শিশুতোষ গল্প

তিতুনের বাঁশি

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

শশধর চন্দ্র রায়
এক রাজার বাড়িতে রাখাল বালক হিসেবে কাজ করত তিতুন। রাজার বাড়ির পাশে খরস্রোতা একটি নদী ছিল। নদীর তীরে বালুচরে গোচারণের কাজ করত সে। গরুগুলোর সঙ্গে তার সখ্যতা দিন দিন বেড়ে গিয়েছিল। তাকে দেখে গরুগুলো 'হাম্বা, হাম্বা' চিৎকার করত। তিতুন চিৎকার শুনে বুঝতে পারত যে, গরুগুলো তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তাকে বাঁশি বাজাতে বলছে। গরুগুলো বাঁশির সুর শোনার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকত। তিতুন তার বাঁশি বাজাতো, আর বাঁশির সুর শুনে গরুগুলোর চোখে হাসি ফুটে উঠত। তিতুনের বাঁশির সুর শুনে রাজাও বেজায় খুশি হতেন। রাজার এক কন্যা ছিল। রাজকুমারীর নাম ছিল টিমটিম। তিতুনের বাঁশির ভক্ত হয়ে গিয়েছিল সে। রাজকুমারীর বয়স যখন উনিশ, তখন বিয়ে ঠিক হলো তার। টিমটিম এর বিয়েতে খুব আনন্দ, হইচই হবে একথা তিতুন জানত। হঠাৎ একসময় রাজা তাকে ডেকে পাঠান। তাকে বলেন, 'তিতুন, বিয়ের অনুষ্ঠানে তোমাকে বাঁশি বাজাতে হবে।' একরকম বাধ্য হয়েই তিতুন বাঁশি বাজাতে রাজি হয়। রাজকুমারীর বিয়ে। বিয়েবাড়ি জাঁকজমকপূর্ণ। অতিথিদের ভিড়ে পূর্ণ হয়ে গেছে রাজার বাড়ি। ভোজনপর্ব শেষ হলে রাজা অতিথিদের খুশি করার জন্য বাড়িতে নাচ-গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে তিতুন বাঁশি বাজায়। বাঁশির সুর শুনে সবাই মুগ্ধ হন। রাজার বাড়িতে কাজ করার সময় তিতুনের কোনো অভাব ছিল না। না খাওয়ার, না জামা-কাপড়ের, না জুতা-স্যান্ডেলের। এককথায় সুখেই দিন কাটছিল তার। রাজার বাড়িতে সিন্দুক ছিল। সিন্দুকে থাকত টাকা-পয়সা, অলঙ্কারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। একদিন রাজা দেখলেন, সিন্দুকের মধ্যে রাখা টাকা-পয়সা, অলঙ্কার হারিয়ে গেছে। রাজা ভাবলেন, এটা নিশ্চয়ই রাখাল তিতুনের কাজ। রাজা তিতুনকে ডেকে ভর্ৎসনা করলেন। বললেন, এতদিন কি আমি দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি! চুরি করার জন্য তোমায় শাস্তি পেতে হবে। আর শাস্তি হলো, তোমাকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। আজ থেকে এখানে তোমার গোচারণের কাজ আর করতে হবে না। তিতুন বারবার বিনয়ের ভঙ্গিতে বলল, 'রাজামশায়, আমি চুরি করিনি। আমায় বিশ্বাস করুন।' কিন্তু কে শোনে কার কথা রাজা তার সিদ্ধান্তে যে অটল। তিতুন রাজার বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়িতে চলে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে সেই বাঁশিটা। তিতুন কাঁদো কাঁদো গলায় তার মাকে বলে, 'মা, রাজামশায় আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি নাকি টাকা-পয়সা, অলঙ্কার চুরি করেছি।' মা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, মন খারাপ করিস না বাছা। রাজা না বুঝে-সুজে তোকে সন্দেহ করেছে। তিতুন এখন প্রতিদিন সকাল হলেই নাশতা সেরে বাড়ি থেকে বের হয়। বাঁশিটা হাতে নেয়। হাট-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে, কোথাও জনসমাগম হলেই সে সেখানে বাঁশি বাজায়। শ্রেম্নাতারা বাঁশির সুর শুনে তাকে টাকা-পয়সা দেয়। যেটুকু আয় হয়, সেটুকুই তিতুন তার মায়ের হাতে তুলে দেয়। মা তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালান। তিতুনের বাবা নেই। দুই বছর আগে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু যে বাঁশিটা আজ তিতুনের প্রিয় বন্ধু, সেটি তার বাবারই দেয়া। বাবা ছিলেন গরিব কৃষক। একদিন ধানখেতে কাজ করার সময় চোখে পড়ে একটি বাঁশি। বাঁশিটি দেখে তিনি ভাবতে পারছিলেন না, কী করবেন তার মনে পড়ে, তিতুন একদিন তার কাছে একটি বাঁশির আবদার করেছিল। কিন্তু তার পক্ষে সেই আবদার পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি তিতুনের কথা ভেবে বাঁশিটি কুড়িয়ে এনে তিতুনকে দিয়েছিলেন। বাঁশি পেয়ে তিতুনের সে কী খুশি! তারপর তিতুন তার দূরসম্পর্কীয় এক দাদুর কাছে বাঁশি বাজানো শিখেছিল। হঠাৎ করে তিতুনের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুচিকিৎসার অভাবে তিনি মারা যান। তিতুন নিজকে বড্ড একা অনুভব করে। সে ঘরে বসে একাকী কাঁদে। চোখের জলে তার বুক ভেসে যায়। তার কিছুই ভালো লাগে না। পেটে খিদে লাগে। ঘরে যে চাল নেই, ডাল নেই, কোনো খাবার নেই। কী করবে সে মাথায় হাত রেখে ভাবতে থাকে তিতুন। এসময় বাবা-মায়ের কথা তার খুব মনে পড়ে। হঠাৎ তিতুন শুনতে পায়, তার সঙ্গে কে যেন কথা বলছে। 'তিতুন, কেঁদো না। আমিতো আছি।' ঘরের ভেতর কাউকে খুঁজে না পেয়ে তিতুন ভয় পায়। বাঁশি বলে, ভয় পেয়ো না। আমি তোমার প্রিয় বন্ধু, বাঁশি। আমি তোমার সঙ্গে আছি। দুঃখের দিনে তোমাকে যদি সাহায্য করতে না পারি, তাহলে আমি তোমার কেমন বন্ধু? তিতুন বলে, তুমি আমাকে কীভাবে সাহায্য করবে? বাঁশি বলে, 'বিশ্বাসে মেলে বস্তু, তর্কে বহুদূর। তুমি আমার কাছে যা চাবে, তা-ই পাবে।' তিতুন বলে, ঠিক আছে। আমার তো খুব খিদে পেয়েছে। আমাকে কিছু খাবার এনে দাও। তৎক্ষণাৎ বাঁশি খাবার এনে দেয়। তিতুন দেখে, টেবিলের উপরে অনেক সুস্বাদু খাবার সাজানো। বিস্কুট, চানাচুর, পাউরুটি, আপেল, আরও কত কী! বাঁশি বলে, 'বন্ধু, তুমি কি খুশি হয়েছ?' তিতুন বলে, 'হঁ্যা, আমি খুব খুশি হয়েছি। তুমিই আমার সত্যিকারের বন্ধু।' তিতুন বাঁশিটাকে এখন সবসময় আদর করে। মন যখন যা চায়, তা-ই তার বন্ধু বাঁশির কাছে আবদার করে। এভাবে তিতুনের সুখেই দিন কাটে।