বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারে সামরিক জান্তার দুই বছর

যাযাদি ডেস্ক
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর একাংশ

মিয়ানমারবাসীর জন্য ২০২১ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি ছিল ভিন্ন রকম একটি দিন। দীর্ঘদিনের সেনাশাসনে থাকা দেশটিতে সর্বশেষ অভু্যত্থান ঘটে সেদিন।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে জান্তা। গ্রেপ্তার করা হয় নোবেলজয়ী অং সান সু চিসহ দেশটির অনেক রাজনৈতিক নেতাকে।

মিয়ানমারে সেনা অভু্যত্থানের দুই বছর পূর্তি ছিল বুধবার। দেশটিতে মাঝের সময়টা বেশ উত্তাল কেটেছে। অভু্যত্থানবিরোধী তুমুল বিক্ষোভ ও তা দমাতে জান্তার দমন-পীড়নে দেশটিতে বদলে গেছে অনেকের জীবন। বিক্ষোভকারীদের 'সন্ত্রাসী' হিসেবে চিহ্নিত করেছে জান্তা সরকার। মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ দমন ও জান্তার হামলায় হাজারও মানুষের প্রাণ গেছে।

জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, জান্তার দমন-পীড়নে মিয়ানমারে প্রায় ১২ লাখ মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭০ হাজার মানুষ দেশ ছেড়েছেন। এসব কারণে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। আনা হয়েছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ।

কিন্তু এত কিছুর পরও ভাগ্য ফেরেনি মিয়ানমারবাসীর। তাদের গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। বরং প্রায় প্রতিদিন তাদের কাটাতে হচ্ছে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়, প্রাণ নিয়ে সংশয়ে। দেশটিতে জান্তাবাহিনীর গত দুই বছরের শাসনামলে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা নিয়ে এই আয়োজন।

গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমেছিলেন আয়ে চান। কিন্তু তার সেই চাওয়া এখনো পূরণ হয়নি। বরং গত বছর জান্তার গুলিতে চিরতরে পা হারাতে হয়েছে তাকে।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার আগে ২১ বছরের আয়ে চান একটি নুডলস তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। পরে জান্তাবিরোধীরা যখন হাতে অস্ত্র তুলে নেন, তখন ওই দলে যোগ দেন তিনিও। পা হারানোর ঘটনার কথা বলতে গিয়ে আয়ে জানান, তিনি শুরুতে বুঝতে পারেনি, আসলেই হামলা হয়েছে কিনা। পরে একজন সহযোদ্ধা তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে জ্ঞান ফেরার পর তিনি দেখেন, তার পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়েছে।

প্রাণে বাঁচলেও পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে আয়েকে। এখন ঘুমিয়ে, রান্না করে তার দিন কাটে। তিনি বলেন, 'জীবনটা খুশিতে কাটানোর চেষ্টা করছি আমি। তবে আগে যেসব কাজ করতে পারতাম, সেগুলো এখন আর পারি না।'

যদিও জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিক্ষোভে অংশ নেওয়া নিয়ে তার কোনো আফসোস নেই। আয়ে বলেন, 'আমি দ্রম্নত সুস্থ হয়ে উঠলে আবারও যুদ্ধে অংশ নেব। এটা শেষ পর্যন্ত চলবে।'

মিয়ানমারে যখন সেনা অভু্যত্থান ঘটে, তখন জাপানের টোকিওতে দেশটির দূতাবাসের ফার্স্ট মিনিস্টার পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন অং শোয়ে মোয়ে। মাসখানেক পর মিয়ানমারের হাজারো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে সমর্থন দেন। এই তালিকায় ৫২ বছর বয়সি অং শোয়ের নাম ছিল।

করোনা মহামারির সময়টায় অং শোয়ের স্ত্রী-কন্যা মিয়ানমারে অবস্থান করছিলেন। পরে সীমান্ত পেরিয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেন তারা। অং শোয়ে রয়েছেন টোকিওতে। ২০১৯ সালের পর থেকে তিনি স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি।

জান্তার বিরোধিতা করায় অং শোয়েকে টোকিওতে মিয়ানমার দূতাবাসের অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় তার আয়ের উৎস। জাপানে বসবাস করা মিয়ানমারের অনেকে তার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।

জাপান সরকার অং শোয়ের কূটনৈতিক ভিসার মেয়াদ বাড়িয়েছে। তাই আপাতত তিনি সেখানেই থাকতে পারছেন। কিন্তু কাজ করার অনুমতি নেই। আগামী জুলাইয়ে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হবে। এরপর কী হবে, সেটা অং শোয়ে জানেন না। তিনি বলেন, 'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মানুষ মিয়ানমারের কথা ভুলে গেছে। তবে আমরা কখনোই হাল ছাড়ব না।'

একটি আন্তর্জাতিক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন মিয়ানমারের মডেল হান লে। ওই সময় তার দেশে সেনা অভু্যত্থান ঘটে। হানের বন্ধুদের অনেকেই জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দেন। হান ভাবেন, তিনি তার প্রতিযোগিতার মঞ্চে অভু্যত্থানের বিরোধিতা করবেন, করেনও।

হান বলেন, অনুষ্ঠানের আগের রাতে তিনি ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি। উত্তেজনা ও ভয় একসঙ্গে তাকে ঘিরে ধরেছিল। পরে মঞ্চে উঠে জান্তার হাতে নিহতের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন হান। সেই ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হয়।

এ ঘটনায় মিয়ানমারে হানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনে জান্তা সরকার। তাই দেশে ফেরা হয়ে ওঠেনি আর। ব্যাংকক বিমানবন্দরে হানকে আটক করা হয়। মিয়ানমারে ফেরত না পাঠাতে আবেদন করেন তিনি। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে হান এখন কানাডার মন্ট্রিলে এক মিয়ানমার বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিকের বাড়িতে থিতু হয়েছেন।

হান বলেন, 'আমি মিয়ানমারে জন্মেছি। আমার পরিবার-বন্ধুরা সেখানে থাকে। আমার ভবিষ্যৎ সবকিছু সেখানে। আমি পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের অভাব প্রতিদিনই অনুভব করি।'

মিয়ানমারের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন এক নারী। জান্তাবিরোধী আন্দোলন সিডিএমে যোগ দিয়ে বিক্ষোভ করায় তিনি চাকরি হারান। পরে দেশ ছাড়তে হয় তাকে। গত বছর থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত-সংলগ্ন থাইল্যান্ডের একটি শহরে বসবাস করছেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে