পাকিস্তানে গর্ভপাতই ভরসা!

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
অন্তঃসত্ত্বা, বেপরোয়া ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত এক নারীর নাম জামিনা। পাঁচ সন্তানের জননী এই নারীকে হয় ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত করাতে হবে, নয়তো তার হতদরিদ্র সংসারে আরও একটি নতুন মুখ যোগ হবে। অবশেষে তিনি গর্ভপাত করানোর সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া গর্ভপাত আইনত নিষিদ্ধ বিধায় জামিনাকে গোপনেই এই অস্ত্রোপচার করতে হবে। পাকিস্তানে প্রতি বছর তার মতো ২০ লাখের বেশি নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ হিসেবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই পদ্ধতি বেছে নেন। দেশটির কট্টর ধর্মীয় নেতারা জন্মনিয়ন্ত্রণের ঘোর বিরোধী। দেশটিতে জন্মবিরতিকরণ সামগ্রীরও সংকট রয়েছে। মার্কিন গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান 'গুতম্যাচার ইন্সটিটিউট' জানায়, পাকিস্তানে প্রতি বছর প্রায় অর্ধেক অন্তঃসত্ত্বা নারী অপরিকল্পিতভাবে গর্ভধারণ করেন। এই সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। এদের মধ্যে প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী গর্ভপাত করান। জামিনা বলেন, 'তিন বছর আগে আমার মেয়ে জন্ম নিলে চিকিৎসক জানান, আমার আর বাচ্চা নেয়া উচিত নয়। কারণ এটা আমার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।' তিনি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় নগরী পেশোয়ারের বাসিন্দা। ৩৫ বছর বয়সী এই নারী আরও বলেন, 'কিন্তু আমার স্বামীকে এ কথা বলা মাত্রই তিনি এ ব্যাপারে আলস্নাহর ওপর আস্থা রাখতে বলেন।' তিনি বলেন, 'আমার স্বামী একজন ধর্মভীরু। তিনি বেশ কয়েকটি ছেলে চান।' কয়েক দশক আগে 'দুটি সন্তানই ভালো' স্স্নোগানের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানে পরিবার পরিকল্পনা আন্দোলন শুরু হয়। তবে কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতারা এই আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান করেন। কট্টর জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় নেতারা প্রতিবেশী ও চিরবৈরী দেশ ভারতের চেয়ে বেশি জনসংখ্যা চান। ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৩৩ কোটি ৯০ লাখ। বর্তমানে পাকিস্তানের লোকসংখ্যা প্রায় ১৯ কোটি ৭০ লাখ। দেশটিতে সম্পদের তুলনায় শিশু জন্মহার বেড়ে যাচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে সংকটের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। জামিনা বলেন, তিনি তার স্বামীকে প্রায়ই পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ''আমার শাশুড়ির ৯ সন্তান। যখনই আমি আমার স্বামীকে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে আর সন্তান না নেয়ার কথা বলি, তখনই স্বামী বলেন, 'আমার মায়েরও অনেক সন্তান ছিল। তিনি যেহেতু মারা গেছে যাননি, তুমিও যাবে না।'' মায়ের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় পাকিস্তানে গর্ভপাতের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু অনেক চিকিৎসক মুসলমান ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী গর্ভপাত করাতে অস্বীকৃতি জানান। এর ফলে অনেক নারী অবৈধভাবে গর্ভপাত করান এবং তাদের অনেকে প্রাণ হারান। এনজিও 'অ্যাওয়ার গার্লস'র প্রতিষ্ঠাতা গুলালাই ইসমাইল বলেন, 'প্রসূতিজনিত কারণে যে কজন নারী মারা গেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি, তাদের অধিকাংশই গর্ভপাত করাতে গিয়ে।' জামিনা ভাগ্যবতীদের মধ্যে একজন। তিনি জানতেন নিরাপদ গর্ভপাতের জন্য কোথায় যেতে হবে। সংস্থাটির পরামর্শদাতা আয়েশা (২৪) বলেন, 'আমি নারীদের জীবন রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছি। তারা যখন ফোন করে যেকোনো উপায়ে গর্ভপাত করানোর জন্য আমার কাছে পরামর্শ চান।' আয়েশা জানান, তিনি মাসে আনুমানিক ৩৫০টি ফোনকল পান। এসব নারীর অধিকাংশই জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে খুব সামান্যই জানেন। পাকিস্তানে কন্ডোমের ব্যবহার খুবই সীমিত। দেশটির অধিকাংশ মানুষ জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি হিসেবে এটাকেই সবচেয়ে ভালো চেনে। এতেও একটি বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। অধিকাংশ পুরুষই এটা ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক। রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটির মাত্র ৩৫ শতাংশ নারী জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। দেশটিতে জন্মবিরতিকরণ পিলের দাম মাত্র ২০ রুপি। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানে একটি বিতর্কিত ইসু্য। আর দেশটিতে বড় পরিবারকে পুরস্কৃত করা হয়। পরিবার পরিকল্পনা এনজিও 'গ্রিনস্টার'র ডা. হারুন ইব্রাহিম বলেন, 'কর্তৃপক্ষ এই ইসু্যতে এখনো জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেনি।' অপর একটি এনজিও 'পপুলেশন কাউন্সিল'র কর্মকর্তা জেবু সাতার দেশটির জন্মনিয়ন্ত্রণের এই নেতিবাচক ব্যবহারকে 'পদ্ধতিগত ব্যর্থতা' হিসেবে অভিহিত করেছেন। গত ডিসেম্বরে সাবেক ক্রিকেটার ও প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের কথা স্বীকার করে গণমাধ্যম, স্কুল, মোবাইল ফোন ও মসজিদে পরিবার পরিকল্পনাবান্ধব আন্দোলন শুরু করার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু 'কাউন্সিল অব পাকিস্তানি ইসলামিক আইডিওলজি' নামের একটি ধর্মীয় সংগঠন সরকারকে জানিয়েছে, পরিবার পরিকল্পনা ইসলামবিরোধী। ফলে দেশটিতে গর্ভপাতের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি দিন দিন বাড়ছে। সংবাদসূত্র : এএফপি অনলাইন