শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পশ্চিমা অস্ত্রের পরীক্ষাগার ইউক্রেন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
যাযাদি ডেস্ক
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

প্রায় এক বছর ধরে চলা যুদ্ধে একের পর এক পাল্টা আক্রমণে রুশ বাহিনীর দখল থেকে বড় এলাকা দৃশ্যত ফিরে পেয়েছে ইউক্রেন; আমেরিকান কামান আর রকেট দিয়ে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি। নিজস্ব আক্রমণ পদ্ধতিতে ভিনদেশি এসব কামান পরিচালনা যুদ্ধক্ষেত্রেই শিখেছে ইউক্রেন। স্থানীয়ভাবে তাদের তৈরি কিছু সফটওয়্যার সহজেই ট্যাবলেট কম্পিউটার ও স্মার্টফোনগুলোকে পরিণত করছে লক্ষ্যবস্তুতে নিশানা করার কার্যকর যন্ত্রে, যা ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সবশেষ খবর হলো- ইউক্রেনকে ১৪টি লেপার্ড ট্যাংক দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। অন্যদিকে, আমেরিকা জানিয়েছে, তারা ৩১টি আব্রামস ট্যাংক দেবে ইউক্রেনকে। এভাবেই এই যুদ্ধক্ষেত্র পশ্চিমা শক্তিগুলোর যুদ্ধাস্ত্র আর উদ্ভাবনী সমর কৌশলের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেন একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছে, যা স্যাটেলাইট ছবি আর গোয়েন্দা তথ্য পেলে সঠিক সময়ে হামলার একটি ছক তৈরি করে দিতে পারে, যা ব্যবহার করে যুদ্ধে থাকা বাহিনীগুলো খুব কাছাকাছি থেকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ শানাতে পারে। আর এটা যেহেতু অ্যাপ, খুব সহজেই এটা আপডেট কিংবা উন্নয়ন ঘটানো যায়। আবার একসঙ্গে অনেকে এটা ব্যবহার করতে পারেন। যে মার্কিন কর্মকর্তারা এই অ্যাপের বিষয়ে জানেন, তারা বলছেন- ইউক্রেনের কামানগুলো দিয়ে রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে হামলা করার ক্ষেত্রে সেগুলো দারুণ কার্যকারিতা দেখিয়েছে।

এ রকম কয়েক ডজন কৌশল বা সরঞ্জাম ইউক্রেন উদ্ভাবন করেছে, যেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যয়বহুল সমস্যার তুলনামূলক সস্তা সমাধানের পথ বাৎলে দিয়েছে তাদের। প্রায় এক বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইউক্রেন এসব অ্যাপ উদ্ভাবন আর উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে।

মাথার ওপর নিঃশব্দে উড়ে চলা ছোট্ট পস্নাস্টিকের ড্রোন গ্রেনেড বা বিস্ফোরক ফেলে চলেছে রুশ সেনাদের ওপর। সেনারা যাতে যুদ্ধক্ষেত্রেই ভারী যন্ত্রপাতি মেরামত করে ফেলতে পারে, সেজন্য থ্রিডি প্রিন্টারে খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করা হচ্ছে এখন।

ইউক্রেনের টেকনিশিয়ানরা সাধারণ পিকআপ ট্রাকগুলোকে ভ্রাম্যমাণ মিসাইল লঞ্চারে রূপান্তরিত করেছেন। মিগ-২৯ এর মতো পুরনো সোভিয়েত যুদ্ধবিমানগুলোর সঙ্গে অত্যাধুনিক মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে যুক্ত করা যায়, সেই কৌশল রপ্ত করে নিয়েছেন ইউক্রেনের ইঞ্জিনিয়াররা। ফলে যুদ্ধ শুরুর এক বছর পরও ইউক্রেনের বিমানবাহিনী তাদের আকাশে অক্ষত থেকে উড়তে পারছে। এমনকি সোভিয়েত রকেটের ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে ইউক্রেন 'নেপচুন' নামে জাহাজ বিধ্বংসী নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্রও তৈরি করেছে, যা প্রায় ২০০ মাইল দূর থেকে রুশ নৌবহরকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাতে সক্ষম।

কিয়েভের এ ধরনের উদ্ভাবন মার্কিন কর্মকর্তাদের মুগ্ধ করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রের প্রয়োজনে নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে এমন উদ্ভাবনে কিয়েভের সক্ষমতার প্রশংসা করেছেন তারা, যেসব উদ্ভাবন পশ্চিমা সমৃদ্ধ অস্ত্র সরঞ্জাম ব্যবহারের কৌশলগত ঘাটতিকে অনেকটা পূরণ করছে এতদিন।

অবশ্য ইউক্রেনের নিজস্ব উদ্ভাবিত এসব কৌশল বা সরঞ্জাম ঠিক কীভাবে কাজ করছে, সে বিষয়ে খুব স্পষ্ট ধারণা মার্কিন বা অন্যান্য পশ্চিমা কর্মকর্তাদের নেই, কারণ তারা যুদ্ধের ময়দানে থেকে সেগুলো যাচাই করতে পারছেন না। তবে ইউক্রেন যে সস্তা কিন্তু কার্যকর সমর কৌশলের একটি যথার্থ গবেষণাগার হয়ে উঠেছে, এ বিষয়ে তাদের সন্দেহ নেই। 'সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রোগ্রামের ডিরেক্টর সেথ জোন্স বলেন, 'তাদের (ইউক্রেন) এসব উদ্ভাবন অবিশ্বাস্য রকমের আকর্ষণীয়।'

বাস্তব যুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষা

আমেরিকা ও তাদের মিত্রদের অস্ত্র সত্যিকারের যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা ভালোভাবে কাজ করতে পারে, তা দেখার একটি সুযোগ তাদের করে দিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। আর আধুনিক যুগের লড়াইয়ে জয় পেতে উভয় পক্ষ কী ধরনের অস্ত্র, সরঞ্জাম বা কৌশল ব্যবহার করছে, তাও দেখে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ইউক্রেনের পাওয়ার গ্রিড (বিদু্যৎকেন্দ্র) ধ্বংস করতে রাশিয়া কীভাবে ইরানের তৈরি সস্তা ড্রোন দিয়ে সফলভাবে আক্রমণ চালিয়েছে, সেটাও এই যুদ্ধে দেখার সুযোগ হয়েছে মার্কিন অপারেশন অফিসার ও সামরিক কর্মকর্তাদের।

পশ্চিমা গোয়েন্দারা বলছেন, সবদিক বিবেচনা করে ইউক্রেন বাস্তব অর্থেই একটি অস্ত্রের গবেষণাগার হয়ে উঠেছে, কারণ এসব অস্ত্র ও সরঞ্জামের কোনোটিই এর আগে শিল্পোন্নত দু'টি দেশের মধ্যে যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়নি কখনো। তাদের ভাষায়, এটা 'বাস্তব যুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষা'। আর ইউক্রেনের যুদ্ধ মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য তাদের নিজস্ব যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জামের প্রয়োগিক সুবিধা-অসুবিধার তথ্য পাওয়ার দারুণ এক উৎস।

আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তা এবং এক ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থার মতে, ইউক্রেনকে দেওয়া সুইচবেস্নড ৩০০ ড্রোন এবং শত্রম্নর রাডার সিস্টেমে আক্রমণ চালাতে পারে, এমন ক্ষেপণাস্ত্রের মতো 'হাই-প্রোফাইল' মার্কিন সমর সরঞ্জাম যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যাশার তুলনায় কম কাজে দিয়েছে।

কিন্তু আমেরিকার তৈরি হালকা ওজনের এম-১৪২ মাল্টিপল রকেট লঞ্চার বা হিমারস মিসাইল আবার ইউক্রেনের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এমনকি এ ধরনের অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কতটা মেরামত প্রয়োজন হয়, আর রক্ষণাবেক্ষণ কতটা লাগে, সে বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।

আমেরিকার এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, সীমিত পরিমাণে সরবরাহ করা হিমারস মিসাইল দিয়ে ইউক্রেন যেভাবে রুশ সেনা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, কমান্ড পোস্ট, হেডকোয়ার্টার আর সামরিক ডিপোতে আক্রমণ চালিয়েছে, তা ছিল অপ্রত্যাশিত। যুদ্ধক্ষেত্রের এসব তথ্য রীতিমতো মার্কিন সমরবিদদের চোখ খুলে দিয়েছে, কারণ এসব জানতে তাদের বছরের পর বছর গবেষণা করতে হতো।

এই 'পরীক্ষাগার' থেকে নিজেদের আরও একটি যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পেয়েছে আমেরকা, সেটা হলো- তাদের এম-৭৭৭ হাউইৎজার। এসব হালকা কামান ইউক্রেনের সমর শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এই অস্ত্রের একটি খুঁত এই যুদ্ধক্ষেত্রেই স্পষ্ট হয়েছে। আর তা হলো, এই কামান দিয়ে অল্প সময়ে অনেক বেশি শেল নিক্ষেপ করা হলে এর নির্ভুল লক্ষ্যভেদের হার এবং কার্যকারিতা কমে যায়। আর ইউক্রেনীয়রা যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন নতুন যে কৌশলগত উদ্ভাবন ঘটিয়ে চলেছে, তা পশ্চিমা কর্মকর্তাদেরও অবাক করে দিচ্ছে।

যুদ্ধের শুরুর দিকে কিয়েভে রাশিয়ার হামলার সময় ইউক্রেনের কমান্ডাররা তাদের পদাতিক বাহিনীকে ছোট ছোট সেনার দলে বিভক্ত করে পাল্টা হামলা চালিয়েছিলে। কাঁধে স্টিংগার ও জ্যাভেলিন রকেট লঞ্চার নিয়ে ইউক্রেনীয় সেনারা তাদের দুই পাশে পদাতিক সেনাবাহিনীর সহায়তা ছাড়াই অতর্কিতে রাশিয়ার ট্যাংকগুলোর কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়েছে।

একুশ শতকের বিশ্বে আধুনিক দু'টি দেশের মধ্যে কীভাবে যুদ্ধ হয় এবং তা কী ফল বয়ে আনতে পারে, তা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আমেরিকাও। এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, এই যুদ্ধ এম-৭৭৭ হাউইৎজার সিস্টেমের মতো আর্টিলারি বহর সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে আমেরিকাকে সাহায্য করতে পারে। এম-৭৭৭ এর মতো যেসব কামানকে টেনে নিয়ে যেতে হয়, আধুনিক যুদ্ধে সেগুলো 'সেকেলে' বলে মনে হতে পারে, কারণ এই কামান দিয়ে আক্রমণের সময় পাল্টা গোলা এড়াতে তড়িঘড়ি এগুলো সরিয়ে নেওয়া কঠিন। ড্রোন আর আকাশে নজরদারির যুগে এ কামান লুকিয়ে রাখাও কঠিন।

আমেরিকান প্রতিনিধি পরিষদে কানেটিকাটের প্রতিনিধি এবং হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির সদস্য জিম হিমস বলেন, 'ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে কী শিখেছি, যদি সেটা বলতে হয়, তাহলে আস্ত একটা বই লিখে ফেলতে হবে।'

একমুখী হামলার ড্রোন

কেবল যুদ্ধাস্ত্রের সক্ষমতা-দুর্বলতা জানা নয়, ইউক্রেন যুদ্ধ মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের জন্যও নতুন ধারণা নেওয়ার এবং নতুন বাজার তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী ব্রিটিশ কোম্পানি বিএই সিস্টেমস এরই মধ্যে জানিয়েছে, রাশিয়ার কামিকাজি ড্রোনগুলোর সাফল্য থেকে ধারণা নিয়ে নতুন একটি সাঁজোয়া যানের নকশা করেছে তারা, যেখানে ওপর থেকে চালানো আক্রমণ থেকে সেনাদের রক্ষায় বাড়তি বর্ম যোগ করা হয়েছে।

এটা এমন এক যুদ্ধ, যেখানে মার্কিন সরকার এবং সমর শিল্পের অনেকে তাদের নতুন নতুন অস্ত্র ও সরঞ্জাম পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছে। আর মরিয়া ইউক্রেন চেয়েছে, যা যা পাওয়া সম্ভব, তার সবই আদায় করে নিতে।

যুদ্ধের প্রথমদিকে 'ন্যাশনাল জিওস্পেশাল-ইনটেলিজেন্স এজেন্সি' ইউরোপে 'ইউএস স্পেশাল অপারেশন কমান্ড'র কাছে পাঁচটি হালকা ওজনের নজরদারি ড্রোন পাঠিয়েছিল। যদি সেগুলো ইউক্রেনের কাজে আসে, সে ভাবনা থেকে পাঠানো হয়েছিল ড্রোনগুলো। 'হেক্সাগন' কোম্পানির তৈরি ওই ড্রোনগুলো মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের তথাকথিত ভবিষ্যৎ প্রতিরক্ষা কর্মসূচির অংশ ছিল না। এটা থেকে বোঝা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধকে আসলে পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহারের কৌশল আমেরিকার তখন থেকেই ছিল। ন্যাশনাল জিওস্পেশাল-ইনটেলিজেন্স এজেন্সির সাবেক প্রধান, মার্কিন নেভির ভাইস অ্যাডমিরাল রবার্ট শার্প সে সময় প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, আমেরিকা তাদের একটি ইউরোপীয় 'সামরিক অংশীদারকে' ওই ড্রোনের বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিয়েছে। গত বসন্তে ডেনভারে একটি স্যাটেলাইট কনফারেন্সের ফাঁকে শার্প বলেন, 'এটা (ওই নজরদারি ড্রোন) যে কাজে দেয়, সেটা হলো- মেঘের নিচে লুকিয়ে থেকে আপনার চারপাশের এলাকার ভূস্থানিক তথ্য সে সংগ্রহের সুযোগ করে দেয়।'

আমেরিকান কর্মকর্তাদের একটি অংশ বেশ ভালোভাবেই চেষ্টা করেছেন, যাতে ওই ড্রোন ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। একাধিক গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের অর্জিত জ্ঞান থেকে এখন একক ব্যবহারের সস্তা ড্রোনের মতো অস্ত্র তৈরির দিকে আরও বেশি মনোযোগী হয়ে উঠবে প্রতিরক্ষা ঠিকাদাররা। সংবাদসূত্র : সিএনএন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে