ইউক্রেন সংকট

যুদ্ধ করার ইচ্ছা রাশিয়ার নেই

ম আগামী মাসেই হামলার সম্ভাবনা দেখছে বাইডেন ম ইউক্রেন সমস্যা সামনে রেখে ন্যাটোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা ফ্রন্ট তৈরি করতে চাইছে ম পুতিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর, তবে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর

প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ম যাযাদি ডেস্ক
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা রাশিয়ার নেই, তবে নিজের ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে রাশিয়া কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত নয় সাফ জানিয়ে দিয়েছে মস্কো। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ শুক্রবার মস্কোতে এক সংবাদ সম্মেলনে ইউক্রেন ইসু্যতে তার দেশের অবস্থান তুলে ধরেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার হামলা নিয়ে সতর্ক করার পর রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাল। বাইডেন বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, রুশ সেনারা যেকোনো মুহূর্তে ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, উত্তেজনা বাড়িয়ে আগামী মাসেই (ফেব্রম্নয়ারি) হামলা হতে পারে। সংবাদসূত্র : রয়টার্স, এপি, এএফপি, বিবিসি, আল-জাজিরা বাইডেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মস্কোয় এক সংবাদ সম্মেলনে ল্যাভরভ বলেন, 'রাশিয়া আশা করে, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পাশ্চাত্য মিত্ররা রাশিয়ার প্রকৃত অবস্থান উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।' বাইডেনের সেঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের ফোনালাপের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার অবস্থান তুলে ধরলেন ল্যাভরভ। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ সময় বাইডেন বলেন, আগামী ফেব্রম্নয়ারি মাসে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে বলে 'সুনিশ্চিত বা অতি স্পষ্ট সম্ভাবনা' রয়েছে। হোয়াইট হাউস বলছে, বাইডেন-জেলেনস্কির ফোনালাপ এবং সেখানে সম্ভাব্য হামলার হুঁশিয়ারি কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। বাইডেনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার একটি টুইট করেছেন জেলেনস্কি। সেখানে তিনি লিখেছেন, উত্তেজনা কমানোর জন্য কী কী কূটনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে। পাশাপাশি প্রয়োজনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যৌথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও হয়েছে। বাইডেনকে ধন্যবাদ ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য করার জন্য। প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যের কথাও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন। গত ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কাছে চিঠি লিখেছিল রাশিয়া। রাশিয়ার মুখপাত্র জানিয়েছেন, চিঠিতে রাশিয়ার চিন্তার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বস্তুত, চিঠিকে কার্যত একতরফা বলে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। রাশিয়া জানিয়েছে, আলোচনায় তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের সমস্যার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো এখন পর্যন্ত তাতে আগ্রহ দেখায়নি। এই পরিস্থিতিতে উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে না রাশিয়া। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সমস্যাটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় তুলতে চাইছে। দ্রম্নত এ বিষয়ে জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নিক, এটাই দাবি দেশটির। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড জানিয়েছেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে আলোচনা করতে চায় বাইডেন প্রশাসন। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জানিয়েছেন, উত্তেজনা কমার কোনো রুপালি রেখা এখনো তারা দেখতে পাচ্ছেন না। তবে আলোচনার একটি রাস্তা খোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফোনালাপে কী কী আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি মার্কিন মুখপাত্র। তবে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ইউক্রেন সমস্যাকে সামনে রেখে ন্যাটোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি পশ্চিমা ফ্রন্ট তৈরি করতে চাইছে। রাশিয়া হামলা চালালে যাতে তার জবাব দেওয়া যায়, সেটাই হবে ফ্রন্টের লক্ষ্য। রাশিয়া জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যেভাবে পূর্ব ইউরোপে সেনা সাজাচ্ছে, তা রাশিয়ার কাছে বড় হুমকি। পরিস্থিতির ওপর তারা নজর রাখছে। তবে তারা ধীরে চলো নীতি নিয়েছে। রাশিয়া বলেছে, ইউক্রেন নিয়ে চলমান অচলাবস্থায় তাদের প্রধান নিরাপত্তা উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্র আমলে নিতে রাজি নয় এটি পরিষ্কার হয়ে গেলেও দুই পক্ষই আরও আলোচনার জন্য তাদের দরজা খোলা রেখেছে। এদিকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের যে হুমকি পশ্চিমা দেশগুলো দিয়েছে, তাকে 'অকার্যকর তবে রাজনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিকর' বলে বর্ণনা করেছে মস্কো। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপের কার্যকর কোনো প্রভাব থাকবে না। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি পুতিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক দিক দিয়ে 'বেদনাদায়ক নয় বরং ধ্বংসাত্মক'। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপের কার্যকর কোনো প্রভাব থাকবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তিন দিন আগে হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালালে ব্যক্তি ভস্নাদিমির পুতিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। পরবর্তী সময়ে তার বক্তব্য সমর্থন করেন ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতারা। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালালে ব্যক্তি পুতিনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেবে না লন্ডন। এর প্রতিক্রিয়ায় ক্রেমলিনের মুখপাত্র বৃহস্পতিবার আরও বলেন, রাশিয়ার সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে সম্পদ রাখার অনুমতি নেই। সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলো অন্যান্য দেশের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাদের সম্পদ জব্দ করে। কিন্তু রাশিয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো লাভ হবে না কারণ, বিদেশে কোনো রুশ কর্মকর্তার কোনো অর্থ-সম্পদ নেই। তবে যে কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে, অর্থাৎ ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালাবে কিনা সে সম্পর্কে দিমিত্রি পেসকভ কোনো মন্তব্য করেননি। উলেস্নখ্য, গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তে প্রায় এক লাখ সেনা মোতায়েন করে মস্কো। মাসের শেষ দিকে অবশ্য সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়া শুরু হয়, কিন্তু এখনো সেখানে ১০ হাজারের বেশি সেনা রয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য ও রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইউক্রেন কয়েক বছর আগে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করার পর থেকেই উত্তেজনা শুরু হয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে। সম্প্রতি ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্যপদ না দিলেও 'সহযোগী দেশ' হিসেবে মনোনীত করায় এই উত্তেজনা আরও বেড়েছে। ১৯৪৯ সালে গঠিত হওয়া 'নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অ্যালায়েন্স'কে (ন্যাটো) রাশিয়া বরাবরই পাশ্চাত্য শক্তিসমূহের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে মনে করে, এবং ঐতিহাসিকভাবেই বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়া পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদের বিরোধী। একসময়ের সোভিয়েত অঙ্গরাষ্ট্র ইউক্রেনের মোট জনসংখ্যার একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ রুশ বংশোদ্ভূত। দেশটিতে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীও বেশ সক্রিয়। এই গোষ্ঠীর সশস্ত্র সহায়তায় ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দ্বীপের দখল নেয় রাশিয়া। রাশিয়ার ভৌগোলিক নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগের আর একটি কারণ কৃষ্ণসাগর। এটি রাশিয়ার একমাত্র সামুদ্রিক জলপথ। এই সাগরের উপকূলবর্তী অপর দেশ ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্য হয়, সেক্ষেত্রে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ন্যাটোর তৎপরতা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে, যা কখনই রাশিয়ার কাম্য নয়।