শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিশেষ প্রতিবেদন

অবিশ্বাসের বেড়াজালে ফিলিস্তিনের ভোট

যাযাদি ডেস্ক
  ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

দেড় দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো হতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের জাতীয় নির্বাচন আদৌ হবে কিনা, হলেও তা কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসবে কিনা, তা নিয়ে ব্যাপক সন্দিহান সাধারণ ফিলিস্তিনিরা। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক হানাহানি, বিচ্ছিন্ন তিনটি অঞ্চল আর নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অবিশ্বাস তো আছেই।

দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের মধ্যে চলে আসা বিভক্তি কমিয়ে আনতে গত শুক্রবার ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আগামী মে মাসে পার্লামেন্ট এবং জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। তার প্রধান প্রতিপক্ষ ইসলামপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসও এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে।

আব্বাসের এ ঘোষণাকে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে খুশি করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। ট্রাম্পের মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছে যাওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা এখন বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব জোরদারের চেষ্টা করছে। তবে আব্বাসের এ নির্বাচনের ঘোষণা নিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যেই খুব একটা উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে না।

'ফিলিস্তিনি সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ'র ডিসেম্বরের এক জরিপে অংশ নেওয়া ফিলিস্তিনিদের ৫২ শতাংশ বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো নির্বাচন হলে তা অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না বলেই মনে করছেন তারা। নির্বাচনে যদি হামাস জেতে, তাহলে আব্বাসের দল ফাতাহ ফল মেনে নেবে না বলে মনে করেন ৭৬ শতাংশ ফিলিস্তিনি। ফাতাহর জয় হামাস প্রত্যাখ্যান করবে, এমনটা বিশ্বাস করেন ৫৮ শতাংশ মানুষ।

পশ্চিম তীরের বর্ষীয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক হানি আল-মাসরি বলেন, 'আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছি, কিন্তু এখনো অনেক দূর যেতে হবে। সামনে অনেক বাধা আছে, সেসব বাধা টপকাতে না পারলে এই পুরো কার্যক্রমই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।'

যেসব বাধার কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে 'প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন'র (পিএলও) দুই প্রভাবশালী সংগঠন হামাস ও ফাতাহর মধ্যে বৈরিতাও আছে বলে জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি পর্যবেক্ষকরা। অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অংশ নিতে দেওয়া হবে কিনা এবং ৮৫ বছর বয়সি অসুস্থ আব্বাস ফের নির্বাচনে দাঁড়াবেন কিনা, কিনারা হয়নি এসব প্রশ্নেরও।

এদিকে, ফিলিস্তিনের কোনো সরকারে হামাস থাকলে সেই সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোনো ধরনের চুক্তিতে যাবে না বলেও আভাস রয়েছে। হামাস পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য ফিলিস্তিনে নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি সংক্রান্ত মুখপাত্র বলেন, 'নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে ইইউ প্রস্তুত। ইইউ একই সঙ্গে ফিলিস্তিনের সব অঞ্চলে নির্বাচন আয়োজনে সহযোগিতা করতে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের প্রতিও আহ্বান জানাচ্ছে।' এছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের এক মুখপাত্র বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় সক্ষম হয়ে উঠতে ফিলিস্তিনিদের এ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করতে জাতিসংঘ প্রস্তুত। এ নির্বাচন 'ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ' হতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

আব্বাসের ঘোষণা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ইসরাইলি কর্মকর্তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। পূর্ব জেরুজালেমে নির্বাচন আয়োজনে আগের মতো এবারও ইসরাইল অনুমতি দেবে কিনা সে সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ফিলিস্তিনিরা গাজা ও পশ্চিম তীরের মতো পূর্ব জেরুজালেমেও নির্বাচন আয়োজনে আগ্রহী। ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান হানা নাসির শনিবার বলেন, 'আমাদের অন্যান্য বিকল্পও আছে; গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জেরুজালেমের বাসিন্দাদের নির্বাচনে অংশ নিতে পারা।'

সর্বশেষ ২০০৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হামাসের নাটকীয় জয়ের পর ফাতাহর সঙ্গে সশস্ত্র এ গোষ্ঠীটির বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একপর্যায়ে গৃহযুদ্ধ বেধে যায় এবং পরের বছরই হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। গাজা এখনো হামাসের নিয়ন্ত্রণে; আব্বাসের দলের প্রাধান্য ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরে।

দুই পক্ষ বেশ কয়েকবার আলোচনা ও বিভিন্ন ইসু্যতে সমঝোতায় পৌঁছালেও তাদের মধ্যে বিরোধ পুরোপুরি মেটাতে পারেনি। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গত দেড় দশকে নির্বাচনের একাধিক তারিখ ঘোষণা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা তাদের ঘোষণার দিন নির্বাচন করতে পারেনি।

বিভিন্ন মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার সংগঠন উভয়পক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগও করে আসছে।

নির্বাচনি ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, '২২ মে পার্লামেন্ট এবং ৩১ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।' ২০০৫ সালে হওয়ার সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আব্বাস জিতেছিলেন, তার আনুষ্ঠানিক মেয়াদ ছিল চার বছর। কিন্তু নির্বাচন না হওয়ায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এক যুগ ধরে তিনি একই দায়িত্বে আছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, প্রেসিডেন্টের এবারের ঘোষণায়ও ফিলিস্তিনিরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। গাজার এক বাসিন্দা বলেন, 'ইসরাইল, বিদ্রোহী গোষ্ঠী, ক্ষমতা ভাগাভাগি, কতকিছু। আমি আশা দেখছি না। কারণ নির্বাচন বাতিলের জন্য হাজারও কারণ খুঁজে পাবে তারা।' করোনাভাইরাসের কারণে দেওয়া লকডাউন অমান্য করায় তিনি নিজের নাম বলতে রাজি হননি।

তবে বেথেলহেমের ৫৭ বছর বয়সি চিকিৎসক জুহাইর আল-খতিব ভোট নিয়ে ব্যাপক আশাবাদী। তিনি বলেন, 'এটি শতভাগ ভালো সিদ্ধান্ত। আমাদের একটি পরিস্থিতির সূচনা করা উচিত, থাকা উচিত গণতন্ত্র।' সংবাদসূত্র :রয়টার্স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে