ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাস

ভালোবাসা দিয়ে সবার মন জয় করলেন প্রধানমন্ত্রী আরডার্ন

'তার শরীরে কোনো বাজে কোষ নেই। তিনি দৃঢ়, গম্ভীর, ইতিবাচক এবং দায়িত্বশীল'

প্রকাশ | ২৩ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুইটি মসজিদে হামলা চালিয়ে নিরীহ মুসলিস্নদের ওপর জঘন্য হত্যাকান্ড সারা বিশ্বজুড়ে মানুষকে আলোড়িত করেছে। এই লোমহর্ষক হামলার কয়েক ঘণ্টা পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন যখন বিবৃতি প্রদানের জন্য হাজির হন, তখন সবার মনোযোগ ছিল সেদিকে। অতঃপর অতি দ্রম্নত এবং স্পষ্টভাবে এই বন্দুক হামলাকে তিনি 'সন্ত্রাসী হামলা' বলে বর্ণনা করে সবার মন জয় করে নেন। সংবাদসূত্র : বিবিসি নিউজ বহু মানুষ মনে করেন, শ্বেতাঙ্গ কোনো ব্যক্তির দ্বারা এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে (এমনকি সেটা যদি রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবেও হয়ে থাকে) কর্তৃপক্ষ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করতে অনীহা বা অনিচ্ছুক মনোভাবের পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা দ্রম্নত, স্পষ্টভাষায় এই 'সন্ত্রাসী হামলা' বলে বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে সে বিষয়ে তার সচেতনতা এবং বিবেচনার বিষয়টি উঠে আসে। হামলার পর প্রথমবারের মতো পার্লামেন্ট ভাষণের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন ইসলামি কায়দায় সবাইকে সম্ভাষণ জানান- 'আসসালামু আলাইকুম' বলে। তিনি এই সহানুভূতির সঙ্গে বাস্তবসম্মত আইনি ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রম্নতিরও মিশ্রণ ঘটান। হামলার ঘটনার কয়েক ঘণ্টার পরেই দেশের অস্ত্র আইনে ১০ দিনের মধ্যে কঠোর সংস্কার আনার বিষয়ে ঘোষণা দেন। এছাড়া নিউজিল্যান্ড এবং বিশ্ব থেকে বর্ণবাদ 'বিতাড়িত' করার বিষয়েও আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী আরডার্নের বক্তব্যের সূত্র ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যবেক্ষকরা তার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ব্রিটিশ পত্রিকা 'গার্ডিয়ান'-এ সুজানে মুর লিখেছেন, মার্টিন লুথার কিং বলেছেন সত্যিকারের নেতারা ঐক্য খোঁজে না তারাই ঐক্য তৈরি করে, আরডার্ন ভিন্ন ধরনের ঐক্য তৈরি, কর্ম, অভিভাবকত্ব ও একতার প্রদর্শন করেছেন। সন্ত্রাসবাদ মানুষের মাঝে ভিন্নতাকে দেখে এবং বিনাশ ঘটায়। আরডার্ন ভিন্নতা দেখেছেন এবং তাকে সম্মান করতে চাইছেন, তাকে আলিঙ্গন করছেন এবং তার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন। 'ওয়াশিংটন পোস্ট'র ঈশান থারুর লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী আরডার্ন তার জাতির শোক এবং দুঃখ এবং তা নিরসনের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছেন। 'এবিসি অস্ট্রেলিয়া'তে অ্যানাবেল ক্র্যাব লেখেন, একজন নেতার জন্য ভয়াবহ বাজে খবরের মুখোমুখি হওয়ার পর আরডার্ন এখন পর্যন্ত কোনো ভুল পদক্ষেপ নেননি। গ্রেস ব্যাক এক বাক্যে লিখেছেন : একজন নেতা এমনই হয়ে থাকেন। এই ধরনের প্রশংসা কেবল বিশ্লেষকদের কাছ থেকেই আসছে তেমনটি নয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আরডার্ন পাকিস্তানিদের 'হৃদয় জয়' করেছেন। মার্টিন লুথার কিংয়ের স্মৃতি সংরক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত মার্টিন কিং সেন্টার টুইটারে লিখেছে- নিউজিল্যান্ডে একজন নেতার ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ প্রদর্শনী। প্রধানমন্ত্রীর কথা আলোড়িত করেছে নিউজিল্যান্ডের শোকাহত পরিবারের মানুষদের। এমনকি বিরোধী ন্যাশনাল পার্টির জুডিথ কলিন্স প্রধানমন্ত্রী 'অসাধারণ' বলে পার্লামেন্টে উলেস্নখ করেছেন। নিউজিল্যান্ডে রাজনৈতিক বিশ্লেষক কলিন জেমস বলেন, 'আরডার্নের সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেসব প্রশংসা বাক্য পাচ্ছেন, তা বিস্ময়কর কিছু নয়। তিনি দৃঢ়, গম্ভীর, ইতিবাচক এবং দায়িত্বশীল এবং যেটা আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, তার শরীরে কোনো বাজে কোষ নেই, কিন্তু আবার তাকে সহজে প্রভাবিত করা যায় না, এটা একটি ব্যতিক্রমী সমন্বয়।' অস্ট্রেলিয়ার সিনেটর ফ্রেশার অ্যানিংস হামলার ঘটনার জন্য অভিবাসনকে দায়ী করে মন্তব্য করার পর তাকে সহজ ভাষায় 'নিন্দনীয়' বলে বর্ণনা করেন প্রধানমন্ত্রী আরডার্ন। হামলার পরদিন আরডার্নকে হতাহতদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়া যে ছবি দেখা গেছে, তাতে রাজনৈতিক সমসাময়িক নেতাদের আচরণের সঙ্গে বৈপরীত্য তুলে ধরে। আল-জাজিরার সাংবাদিক সানা সাইদ বলছেন, ২০১৭ সালে কুইবেক মসজিদে হত্যাকান্ডের ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এতটা গভীর মানবিকতা দেখিয়েছেন বলে মনে পড়ছে না। তিনি আরও উলেস্নখ করেন, ২০১২ সালে উইসকনসিনের ওয়াক ক্রিক গুরুদুয়ারায় বন্দুক হামলার ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘটনার শিকার লোকজনের মাঝে দেখা করতেও যাননি। ২০১৭ সালে জেসিন্ডা আরডার্ন যখন প্রথম তার নির্বাচনী প্রচার কাজ শুরু করেন তাকে নিয়মিতভাবে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর সঙ্গে তুলনা করা হতো। আরর্ডান যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন তখন তার বয়স ৩৭ বছর। এবং তাকে ঘিরে ব্যাপক উন্মাদনা তৈরি হয়, যার নামকরণ করা হয় 'জাসিন্ডাম্যানিয়া' এবং তিনি শেষ পর্যন্ত 'অসার পদার্থে পরিণত' হন কিনা, তা নিয়ে তখন অনেকেই এমনও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।