সংঘর্ষে ২৯ মাওবাদী নিহত
ভারতের ছত্তিশগড়ে ভয়ের পরিবেশ
'নকশাল' শব্দটা এসেছে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ির ছোট্ট গ্রামের সূত্র ধরে, যেখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা চারু মজুমদার এবং কানু সান্যাল ১৯৬৭ সালে সরকার ও সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছিলেন...
প্রকাশ | ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
ভারতের ছত্তিশগড়ের মাওবাদী অধু্যষিত এলাকা কাঁকেরের পার্শ্ববর্তী বস্তারে লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল ১৯ এপ্রিল। ভারতে সেই প্রথম দফা ভোটের ঠিক আগে ১৬ এপ্রিল কাঁকের জেলা সদর থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে আপাটোলা-কালপার জঙ্গলে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ২৯ জন মাওবাদী নিহত হয়। এই 'এনকাউন্টারকে' বড় সাফল্য হিসেবে দেখছে পুলিশ প্রশাসন। অন্যদিকে, ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মাওবাদীরা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, 'আমাদের কমরেডরা জঙ্গল এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের ঘিরে ফেলা হয় এবং মেরে ফেলা হয়।'
কাঁকেরের পুলিশ সুপার কল্যাণ আলেসেলা বলেন, '১৯ এপ্রিল বস্তার লোকসভা আসনে ভোট হওয়ার কথা ছিল। তার ঠিক আগে ১৫ এপ্রিল আমরা একটি বিশাল নকশাল স্কোয়াডের সমাবেশ সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাই। এই অঞ্চলটা বস্তার এবং কাঁকের দুইয়েরই কাছাকাছি। সেখানে অনেক বড় ক্যাডার ও কমান্ডার ছিল, ৬০ থেকে ৭০ জন মাওবাদী ছিল। আমরা এলাকাটি ঘিরে ফেলি এবং একটা সংঘর্ষ হয়।'
থমথমে পরিবেশ: নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনে মাওবাদীদের তরফে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'পুলিশের গুলিতে আমাদের ১২ জনের মৃতু্য হয়েছে এবং বাকি ১৭ জনকে আহত বা জীবিত আটক করে পুলিশ নির্মমভাবে হত্যা করেছে।' যদিও বস্তারের ডিভিশনাল আইজি সুন্দররাজ পি এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, 'মাওবাদীরা সহানুভূতি পাওয়ার জন্য এ ধরনের দাবি করছে। এটা তাদের প্রোপাগান্ডা।'
এ ঘটনায় নিহত মাওবাদী গেরিলার মধ্যে ছিলেন শঙ্কর রাও এবং তার স্ত্রী রীতা। তারা মাওবাদীদের বিভাগীয় কমিটি পদমর্যাদার সদস্য ছিলেন। শঙ্কর রাওকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ২৫ লাখ রুপি এবং তার স্ত্রী রীতাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।
ভোটের আবহে কাঁকের এবং তার আশপাশের এলাকায় থমথমে পরিবেশ রয়েছে। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর সজাগ চোখ আর রাস্তার থমথমে পরিবেশ ভয় পাওয়াতে পারে। এবং এই আশঙ্কার কারণও রয়েছে। গত ১৬ এপ্রিলের ঘটনায় মাওবাদীদের বড় নেতাদের মৃতু্য হয়েছে। এর প্রতিশোধ নিতে মাওবাদীরা হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে পুলিশ প্রশাসন।
'নকশাল' শব্দটা এসেছে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ির ছোট্ট গ্রামের সূত্র ধরে, যেখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা চারু মজুমদার এবং কানু সান্যাল ১৯৬৭ সালে সরকার ও সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ২০০৬ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মাওবাদী সহিংসতাকে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে বর্ণনা করার পর শুরু হয় 'অপারেশন গ্রিন হান্ট'। ২০০৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম লোকসভায় জানান, দেশে মাওবাদী প্রভাবিত জেলার সংখ্যা ২২৩। তবে তাদের প্রভাব মূলত দেশের ১০টি রাজ্যের প্রায় ৭৫টি জেলায় বলে মনে করা হয়।
কীসের আশঙ্কা? :ইউপিএ সরকারের আমলে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান শুরু হয়, যা এনডিএ সরকারের আমলেও গত ১০ বছর যাবৎ অব্যাহত রয়েছে। বস্তারের আইজিপি সুন্দররাজ বলেছেন, 'গত সাড়ে তিন মাসে বস্তার ডিভিশনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ৭৯ জন মাওবাদী নিহত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থও উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে মাওবাদীদেরও। এর ফলে তাদের ইকোসিস্টেমের ওপর প্রভাব পড়েছে।'
এর আগে ঘটা মাওবাদী হামলাগুলোর কথা ভেবে আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, তারা (মাওবাদীরা) শক্তি প্রদর্শনের জন্য আক্রমণ করতে পারে। উল্টোদিকে, নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানরা মাওবাদীদের অন্য একটি গোষ্ঠীকে নিশানা করতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এ কারণেই রাস্তার থমথমে পরিবেশ আতঙ্কের মতো কাজ করছে।
১৬ এপ্রিল যেখানে সংঘর্ষ ঘটেছিল বলে জানা গেছে, তার কাছেই ছোটে বেথিয়া গ্রাম। অপ্রীতিকর কিছুর ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় সেই গ্রামের কেউই ক্যামেরার সামনে কথা বলতে চান না। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনির পরও কীভাবে পরিবারের অন্ন সংস্থান করবে, সে চিন্তা তো রয়েছেই, এর ওপর দশকের পর দশক ধরে মাওবাদী আর নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যাওয়ার ফলে গ্রামবাসীর জীবনে দুর্ভোগ এবং দুর্দশা হয়ে উঠেছে স্থায়ী সঙ্গী। ছোটে বেথিয়া গ্রামের মানুষ আপাতত এটা ভেবেই স্বস্তিতে রয়েছেন যে, ১৬ তারিখের ঘটনায় কোনো গ্রামবাসীর মৃতু্য হয়নি। তবে এই স্বস্তি কতদিন থাকবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন তারা। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী বা রাজ্য সরকার কেউই তাদের শান্তি বা স্বস্তির নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। এ এলাকার সাধারণ আদিবাসীদের পরিবারগুলো যে কোনোদিন শেষ হয়ে যেতে পারে। আর এই বিপর্যয় আসতে পারে বিভিন্নভাবে।
হতেই পারে, একদিন ঘর থেকে বেরিয়েই 'ক্রসফায়ার'-এর শিকার হলেন গ্রামবাসী কেউ। আবার নিরাপত্তা বাহিনী বা মাওবাদী, যে কারওর গুলিতে তাদের মৃতু্য হতে পার। এমনও হতে পারে, পুলিশের 'ইনফর্মার' হওয়ার সন্দেহে কাউকে মাওবাদীদের নিশানা হতে হলো অথবা মাওবাদী সন্দেহে পুলিশের হাতে মৃতু্য হলো।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা যা বলেছেন :এ কারণেই ছত্তিশগড়ের মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেছেন যে, মাওবাদ দমনের এই লড়াইয়ে সাধারণ আদিবাসীদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই লড়াই সাধারণ আদিবাসীকে কতটা প্রভাবিত করছে? ছত্তিশগড়ের সবচেয়ে মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা আবুঝমাড় এলাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত পেওয়ারি গ্রাম। কাঁকের জেলা সদর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে দুর্গম জঙ্গলের মাঝখানে অবস্থিত এই গ্রামে সুরজবতী হিডকোর একটি বাড়িও রয়েছে। সেই বাড়িতে পৌঁছে শুধু স্তব্ধতা আর বিষণ্ন মুখই চোখে পড়ল। সুরজবতী হিডকো হলেন অনিল হিডকোর বৃদ্ধা মা। আঙিনার একটা কোণায় বসে চোখের জল মুছছিলেন তিনি। মাত্র দুই মাস আগেও তার এক রোজগেরে ছেলে, বউমা আর নাতি-নাতনিও ছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের ২৪ ফেব্রম্নয়ারি তাদের জীবনের সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।
সুরজবতী হিডকো জানিয়েছেন, তার ২৮ বছরের ছেলে অনিল প্রতিদিনের মতোই ১৫ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে তেন্দু পাতা (পূর্ব ভারতীয় আবলুস গাছের পাতা) বাঁধার জন্য দড়ির ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন। মা সুরজবতী বলেন, 'পরের দিন ২৫ ফেব্রম্নয়ারি সন্ধ্যায় গ্রামের লোকেরা জানায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আমার ছেলে মারা গেছে। মারদা গ্রামের কাছে একটা পাহাড়ে এই সংঘর্ষ হয়েছিল। কী হয়েছে কেউ বলেনি। রাত ১১টায় আমার ছেলের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। ওর দেহ অনেক দেরিতে পেয়েছি আমরা। দুর্গন্ধের কারণে ওর মরদেহ ঘরে রাখতে পারিনি। এমনকি পরিবারের লোকজনও ওর মুখ দেখতে পারেনি।'
সন্তানকে কোলে নিয়ে অনিলের স্ত্রী সুরজা হিডকোও অঝোরে কাঁদছিলেন। অনেকক্ষণ পর তিনি কথা বলতে শুরু করেন। বৃদ্ধ শাশুড়ি ও শ্বশুর এবং ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে বাকি জীবনটা কীভাবে কাটাবেন সে বিষয়ে নিজের দুশ্চিন্তার কথা বলতে থাকেন তিনি। সুরজা হিডকো বলেন, 'আমার ছোট ছোট বাচ্চা আছে। তাদের লালন-পালন করার কেউ নেই। শ্বশুর বা শাশুড়ির চাকরি করার বয়স নেই। বাড়িতে আমার স্বামীই একমাত্র উপার্জন করার মতো ছিলেন। এখন বলুন আমি কী করব! দড়ির ব্যবস্থা করতে জঙ্গলে গিয়েছিলেন আর ওকে (অনিলকে) মেরে ফেলল।'
ভুয়া সংঘর্ষের অভিযোগ :গত ২৫ ফেব্রম্নয়ারি যে সংঘর্ষে অনিল হিডকোর মৃতু্য হয়েছে বলে নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করেছে, সেই ঘটনাস্থল পেওয়ারি গ্রাম থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মারদা গ্রামের কাছে অবস্থিত একটা পাহাড়ি এলাকা। ওই সংঘর্ষে তিনজন মাওবাদী গেরিলা নিহত হয়েছিল বলেও দাবি করা হয়েছে। তবে পেওয়ারি গ্রামের প্রধান মঙ্গলু রামের দাবি, অনিল কিন্তু তার গ্রামে ট্রাক্টর চালানোর কাজ করতেন।
বস্তার ডিভিশনের ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পি সুন্দররাজ স্বীকার করেছেন, মাওবাদীদের দমন করতে চালানো অভিযানের সময় সাধারণ মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তার দাবি, এ জাতীয় পরিস্থিতিতে স্বাধীন তদন্ত হয় এবং নিহতদের পরিবারকেও 'ক্ষতিপূরণ'ও দেওয়া হয়ে থাকে। ২৫ ফেব্রম্নয়ারি সংঘর্ষে মৃতু্যর বিষয়ে তিনি বলেন, 'পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত চলছে।'
বন্দুক দিয়ে সমাধান মিলবে না :নিরাপত্তা বাহিনী ও মাওবাদীদের মধ্যে আটকে থাকা স্থানীয় আদিবাসী তাদের ভবিষ্যতের বিষয়ের কোনো আশার আলো দেখতে পান না। ছত্তিশগড়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর মাওবাদীদের বিরুদ্ধে প্রচার জোরদার হলেও ১৬ এপ্রিলের সংঘর্ষের পর রাজ্য সরকার এখন মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী বিজয় শর্মা সাংবাদিকদের বলেন, 'হিংসা দিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না। তাই সরকার মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত।' তার কথায়, 'বন্দুকের নলের মুখে উন্নয়নও হতে পারে না, তাই আলোচনার পথ অবলম্বন করাই ভালো।' গত তিন দশক ধরে যদিও বস্তার অঞ্চলে মাওবাদী এবং পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে, আলোচনা আর হয়নি। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ