শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি

সৌদির 'আরবঐক্য' জুজুর নেপথ্যে

এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ইসরাইলকে স্বীকৃতির পথ তৈরি করা আর দ্বিতীয়ত, যুবরাজ সালমানের কাঙ্ক্ষিত ক্ষমতার শীর্ষে উঠার পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া।
যাযাদি ডেস্ক
  ১৪ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

সৌদি আরব কর্তৃক কাতারের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার এবং রিয়াদে আরব দেশগুলোর জিসিসি (গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল) সম্মেলনে দেশগুলোর নেতাদের হাসিখুশি মুখ ও উষ্ণ আতিথেয়তা দেখে অনেকেই ভাবতে পারেন যে, 'আরব ঐক্য' বুঝি আর বেশি দূরে নয়। এছাড়া খোদ সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানও ওই সম্মেলনে 'ঐক্যের ডাক' দিয়েছিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমগুলোর পর্যালোচনা বলছে ভিন্ন কথা।

দীর্ঘ অবরোধ-বন্দিদশা থেকে মুক্তি মিলেছে আরবের স্বাধীন দেশ কাতারের। আর এ অবরোধ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে সৌদি আরব তথা দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সময় লেগেছিল তিন বছর ছয় মাসেরও বেশি। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষজ্ঞরা নিষেধাজ্ঞার শুরু থেকেই রিয়াদ ও তাদের মিত্রদের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বোচ্ছার ছিল।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব তথা দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কাতার অবরোধ প্রত্যাহারের পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথ তৈরি করা আর দ্বিতীয়ত, তার বাবা ও সৌদি আরবের বর্তমান বাদশাকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে নিজের কাঙ্ক্ষিত বাদশা হওয়ার পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়া।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বাধীন ভূখন্ড কাতারকে 'একঘরে' করার পর দেশটির ওপর নৃশংস হামলা চালানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর সৌদি জোটকে এ থেকে বিরত রাখে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব জেমস ম্যাটিস এবং সে সময়ে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী রেক্স টিলারসন এ ব্যাপারে বেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। যদিও কাতার অবরোধে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সমর্থন ও ভূমিকা ছিল। এছাড়া বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এক টুইটবার্তায় অবরোধের ব্যাপারে তার সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছিল।

এখন সময় পাল্টেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মসনদেও এসেছে পরিবর্তন। রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হটিয়ে দেশটির ক্ষমতার শীর্ষে অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির জো বাইডেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ব নেতৃত্ব তাকে অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসালেও রিয়াদের তরফ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতে দীর্ঘ সময় নেওয়া হয়েছিল। এর কারণ হিসেবে ট্রাম্পের সঙ্গে সৌদি তথা দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দহরম-মহরম সম্পর্কের কথা-ই উলেস্নখ করা যায়।

আর তাই অনেকের ধারণা, বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার তার মনোযোগ আকর্ষণ করতেই সৌদি যুবরাজ কাতারের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও যে ১৩ দফার ভিত্তিতে সে সময় অবরোধ চাপানো হয়েছিল তার কোনোটাই শেষ পর্যন্ত পূরণ করতে হয়নি কাতারকে। দেশটির প্রসিদ্ধ সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করতে হয়নি। পাল্টাতে হয়নি দেশটির পররাষ্ট্রনীতিও (ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কে ইতি টানার ব্যাপারে ওই ১৩ দফায় উলেস্নখ করা হয়েছিল)।

সৌদি জোট কর্তৃক অবরোধ আরোপের কয়েক সপ্তাহ পরই ইরান ও তুরস্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার ফলে কাতারের শক্তি ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়। কাতারের রাজধানী দোহায় তুর্কি বাহিনীর বীরদর্পে পদাচারণা এবং তেহরানের আকাশসীমা ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ায় ফলে অবরোধ চাপিয়েও বেশি সুবিধা করতে পারেনি রিয়াদ ও তাদের মিত্ররা।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বলা যায়, অবরোধ আরোপের আগে কাতারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যতটা শক্তিশালী ছিল, সৌদি জোটের অবরোধের ফলে তা আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটির আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি দেশটির প্রতিরক্ষা খাতকে শক্তিশালী করতে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েই চলেছেন।

কাতারের জয়

একটি স্বাধীন ভূখন্ডের টুঁটি চেপে ধরার যে ঘৃণ্য পদক্ষেপ নিয়েছিল সৌদি ও তার মিত্ররা, সে লড়াইয়ের বিরুদ্ধে জয় হয়েছে কাতারেরই। এছাড়া এতে পরোক্ষভাবে জয় হয়েছে তুরস্ক ও ইরানেরও। দুবাইয়ে রাজনীতির অধ্যাপক আব্দুলস্নাখালেক আব্দুলস্না বলেন, 'এটা বলা যায় যে, জয় কাতারেরই হয়েছে। সাড়ে তিন বছর আগে কাতারের ওপর যে অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল, তাতে কাতারেরই জয় হয়েছে।'

সৌদির 'আরব ঐক্য' জুজু

সৌদি যুবরাজ সালমান মোহাম্মদ বিন সালমান তার লক্ষ্য পূরণে বর্তমান সময়কেই যথার্থ মনে করেছেন। আর 'ক্রাউন প্রিন্স' হিসেবে তার যাত্রা শুরুর পর থেকেই ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তেলআবিবের একনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার ইহুদি জামাতা জ্যারার্ড কুশনারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।

আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সেনেগালের পর আরব দেশ হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে মুখিয়ে আছে সৌদি আরব। তবে এ ব্যাপারে যুবরাজ সালমান খোলাখুলি স্বীকৃতি না দিয়ে একটু কৌশলী পথে এগোচ্ছেন বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের।

আগামীর অস্থিরতা

সম্প্রতি আরব দেশগুলোর সম্মেলন গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলে (জিসিসি) বেশ হাসিখুশি এবং প্রাণবন্ত ছিলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ। এমনকি কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গেও বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে দেখা গেছে তাকে।

তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মতে, যুবরাজের হাসির আড়ালে খেলা করছে অন্য কিছু। কাতারের ওপর থেকে কার্যত অবরোধ তুলে নিলেও দেশটিসহ আরবের অন্যান্য দেশের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে যেগুলো যুবরাজ তথা সৌদির রাজপরিবারের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার করে থাকে, সেসব গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ চাপাতে পারেন তিনি। যাতে নতুন করে আরব উপদ্বীপে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। মূল : মিডল ইস্ট আই, ভাষান্তর -ফখরুল ইসলাম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে