আবরারকে মারার পরিকল্পনা করা হয় ৬ দিন আগেই

জিজ্ঞাসাবাদে আটক ছাত্রলীগ নেতাদের চাঞ্চল্যকর তথ্য

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আবরার ফাহাদ
সাখাওয়াত হোসেন বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে মারার পরিকল্পনা করা হয়েছিল আরও ছয়দিন আগে। তবে ওই সময় সে ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে থাকায় পরিকল্পনাকারীরা তার হলে ফেরার অপেক্ষায় ছিল। রোববার বিকেলে আবরার হলে ফিরেছে জেনে সন্ধ্যায় তারা ফের আরেক দফা বৈঠকে বসে। ওই সময় তাকে কোথায় ধরে এনে কীভাবে মারা হবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থী গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানিয়েছে। তদন্তে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে মেহেদী হাসান রাসেল (বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক) এবং অনিক সরকার (তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক) জানায়, ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ৮টা ৫০ মিনিটে আবরার ফাহাদ তার ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট আপলোড করে। সেখানে লেখা ছিল- 'কে বলে হিন্দুস্তান আমাদের কোনো প্রতিদান দেয় না। এই যে ৫০০ টন ইলিশ পাওয়া মাত্র ফারাক্কা খুলে দিছে। এখন আমরা মনের সুখে পানি খাব আর বেশি বেশি ইলিশ পালব। ইনশালস্নাহ আগামী বছর এক্কেবারে ১০০১ টন ইলিশ পাঠাব।' যে পোস্টটি স্বল্প সময়ের মধ্যে ২ হাজার ৪শ' জন ফেসবুক ব্যবহারকারী শেয়ার করেন। এ ছাড়া পোস্টটিতে ৬৩ হাজার লাইক পড়ে। যা বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাদের নজরে আসলে তারা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয় এবং এর পরপরই তারা আবরারকে মারার পরিকল্পনা করে। তবে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে আবরার ছুটিতে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় থাকায় তারা তার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আবরারকে পেটানোর পরিকল্পনা থাকলেও তাকে প্রাণে মেরে ফেলার কোনো অভিসন্ধি তাদের ছিল না বলে দাবি করে তারা। এদিকে মুহতাসিম ফুয়াদ (বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি) তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানায়, এর আগেও আবরার তার ফেসবুকে কাশ্মীর ইসু্য নিয়ে ভারত বিদ্বেষী একাধিক পোস্ট দেয়। যা তাদের নজরে আসার পর ভবিষ্যতে আর এ ধরনের উস্কানিমূলক পোস্ট না দেওয়ার জন্য তাকে হুশিয়ার করে। তবে ওই সময় আবরার এর কোনো প্রতিবাদ না করলেও পরবর্তীতে একই ধরনের পোস্ট দেওয়া অব্যাহত রাখে। যা তাদেরকে উত্তেজিত করে তোলে। আর এ কারণেই ৫ অক্টোবর আবরার ফের ভারতবিদ্বেষী পোস্ট দেওয়ার পর তারা এ বিষয়টি তার (আবরার) পাল্টা চ্যালেঞ্জ হিসেবে 'কাউন্ট' করে। তাই তাকে বড় ধরনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বেধড়ক পেটানোর পরিকল্পনা করা হয়। অন্যদিকে আবরারকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, সদস্য মুনতাসির আল জেমি, মো. মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির ও একই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না পেটানোর ঘটনার সময় উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করলেও তারা তাকে গুরুতর আঘাত করেনি বলে দাবি করে। আবরারকে যারা বেধড়ক পিটিয়েছে তারা আগেই গা ঢাকা দিয়েছে বলেও জানায় তারা। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে গ্রেপ্তারকৃত একাধিক শিক্ষার্থী জানায়, আবরারকে তার রুম থেকে ২০১১ নম্বর রুমে ধরে এনে মারধরের শুরুতে সে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে। এতে মারধরকারীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ কারণে পেটানোর মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে তা হুজুগে রূপ নেয়। ওই সময় আবরার প্রাণভিক্ষা চেয়ে হামলাকারীদের অনেকের পায়ে ধরলেও কেউ তাকে সামান্য দয়া দেখায়নি। এমনকি আবরার কয়েকবার পানি খেতে চাইলেও তাকে তা দেওয়া হয়নি। ঘটনার সময় তাকে কে কীভাবে এলোপাতাড়ি পিটিয়েছে তা কেউ খেয়াল করেনি বলে দাবি করে গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীরা। এদিকে শুধুমাত্র ফেসবুকে ভারতবিদ্বেষী পোস্ট দেওয়ার কারণেই আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে গোয়েন্দারা। একই সঙ্গে তদন্তের ক্ষেত্রে আরো সাতটি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- আবরারকে পিটিয়ে হত্যার মূল পরিকল্পনায় কারা? এদের নেপথ্যে বিশেষ কেউ বা কোনো গোষ্ঠী ইন্ধন দিয়েছে কিনা? আবরার নিজের খেয়ালে ভারতবিদ্বেষী পোস্ট দিয়েছে কিনা? না-কি কেউ তাকে এ ব্যাপারে উস্কানি দিয়েছে? তার দেওয়া পোস্টে এতো স্বল্প সময়ে হাজার হাজার লাইক পড়লো কীভাবে? এছাড়া এতো বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিই কেন তা দ্রম্নত শেয়ার করল? এসব বিষয় সামনে রেখে তদন্ত শুরু করতে চায় গোয়েন্দারা। এছাড়া আবরারের হত্যাকারী হিসেবে গ্রেপ্তারকৃত ১০ শিক্ষার্থী এবং এ মামলার পলাতক ৯ আসামির বাইরে আরও কেউ এ ঘটনায় জড়িত ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। তদন্তে সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের রিমান্ডে এনে এ ব্যাপারেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এতে নতুন কারও নাম পাওয়া গেলে তাকেও এ মামলায় আসামি করা হবে। আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় কোনো গুরুত্ব পাবে না বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের আইসিটি বিষয়ে পারদর্শী একজন কর্মকর্তা জানান, আবরারের ফেসবুক মিউচু্যয়াল ফ্রেন্ডের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও তার ফলোয়ার ১৬ হাজার ২৭১ জন। যা তার মতো একজন সাধারণ ছাত্রের জন্য কিছুটা অস্বাভাবিক। এছাড়া তার ভারতবিদ্বেষী সর্বশেষ পোস্টটিতে লাইক পড়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার এবং পোস্টটি ৫৪ হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে। যা সাধারণত খ্যাতনামা ব্যক্তিদের পোস্টের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। অথবা বুস্ট-আপ করেও এ সংখ্যা বাড়ানো হয়। তাই এর নেপথ্যে বিশেষ কোনো কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা জরুরি। এ ইসু্যটি থেকে আবরার হত্যাকান্ডের প্রকৃত মোটিভ বেরিয়ে আসতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। এদিকে মঙ্গলবার বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমিতসংখ্যক সহপাঠীদের সঙ্গে আবরারের সখ্যতা ছিল। ক্যাম্পাস রাজনীতির ব্যাপারেও তার তেমন আগ্রহ ছিল না। বরং লেখাপড়া করে সময় কাটাতেই সে বেশি পছন্দ করত। শিবির বা কোনো রাজনৈতিক দলের বিশেষ কারও সঙ্গে তার সখ্যতার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বুয়েটের অন্তত এক ডজন শিক্ষার্থী জানান, ফেসবুকে সরকার, আওয়ামী লীগ কিংবা ভারতবিরোধী পোস্ট দিলেই ছাত্রলীগের ক্যাডাররা তাকে দ্রম্নত খুঁজে বের করত। এদের দুই একজনকে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হলেও বেশিরভাগ পোস্টকারীকে বেধড়ক মারধর করা হতো। ফেসবুকে আওয়ামী লীগ ও সরকারবিরোধী পোস্ট দেওয়ায় গত ফেব্রম্নয়ারি, জুন, জুলাই ও আগস্টে অন্তত ৫ জন শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ কেড়ে নেওয়া এবং মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত একজন শিক্ষার্থী ঢাকার একটি ক্লিনিকে গোপনে চিকিৎসা নিয়েছেন। শুধু এসব কারণেই নয়, ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও ক্যাডাররা নানা তুচ্ছ কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হতেন বলেও অভিযোগ করেন তারা। প্রসঙ্গত, আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় তার বাবা বরকতুলস্নাহ সোমবার রাত ৮টার দিকে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি মামলা রুজু করেন। মঙ্গলবার সকালে এ মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত আবরার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ১০ আসামিকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।