ায় সন্তানকে বিশ্বস্ত কারো কাছে রেখে এসে নিশ্চিন্তে নিয়মিত ক্লাসে যোগদান বা পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে অনেক শিক্ষাথীর্ তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে ছোট্ট ফুটফুটে শিশুটিকে নিয়েই ক্যাম্পাসে আসছেন এবং তাকে কোলে নিয়েই ক্লাসসহ যাবাতীয় কাযর্ক্রমে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ এই চাপ সামলাতে না পেরে ঝরে পড়ছেন শিক্ষাজীবন থেকে। প্রায় একই অবস্থা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষিকাদের ক্ষেত্রেও প্রতীয়মান। বাবা-মা দুজনই কমর্জীবী হওয়ায় আদরের সোনামণিকে বিশ্বস্ত এবং নিভর্রযোগ্য কারো কাছে রেখে চাইলেই দ্রæত সময়ের মধ্যে একাডেমিক কাযর্ক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। ফলে উন্নত জ্ঞান উৎপাদনশীল এই মানুষগুলোর বিভিন্ন উৎপাদন তথা অপার সম্ভাবনা থেকে যেমন রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে পাশাপাশি কমের্ক্ষত্রে নিজেরাও পিছিয়ে পড়ছেন। কিন্তু আমরা জানি, ৬ মাস থেকে শুরু করে ৬ বছর বয়স পযর্ন্ত শিশুদের সাবির্ক সেবা যতেœর নিমিত্তে ডে কেয়ার সেন্টারে শিশুদের জন্য থাকা, খাওয়া, ঘুমানো, প্রাথমিক চিকিৎসা, খেলাধুলা, বিনোদন এবং প্রি-স্কুল সুবিধাসহ যাবতীয় অত্যাধুনিক সুবিধার ব্যবস্থা প্রচলন রয়েছে সমাজে। যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হলেও আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এর অস্তিত্ব এখনও মেলেনি! ক্যাম্পাসে ডে কেয়ার সুবিধার অভাবে আমাদের নারীরা যেমন উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি ক্যাম্পাসের বাইরে দূরে কোথাও সন্তানদের রেখে আসলে আগামী দিনের নক্ষত্র, ফুটফুটে এই শিশু গুলো বঞ্চিত হচ্ছে তাদের অ্যান্টিবডি বা আদশর্ খাবার বুকের দুধ থেকে। যার দরুণ অস্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্থ হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে। বিশ্বায়নের চলমান এই ঝড়ে টিকে থাকতে হলে নারীর শিকড়কে আরও মজবুত করা অত্যাবশ্যক। সেক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর জন্য প্রয়োজনীয় সবোর্ত্তম সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।