শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
করোনা মিউটেশন

ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমার সম্ভাবনা এখনই নেই

করোনাভাইরাসের গায়ে যে কাঁটার মতো স্পাইকগুলো থাকে, এই মিউটেশনের ফলে সেগুলোর প্রোটিনে এমন কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, যাতে এটা আরও সহজে মানুষের দেহকোষে ঢুকে পড়তে পারছে। এটিই বিজ্ঞানীদের বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ...
যাযাদি ডেস্ক
  ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

সব ভাইরাসেরই মিউটেশন হয়, অর্থাৎ এটা নিজেকে নিজে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করতে থাকে। সাধারণত দেখা যায়, প্রতি একমাস সময়কালে এক বা দুটি পরিবর্তন হয়ে থাকে। অনেক সময় এই মিউটেশনগুলো ভাইরাসের আচরণের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না বা ফেললেও তা হয় খুবই নগণ্য।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ড. লুসি ভ্যান ডর্প হচ্ছেন মানবদেহে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের বিবর্তনের ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, 'বেশিরভাগ সময়ই এগুলো গুরুত্বহীন এবং খুব বিরল দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া এটা ক্ষতিকর কিছুও নয়। 'সার্স-কোভ-টু'র জেনোমে আমরা যে মিউটেশনগুলো দেখেছি, তার বেশিরভাগই ভাইরাসটির আচরণে কোনো পরিবর্তন আনে না।'

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে প্রথম যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়েছিল, সেটা এখন পর্যন্ত অন্তত ১৭ বার পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক পরিবর্তনই ভাইরাসের আচরণে কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু দু-একটি ক্ষেত্রে ভাইরাসটি এমন কিছু মিউটেশন ঘটিয়ে ফেলে, যা তাদের টিকে থাকা এবং বংশবৃদ্ধির ক্ষমতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ রকম মিউটেশন বহনকারী ভাইরাস তখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটাতে থাকে, যদি মহামারি ছড়ানোর পূর্বশর্তগুলো অনুকূল থাকে।

ব্রিটেন থেকে ছড়ানো করোনাভাইরাসের যে মিউটেশনটি নিয়ে এখন সারা দুনিয়ায় হইচই চলছে তার নাম 'ই.১.১.৭'। এটির সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা অন্য প্রজাতিগুলোর চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি। ব্রিটেনে এটি এখন ছড়াচ্ছে অস্বাভাবিক দ্রম্নতগতিতে।

করোনাভাইরাসের গায়ে যে কাঁটার মতো স্পাইকগুলো থাকে, এই মিউটেশনের ফলে সেগুলোর প্রোটিনে এমন কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, যাতে এটা আরও সহজে মানুষের দেহকোষে ঢুকে পড়তে পারছে। এটিই বিজ্ঞানীদের বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ। এই নতুন ধরনের করোনাভাইরাসে ১৪টি মিউটেশন চিহ্নিত করা হয়েছে।

ভাইরাসের মধ্যে প্রোটিন তৈরির উপাদান হচ্ছে অ্যামিনো এসিড এবং তাতে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসছে এই মিউটেশন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, হয়তো এর কোনো কোনোটি ভাইরাসটির দ্রম্নত ছড়াতে পারার ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলছে। এসব মিউটেশনের কথা বৈজ্ঞানিকদের আগেও জানা ছিল, কিন্তু এত বিশদভাবে নয়। স্পাইক প্রোটিনে 'এনফাইভ জিরো ওয়ান' নামে একটি মিউটেশনের কথা আগে জানা গিয়েছিল। কিন্তু এখন এটির বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তন হয়ে থাকতে পারে।

করোনাভাইরাসের নতুন এই প্রকারটি চিহ্নিত হয়েছে ব্রিটেনে। কিন্তু এমন হতেই পারে, তার অনেক আগে থেকেই এটি ব্রিটেনের বাইরে কোথাও ছড়াচ্ছিল। হয়তো এটির উৎপত্তিও ব্রিটেনের বাইরে, এমন সম্ভাবনাও আছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি চিহ্নিত হয়েছে ব্রিটেনে। কারণ সেখানে করোনাভাইরাসের ওপর নজরদারির যে বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো আছে, তা অত্যন্ত শক্তিশালী।

এর নাম হচ্ছে কগ-ইউকে বা 'কোভিড-১৯ জেনোমিক্স কনসোর্টিয়াম'। এতে দেড় লাখেরও বেশি 'সার্স-কোভ-টু' ভাইরাসের নমুনার জেনেটিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে এই ভাইরাসের যে পরিমাণ জেনেটিক সিকোয়েন্স সংরক্ষিত আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি আছে এখানে।

এ কারণেই করোনাভাইরাসের নতুন কোনো মিউটেশন হলে এর মধ্যে যে ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো হয়, সেগুলো এই কগ-ইউকের বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।

চলতি বছরের ফেব্রম্নয়ারি-মার্চে যখন ব্রিটেনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়াচ্ছিল, তখন এই বিজ্ঞানীরাই দেখতে পেয়েছিলেন, ভাইরাসটি ব্রিটেনে আসছে মূলত ইউরোপ থেকে। এর আদি উৎপত্তিস্থল চীন থেকে নয়।

করোনাভাইরাসের বিস্তার কীভাবে ঘটছে, তা বুঝতে হলে এই গোয়েন্দাগিরি খুবই জরুরি। আর সে কারণেই যে দেশগুলো করোনাভাইরাসের জেনোমিক সিকোয়েন্সিং করছে, সেসব দেশেই এর নতুন কোনো মিউটেশন হলে তারা ধরা পড়ে যাচ্ছে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস।

ব্রিটেনই একমাত্র দেশ নয়, যেখানে করোনাভাইরাসের এই নতুন রূপ দেখা গেছে। ইউরোপের ইতালি, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে এরই মধ্যে পাওয়া গেছে এটির অস্তিত্ব। পাওয়া গেছে অস্ট্রেলিয়াতেও। তাছাড়া ব্রিটেনে যেহেতু সেপ্টেম্বর থেকেই এই নতুন মিউটেশনটি চিহ্নিত হয়েছিল, তাই মানুষের বিভিন্ন দেশে যাতায়াতের সূত্রে হয়তো এর মধ্যেই এটি আরও কিছু দেশে পৌঁছে গেছে। এখনো তা চিহ্নিত হয়নি।

দক্ষিণ আফ্রিকাতেও পাওয়া গেছে করোনাভাইরাসের একটি নতুন রূপ, যা হয়তো হুবহু একই রকম নয়, তবে প্রায় কাছাকাছি। দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে করোনাভাইরাসের এক নতুন সংস্করণের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে।

এই ভাইরাস এরই মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক মাত্রায় ছড়াচ্ছে, বিশেষ করে আগের তুলনায় এই নতুন রূপের করোনাভাইরাসটি তরুণ জনগোষ্ঠীকে বেশি করে সংক্রমিত করছে। বলা হচ্ছে, এটির সঙ্গে ব্রিটেনে দেখা দেওয়া মিউটেশনটির বেশকিছু মিল আছে। তবে হুবহু এক রকম নয়। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ফাইভ জিরো ওয়ান ভি-টু এখন করোনাভাইরাসের প্রধান ভ্যারিয়েন্টে পরিণত হয়েছে। ব্রিটেনের দক্ষিণে লন্ডন ও অ্যাসেক্স কাউন্টিতে এই নতুন মিউটেশন আগের ভাইরাসগুলোকে হটিয়ে দিয়েছে। এগুলো হয়তো আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় ছড়াচ্ছে। কিন্তু এখনো অনেক কিছুই স্পষ্ট নয়।

বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই বলছেন, নতুন মিউটেশনের ফলে টিকার কার্যকারিতা কমে যাবে, এমন কোনো সম্ভাবনা অন্তত স্বল্পমেয়াদে এখনো নেই। তবে ড. ভ্যান ডর্প বলছেন, আগামী দিনগুলোতে বিজ্ঞানীদের কাছে এই প্রশ্নটি আরও বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আর তা হলো, এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত করোনাভাইরাসের টিকাগুলোর কার্যকারিতার ওপর এই নতুন ধরনের করোনাভাইরাস মিউটেশনগুলোর কোনো প্রভাব পড়বে কিনা। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে