মরেছে লাখো মানুষ, জেতেনি কেউ

ইরাক-ইরান যুদ্ধ

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ইরানের সেনাদের বসরার কাছে বিজয় উদযাপন
ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৮০ সালে। সেপ্টেম্বরের একদিনে সাদ্দাম হোসেন ইরানে সেনা পাঠালেন। তারপর সেই লড়াই বিংশ শতাব্দীর দীঘর্তম যুদ্ধগুলোর একটিতে রূপ নেয়। যুদ্ধের তৃতীয় সপ্তাহে বড় ধরনের সাফল্য পেয়ে যায় ইরাক। ইরানের গুরুত্বপূণর্ বন্দর খোররামশা দখল করে নেয়। প্রথম কয়েক সপ্তাহে ইরাকিরা কোনো প্রতিরোধের মুখেই পড়েনি। তারা ইরানের অনেক জায়গা দখল করে নেয়। ইরাকের সবাই তখন ভেবেছিল সাদ্দাম হোসেন যুদ্ধে জিতে গেছেন। সাদ্দাম হোসেন টিভিতে একদিন বললেন, ছয় দিনে তিনি যুদ্ধ শেষ করে দেবেন। কিন্তু তিনি ভুল ছিলেন। ইরাকি চিকিৎসক ও কবি আহমেদ আল-মুশতাত; যাকে যুদ্ধের শেষ দিকে বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয়েছিল। দক্ষিণে বসরা এবং পরে উত্তর আল-হাফজার রণাঙ্গনে পাঠানো হয়েছিল তাকে। ১৯৮০ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তার বয়স ছিল ১৮। আট বছর পর যখন ইরান-ইরাক যুদ্ধ যখন শেষ হয়েছিল, তিনি তখন ২৬ বছরের যুবক। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, একটা সময় যুদ্ধে না গিয়ে উপায় থাকবে না। ওই সময় শুধু আহমেদ নয়, প্রতিটি ইরাকির জীবন যুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত হতো। টিভি খুললেই যুদ্ধের খবর। হঠাৎ একদিন শুনলেন আপনার প্রতিবেশীর ছেলে রণাঙ্গনে মারা গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার অনেক বন্ধুকে হারিয়েছি। পরিবারের অনেক সদস্য হারিয়েছি। জঘন্য সময় ছিল সেটা। আমি লেখালেখি করতাম। কিন্তু যুদ্ধের বিরুদ্ধে কিছু লেখা সম্ভবই ছিল না। নিরাপত্তা গোয়েন্দারা সবর্ক্ষণ সবার ওপর কড়া নজর রাখতো।’ যুদ্ধ শুরুর সাত বছর পর আহমেদ চিঠি পেলেন তাকে সেনাবাহিনীর মেডিকেল ইউনিটে যোগ দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘এ রকম একটি চিঠি একদিন আসবে, সেটা ধরেই নিয়েছিলাম, কিন্তু আমি চাইনি তা আসুক। কারণ ওই সময় রণাঙ্গনে গিয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল ৯০ ভাগ। কিন্তু নিয়তি অস্বীকার করার কোনো উপায় ছিল না, কারণ আপনি ওই নিদের্শ অবজ্ঞা করতে পারতেন না। পালানোর উপায় ছিল না। পালালেই আপনাকে ধরা পড়তে হবে, আপনাকে না পেলেও আপনার পরিবারকে তারা রেহাই দেবে না। সোজা মেরে ফেলতো। আত্মরক্ষার, আত্মপক্ষ সমথের্নর কোনো সুযোগই ছিল না।’ ১৯৮৭ সাল নাগাদ যুদ্ধে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল। কোনো পক্ষই বলতে পারছিল না, তারাই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ তার মধ্যে মারা গেছে। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছিল। এত সেনা মারা গিয়েছিল যে, এক পযাের্য় দুটি দেশই জোর করে তরুণ যুবকদের ধরে সামান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। যুদ্ধের চেহারা রূপ নিয়েছিল অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো, কঁাটাতার, মাইন আর ট্রেঞ্চে ভরা রণাঙ্গন। সব সময় মাস্টাডর্ গ্যাস হামলার ভয়। ইরাকের তেল সমৃদ্ধ বসরার দখল নিয়ে লড়াইতে ১০ হাজার ইরাকির মৃত্যু হয়। অন্যদিকে, ১২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার মরুতে ৫০ হাজার ইরানির মৃতদেহ পঁচেছিল। ইরাকিদের শক্ত অবস্থানের ওপর ইরানি তরুণ স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধারা ঢেউয়ের মতো একের পর এক হামলা চালিয়েছিল। আয়াতুল্লাহ খোমেনির ডাকে শহীদ হওয়ার উন্মাদনা নিয়ে ইরাকি মেশিনগান উপেক্ষা করে মাইন ভতির্ এলাকা পেরিয়ে দলে দলে তারা ইরাকি অবস্থানের ওপর ঝঁাপিয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯৮৮ সাল নাগাদ দুই দেশই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শেষের দিকে যুদ্ধ ইরাকের উত্তরের সীমান্তে জোরদার হলো। একঝঁাক ব্যাটালিয়ানকে সেখানে পাঠানো হলো। যদিও ইরান তখন জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে রাজি হয়েছিল, তারপরও উত্তর সীমান্তে প্রচÐ যুদ্ধ চলছিল। তিন দিনে প্রায় দেড় হাজার সেনা নিহত হয়। রক্তে ভেজা আহত সেনারা যন্ত্রণায় চিৎকার করতো। ভয়ানক দৃশ্য সব। এখনো সেই বারুদ মেশানো ধেঁায়ার গন্ধ পাওয়া যায়। আট বছর ধরে চলা ওই যুদ্ধে ১০ লাখ ইরাকির মৃত্যু হয়েছিল। যদিও ওই যুদ্ধ নিয়ে বাইরের বিশ্বে তত বেশি কথা হয়নি, কিন্তু আহমেদের মতো অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে, যারা যুদ্ধ করেছে এবং বেঁচে গেছে, তারা কখনো ভোলেন না। ১৯৮৮ সালের ২০ আগস্ট ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হয়। অথচ ওই যুদ্ধে কোনো দেশই জেতেনি। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ