ঘনিষ্ঠ মিত্রের প্রস্থান

বাইডেনের জয়ে নতুন বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্য

কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার সম্পর্ক ১৯৪৫ সাল থেকে। বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বিশাল কোনো পরিবর্তন হয়তো দেখা যাবে না; কিন্তু সৌদি আরবের কাছ থেকে একটু দূরে সরে যাওয়া এবং ইরানের সঙ্গে আলাপ বাড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণা করার পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নতুন এই প্রেসিডেন্টকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। কিন্তু সৌদি আরবের নেতৃত্ব সাড়া দিতে বেশ সময় নিয়েছেন। অথচ চার বছর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন জিতেছিলেন অভিবাদন জানাতে এক মুহূর্তও দেরি করেননি তারা। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ সৌদি নেতৃত্ব বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর একজন বন্ধুকে হারিয়েছে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় সৌদি আরব এবং উপসাগরে তাদের অনুগত মিত্র দেশগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিণতি অপেক্ষা করছে। কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার সম্পর্ক ১৯৪৫ সাল থেকে। ওঠানামা থাকলেও এ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে, কিন্তু তাতে পরিবর্তন আসন্ন এবং সেই পরিবর্তনের অনেক কিছুই উপসাগরীয় নেতাদের পছন্দ হবে না। সৌদি রাজপরিবারের বড় একজন মিত্র এবং সমর্থক ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৭ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রথম আনুষ্ঠানিক বিদেশ সফর শুরু করেছিলেন তিনি সৌদি আরব দিয়ে। ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার ক্ষমতাধর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। ২০১৮ সালে স্বেচ্ছা নির্বাসিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকান্ডে যখন সিআইএসহ পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যুবরাজ মোহাম্মদকে সন্দেহ করে, তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ নিয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেন। প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড সম্প্রতি প্রকাশিত তার সাড়া জাগানো একটি বইতে লিখেছেন- তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প গলা উঁচিয়ে বলেছিলেন তিনি সৌদি যুবরাজকে রক্ষা করেছেন। জামাল খাশোগি হত্যাকান্ডের পর মার্কিন কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ৮০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন করেছিলেন ট্রাম্প। ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ বন্ধে কংগ্রেসে এক প্রস্তাবে তিনি ভেটো দেন। সুতরাং বলাই বাহুল্য, সৌদি আরব এবং সেই সঙ্গে কিছুটা হলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন হোয়াইট হাউসে তাদের বড় একজন মিত্র হারাতে চলেছে। তবে তাতে যে সবকিছুই বদলে যাবে তা হয়তো নয়, তবে কোথাও কোথাও বর্তমান পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধ এবং এর ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শেষদিকে ক্রমেই অস্বস্তি প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও একই মত পোষণ করতেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন হোয়াইট হাউস ছাড়েন, তখন ইয়েমেনের যুদ্ধের দুই বছর পার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সামরিক কোনো সুফল তো আসেনি, বরং ইয়েমেনে জানমাল এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল। মার্কিন কংগ্রেসের ভেতর ইয়েমেনের যুদ্ধ নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হতে শুরু করে; যার ফলে প্রেসিডেন্ট ওবামা সৌদি আরবে সামরিক এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা কমিয়ে দেন। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেসব সাহায্য ফিরিয়ে আনেন। সেই চিত্র আবারও বদলে যেতে পারে। নির্বাচনের আগে গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্সে এক বক্তৃতায় জো বাইডেন স্পষ্ট করে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বে সর্বনাশা যুদ্ধে মার্কিন সাহায্য বন্ধ করে দেবেন। শুধু তাই নয়, বাইডেন আরও বলেছিলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন করে পর্যালোচনার নির্দেশ দেবেন তিনি। সুতরাং ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধে সৌদি আরব এবং ইয়েমেনে তাদের মিত্রদের ওপর বাইডেন প্রশাসনের যে চাপ বাড়বে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে সৌদি এবং আমিরাতিরাও সম্প্রতি উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, যুদ্ধ করে ইয়েমেনে জয় সম্ভব নয়। তারা মুখ রক্ষা করে সংঘাত থেকে বেরুনোর একটা রাস্তা খুঁজছে। তারা শুধু দেখাতে চায়, ২০১৫ সালে যুদ্ধ শুরুর সময় হুতি বিদ্রোহীদের যে শক্তি ছিল, এখন তা আর তাদের নেই। ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বে যুদ্ধের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রায় নিশ্চিতভাবে প্রত্যাহার করবেন জো বাইডেন। বেসামরিক লোকজনের মৃতু্য, মানবিক বিপর্যয়ের কারণে ইয়েমেনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে বড় ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। ওয়াশিংটনে গবেষণা সংস্থা আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের মেরি ড্যানিয়েল পেস্নটকা বলেন, মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বিশাল কোনো পরিবর্তন হয়তো দেখা যাবে না, কিন্তু সৌদি আরবের কাছ থেকে একটু দূরে সরে যাওয়া এবং ইরানের সঙ্গে আলাপ বাড়ানোর সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। বারাক ওবামার মধ্যপ্রাচ্য নীতির সবচেয়ে বড় ছাপ ছিল ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি যেটি জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ পস্ন্যান অব অ্যাকশন (জেপিসিওএ) নামে পরিচিত। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে সে দেশকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখা। তবে সৌদি আরব এবং ইসরাইলের এই চুক্তি নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল। তাদের যুক্তি ছিল- এই বোঝাপড়ার মাধ্যমে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে বিরত রাখা যাবে না, বরং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে তাদের শক্তি বাড়বে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও এই যুক্তি পুরোপুরি গ্রহণ করেন। তার ভাষায়, সর্বকালের সবচেয়ে জঘন্য চুক্তি থেকে একতরফা সিদ্ধান্তে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনেন। এখন তার উত্তরসূরি জো বাইডেন ওই চুক্তিতে আবারও অংশীদার হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছেন। আর এই সম্ভাবনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন সৌদি আরব। গত বছর সৌদি তেল স্থাপনায় রহস্যজনক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর রিয়াদে সৌদি সরকারের এক সংবাদ সম্মেলনে সে দেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের ইরানের পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সৌদি আরবের এই মন্ত্রী বলেছিলেন, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সর্বনাশ ডেকে আনছে। কারণ তার মতে, এই চুক্তিতে ইরানের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি এবং সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তাদের অনুগত মিলিশিয়াদের যেভাবে ইরান শক্তিশালী করে চলেছে তাও ভাবা হয়নি। আদেল আল জুবায়ের বলেন, ইরানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক এই চুক্তি ওবামা প্রশাসনের একটি ভ্রান্ত নীতি ছিল। কারণ ওই সরকার বুঝতে পারেনি যে ইসলামি প্রজাতন্ত্রটি মধ্যপ্রাচ্যে কতটা হুমকি তৈরি করেছে। গত জানুয়ারিতে যখন ইরাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের রেভলু্যশনারি গার্ডের ক্ষমতাধর কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়, তখন সৌদি আরব এবং তার উপসাগরীয় মিত্ররা খুশি হয়েছে। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ