বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রথম দিনে তিন লাখ প্রয়োগ

বিশ্বের বৃহত্তম টিকাদান কর্মসূচি শুরু ভারতে

প্রথম দফায় টিকা পাবে তিন কোটি মানুষ দেশীয় টিকা নিতে অনীহা চিকিৎসকদের একাংশের
যাযাদি ডেস্ক
  ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
একজন নারীকে টিকা দেওয়া হচ্ছে

দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে শনিবার থেকে ভারতে শুরু হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম করোনার টিকাদান কর্মসূচি। এ দিন স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় একই সঙ্গে তিন হাজার ছয়টি কেন্দ্রে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রতিটি কেন্দ্রে ১০০ জন করে মোট প্রায় তিন লাখ সম্মুখসারির করোনাযোদ্ধা স্বাস্থ্যকর্মীকে এ দিন টিকা দেওয়া হয়। সংবাদসূত্র : বিবিসি, এনডিটিভি, এবিপি নিউজ

টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করে এক ভিডিও কনফারেন্সে নরেন্দ্র মোদি বলেন, 'ইতিহাসে এত বড় টিকাদান কর্মসূচি এই প্রথম। তবে টিকাদান শুরু হলেও মাস্ক ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে ছাড় দিলে চলবে না।' তিনি বলেন, 'আমার অনুরোধ, টিকাদান শুরু হয়েছে বলেই মাস্ক খুলে ফেলা বা সামাজিক দূরত্ব বিধি লঙ্ঘনের ভুল করবেন না। প্রথম ডোজ নেওয়ার পরেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ দ্বিতীয় ডোজ না নেওয়া পর্যন্ত শরীরে পুরোপুরি প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে না। তাই দাওয়াই এবং কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, দুই নীতি মেনেই চলতে হবে আমাদের।'

রেকর্ড সময়ে প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী এবং গবেষকদেরও ধন্যবাদ জানান তিনি। মোদি বলেন, 'প্রতিষেধক কবে আসবে, সেদিকেই তাকিয়ে ছিল দেশবাসী। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হয়েছে। আর এর জন্য বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের প্রশংসা প্রাপ্য। দিন রাত এক করে পরিশ্রম করেছেন তারা। প্রতিষেধক তৈরি সাধারণত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু এক্ষেত্রে রেকর্ড সময়ে আমাদের হাতে জোড়া প্রতিষেধক এসে পৌঁছেছে।'

প্রথম দফায় চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স চালক, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা টিকা পেয়েছেন। এরপর পর্যায়ক্রমে পুলিশ, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এবং অন্য করোনা যোদ্ধাদের টিকা দেওয়া হবে। এছাড়া প্রথম দফায় টিকা পাবে প্রায় তিন কোটি মানুষ।

দ্বিতীয় ধাপে টিকা দেওয়া হবে ৫০ বছরের বেশি বয়স্কদের; বিশেষ করে যাদের আগে থেকেই কোনো না কোনো অসুস্থতা রয়েছে। এদের সংখ্যা প্রায় ২৭ কোটি। টিকাদানের জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। দুই হাজার ৩৬০ জন মূল প্রশিক্ষক দেশটির ৬১ হাজার প্রোগ্রাম ম্যানেজার এবং দুই লাখ ভ্যাক্সিনেটরকে (যারা টিকা দেবেন) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, পশ্চিমবঙ্গে টিকাদান কর্মসূচির প্রথম দিনে রাজ্যটির বিভিন্ন জায়গায় টিকা কেন্দ্রগুলোকে রাজ্য সচিবালয় 'নবান্ন' থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিষেধক প্রয়োগের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং টিকা গ্রহণকারীদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি।

এছাড়া রাজ্যটির রাজধানী কলকাতার সাতজন বিশিষ্ট চিকিৎসককেও প্রথম দিনের প্রতিষেধক নেওয়ার তালিকায় যুক্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পশ্চিমবঙ্গের মোট ২১২টি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে টিকাদানের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় রাজ্যটির মোট ছয় লাখ স্বাস্থ্যকর্মীকে টিকা দেওয়া হবে। শনিবার কলকাতার ১৯টি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই কর্মসূচি শুরু হয়।

এগুলোর মধ্যে কলকাতা মেডিকেল কলেজ এবং অন্য কয়েকটি সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি আরবান (শহুরে) প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালও রয়েছে। প্রতিটি টিকাদান দলে ভ্যাক্সিনেটর ছাড়াও চারজন করে স্বেচ্ছাসেবীও ছিলেন। সেরকম তিন লাখ ৭০ হাজার ব্যক্তিকে কাজ শেখানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিব রাজেশ ভূষণ।

অন্যদিকে, টিকা নেওয়ার জন্য 'কো-উইন' নামে একটি সরকারি অ্যাপে নাম রেজিস্টার করাতে হচ্ছে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে কবে কোন কেন্দ্রে কখন টিকা নিতে হবে, তা এসএমএস করে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। টিকা কেন্দ্রে যাওয়ার পরে নথিপত্র পরীক্ষা করা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে একটি ঘরে অপেক্ষা করতে হবে। তারপর টিকা দেওয়ার ঘরে পাঠানো হবে টিকা গ্রহণকারীকে। টিকা নেওয়ার পর অন্তত আধাঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হবে। কোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে কেন্দ্রেই তার চিকিৎসা করা হবে এবং প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।

ভারতে টিকাদান কর্মসূচিতে যেসব ডোজ ব্যবহার হচ্ছে, সবই ভারতে তৈরি হয়েছে। দেশটির ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা করোনার দুটি ভ্যাকসিনকে জরুরিভিত্তিতে ছাড়পত্র দিয়েছে। এর একটি অক্সফোর্ড আবিষ্কৃত 'কোভিশিল্ড', যেটি ভারতে উৎপাদন করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। অন্যটি ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষণা কাউন্সিল বা আইসিএমআর ও ভারত বায়োটেক সংস্থার তৈরি 'কোভ্যাকসিন'।

দেশীয় টিকা নিতে অনীহা ভারতীয় চিকিৎসকদের একাংশের

এদিকে, করোনার টিকাকরণ শুরু হওয়ার প্রথম দিনেই ধাক্কা। ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাকসিন নিতে বেঁকে বসেছেন চিকিৎসকদের একাংশ। তাদের দাবি, কোভিশিল্ড পরীক্ষার তিনটি ধাপই উৎরে গেছে। সেক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে কোভ্যাকসিন। তাই কোভিশিল্ডের ওপরই আস্থা তাদের। টিকাকরণে কোভ্যাকসিন ব্যবহার করা হলে তাতে অংশ নেবেন না তারা।

হায়দরাবাদের ভারত বায়োটেকের তৈরি করোনা প্রতিষেধক কোভ্যাকসিনকে ছাড়পত্র দেওয়া নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে। এবার তাতে শামিল হলেন দিলিস্নর অন্যতম বৃহত্তম চিকিৎসাকেন্দ্র 'রাম মনোহর লোহিয়া' হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসকরা। হাসপাতালের মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্টকে চিঠি লিখে কোভ্যাকসিন নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছেন তারা।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ওই চিঠিতে লেখা হয়, 'ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাকসিনের তুলনায় সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভিশিল্ডেই আমাদের আস্থা বেশি। কোভ্যাকসিন পরীক্ষার সব কটি ধাপ এখনো সম্পূর্ণ করতে পারেনি। সেক্ষেত্রে টিকাকরণের লক্ষ্যই অধরা থাকে। তাই টিকাকরণে আমাদের সার্বিক যোগদান না-ও দেখা যেতে পারে। কোভিশিল্ড পরীক্ষার সব কটি ধাপ উৎরে গেছে। টিকাকরণের ক্ষেত্রে সেটি ব্যবহার করতে অনুরোধ জানাচ্ছি।'

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্মাল্য মহাপাত্র জানিয়েছেন, হাসপাতালের বহু চিকিৎসকই টিকাকরণের জন্য নাম নথিভুক্ত করেননি। তিনি বলেন, 'কোভ্যাকসিন নিয়ে সংশয় রয়েছে আমাদের। পরীক্ষাই সম্পূর্ণ হয়নি। তার চেয়ে কোভিশিল্ডের ওপর আমাদের আস্থা বেশি।'

ব্রিটিশ-সুইডিশ সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কোভিশিল্ড প্রতিষেধকটি তৈরি করেছে। তাদের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ভারতে ওই প্রতিষেকটি উৎপাদনের দায়িত্বে রয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউট। অন্যদিকে, ইনডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোভ্যাকসিন তৈরি করেছে ভারত বায়োটেক।

কিন্তু তিনটি ধাপে পরীক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই কোন যুক্তিতে কোভ্যাকসিনকে ছাড়পত্র দেওয়া হলো, তা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠছে। বিরোধী শিবিরের রাজনীতিকরা তো বটেই, দেশটির তাবৎ চিকিৎসক এবং গবেষকরাও কোভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে