বিশেষ প্রতিবেদন

আত্মহত্যা পাপ নয় জাপানে

প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
শিক্ষাথীের্দর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রবল
অথৈর্নতিক দুশ্চিন্তা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, বীমা সংক্রান্ত জটিলতা, অবসাদ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের করালগ্রাস থেকে রেহাই পেতে জাপানের মানুষ হামেশাই দেশটির ঐতিহ্যগতভাবে স্বীকৃত ‘সম্মানজনক আত্মহত্যার’ পথ বেছে নিচ্ছে। দেশটিতে গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিশু আত্মহত্যা করেছে গত বছর। ২০১৬-১৭ অথর্ বছরের মাচর্ মাস পযর্ন্ত প্রাথমিক থেকে হাইস্কুলের ২৫০ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে। ১৯৮৬ সালের পর থেকে জাপানে এত বিপুলসংখ্যক শিশু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। আত্মহত্যার আগে ওইসব শিশু যেসব সমস্যার কথা জানিয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে পারিবারিক সমস্যা, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং বন্ধুদের কাছ থেকে অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্যপূণর্ ব্যবহার। ২০১৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ দেশগুলোর একটি ছিল জাপান। তবে এই প্রবণতা বন্ধ করতে দেশটির সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। ২০০৩ সালে জাপানে মোট আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ৩৪ হাজার ৫০০টি, যা ২০১৭ সালে ২১ হাজারে নেমে আসে। আথর্-সামাজিক এবং ঐতিহাসিক কারণে জাপানে মানুষের আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। টোকিও’র টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ওয়াতুরু নিশিদা বলেন, বিষণœতা এবং আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ বিচ্ছিন্নতা বা একা থাকার প্রবণতা। জাপানে একসময় বৃদ্ধ অভিভাবকদের দেখাশোনা করত তাদের সন্তানরা, তবে বতর্মানে সে রকমটা হয় না বললেই চলে। বৃদ্ধাশ্রম বা হাসপাতালে একাকী মৃত্যুবরণের ঘটনা দিন দিন বাড়ছেই। জাপানে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ‘সম্মানজনক আত্মহত্যা’র ঐতিহ্যকেও দায়ী মনে করেন অনেকে। জাপানের সামুরাই যোদ্ধাদের আত্মহত্যা, যাকে ‘সেপুক্কো’ বলা হতো। অথবা ১৯৪৫ সালে তরুণ ‘কামিকাজে’ বিমানচালকদের আত্মহত্যার ইতিহাস বতর্মান প্রজন্মের মানসিকতায় গুরুত্বপূণর্ প্রভাব রাখে। নিশিদা বলেন, জাপানে ধমীর্য় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, আত্মহত্যা করা পাপ নয়। কখনো কখনো বৃদ্ধ ব্যক্তিরা অথৈর্নতিক দুশ্চিন্তা এবং বীমা সংক্রান্ত জটিলতা থেকে রেহাই পেতে আত্মহত্যা করেন। জাপানে আত্মহত্যাসংক্রান্ত ঘটনায় বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বীমার অথর্ হস্তান্তর করে। যখন আর কোনো উপায় থাকে না, তখন অনেকেই মনে করেন, আত্মহত্যা করলে সহজেই পরিবারের টাকা-পয়সাসংক্রান্ত জটিলতা দূর হবে। জাপানে যে শুধু নিঃসঙ্গ বৃদ্ধরাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তা নয়, আত্মহত্যা করা মানুষের বয়স যাচাই করলে দেখা যায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আত্মহত্যাকারী ২০ থেকে ৪৪ বছর বয়সী পুরুষ। এসব আত্মহত্যার ঘটনা যাচাই করলে দেখা যায়, তারা জীবন নিয়ে হতাশ ছিলেন এবং কারো কাছে সাহায্য চাইতে অপারগ ছিলেন। ১৯৯৮ সালে এশিয়ার অথৈর্নতিক সংকটের পর এ ধরনের আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অথৈর্নতিক সংকটের পর আবারও এই হার বৃদ্ধি পায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাপানে ‘অনিশ্চিত চাকরি’র সংখ্যা বা তরুণদের স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে চাকরি দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। জাপানে এখনো অনেক বয়স্ক ব্যক্তি চাকরিক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং ব্যাপক সুবিধা পেলেও ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জাপানের তরুণদের প্রায় ৪০ শতাংশ স্থায়ী চাকরি পায় না। অথৈর্নতিক দুশ্চিন্তা ও অনিরাপত্তার পাশাপাশি অভিযোগ না করার মানসিকতার সংস্কৃতিও তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যা বাড়ার পেছনে বড় ভ‚মিকা রাখে। মনোবিজ্ঞানী নিশিদা বলেন, রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করার খুব একটা সুযোগ নেই জাপানের সমাজে। এটি একটি নিয়মতান্ত্রিক সমাজ। তরুণদের একটি নিদির্ষ্ট গÐির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হয়। তাদের সত্যিকার মনোভাব প্রকাশের কোনো সুযোগই থাকে না। দিন দিন প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং প্রসারের কারণে এই অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি তরুণদের সমাজ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করছে বলে মনে করেন তারা। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার এই প্রবণতার একটি বিশেষ নামও রয়েছে জাপানে; এটিকে বলা হয় ‘হিক্কিমোরি’। জাপানের স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভাষায়, হিক্কিমোরি হলো সেই সব ব্যক্তি; যারা ছয় মাসের বেশি সময় ধরে নিজেদের বাড়ির বাইরে বের হননি। এবং নিজেদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। জাপানের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে জাপানে ‘হিক্কোমোরি’ হিসেবে বসবাসরত ব্যক্তির সংখ্যা সাত লাখ ছাড়িয়েছে। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ