আশার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে 'অলৌকিকতার গির্জা'

প্রকাশ | ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
সেইন্ট অ্যান্থনি গির্জা বা চার্চ অব মিরাকলস
বছরের পর বছর ধরে শ্রীলংকার যে গির্জা হয়ে উঠেছিল সব ধর্মমতের মানুষের মিলনকেন্দ্র, ইস্টারে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর সেইন্ট অ্যান্থনির সেই 'চার্চ অব মিরাকলস'র দরজাগুলো বন্ধ হয়ে আছে। গির্জাটির ১৭৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম মানুষজনকে প্রবেশদ্বারগুলো থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। গত রোববার সকালের ওই বিস্ফোরণ 'অলৌকিকতার গির্জাটিকে' কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ করে দিলেও ঠিকই এটি আশার প্রতীক হয়েই ফিরে আসবে বলে প্রত্যাশা লংকানদের। সংবাদসূত্র : বিবিসি কচ্চিকাডের যে রাস্তাটি ধরে সেইন্ট অ্যান্থনির নামে হওয়া এই গির্জায় যাওয়া যায়, তা কলম্বোর প্রায় সবার কাছেই পরিচিত। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ এই রাস্তা ধরেই ঈশ্বরের কৃপা লাভের আশায় পৌঁছে যেতেন 'চার্চ অব মিরাকলসে'। পুরোপুরি একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ হওয়া সত্ত্বেও এর যাজকরা অন্য ধর্মে বিশ্বাসী অনেকের কাছেও 'অলৌকিকতার কারিগর' হিসেবে খ্যাত। অনুগামীরা বলেন- এমন কোনো প্রার্থনা নেই, হোক সে অনেক বিশাল, ক্ষুদ্র কিংবা অদ্ভুত, সেইন্ট অ্যান্থনি কাউকে ফেরায় না। যদিও সোমবার এই গির্জার চিত্র ছিল একেবারেই অচেনা। আগের দিনের বোমার বিস্ফোরণে সংকুচিত হয়ে পড়া গির্জার প্রবেশপথ আর সেইন্ট অ্যান্থনির বিশাল মূর্তির নিচে-চারপাশ পুণ্যার্থীর বদলে দখলে চলে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। প্রবেশপথে ছড়ানো ছিটানো ধ্বংসস্তূপ আর ভাঙা কাচের মধ্যেও চোখ চলে যাবে গির্জাটির বামপাশের টাওয়ারে স্থির হয়ে পড়া ঘড়ির দিকে; সেখানে তখনো বাজছে সকাল ৮টা ৪৫। রোববার এ সময়েই কলম্বো এবং আশপাশের এলাকায় গির্জা-হোটেলসহ ছয়টি স্থানে আলাদা আলাদা বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। পরে ঘটে আরও দুটি বোমার বিস্ফোরণ। এক দশক আগে বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগাররা উৎখাত হওয়ার পর এমন ভয়াবহ হামলা আর দেখেনি শ্রীলংকা। এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৩২১; আহতদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সোমবার মধ্যরাত থেকে জরুরি অবস্থাও জারি হয়েছে দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে। স্থানীয়রা বলছেন, সাধারণ দিনগুলোতেই সেইন্ট অ্যান্থনির গির্জা থাকে লোকে লোকারণ্য, আর রোববার ছিল ইস্টার সানডে। এদিনের প্রার্থনা সভায় হাজারের বেশি মানুষ উপস্থিত ছিলেন বলে ধারণা প্রধান যাজকের। বিস্ফোরণে অসংখ্য হতাহতের কথা বলা হলেও কেবল এ 'অলৌকিকতার গির্জা'তেই কতজনের প্রাণ গেছে তার চূড়ান্ত হিসাব মেলেনি। পুলিশ সদস্যরা 'নিরাপত্তা ঘেরাটোপের' ভেতর কাউকে ঢুকতে না দিলেও সোমবার সকালেও গির্জার কয়েকশ' গজ দূরে অনেককেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদের কেউ কেউ শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলেন ক্ষতবিক্ষত সাদা ভবনটির দিকে। সোমবার 'চার্চ অব মিরাকলসের' বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাবাথ বুদ্ধিকা বলেন, 'আমার বাড়ি এখানেই। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে দৌড়ে চলে আসি। যে ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আশপাশের মানুষ সে সময় ভয়ডরহীন ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।' বৌদ্ধ ধর্মের এ অনুসারী এর আগেও বহুবার পরিবার পরিজন নিয়ে গির্জাটিতে এসেছেন, অন্য অনেকের মতো তিনিও নিজেকে 'সেইন্ট অ্যান্থনির শক্তিতে' বিশ্বাসী হিসেবেই দাবি করেন। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরেই গির্জার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলেন নার্স আনুজা সুবাসিংহে। রোববার সকালে হাসপাতালে রিপোর্ট করার দায়িত্ব ছিল তার, যে কারণে বিস্ফোরণের সময় ছিলেন না এখানে। তার ভাষায়, অসহনীয় দুঃখ বহন করছেন যারা, এ গির্জা ছিল তাদের জন্য। গির্জাটি তাদেরকে প্রবোধ দিত। কারা এ রকম কিছু করতে পারে? কেন তারা এ রকম করলো? যাজকদের লিখিত ইতিহাস মতে, গির্জাটির সূচনাও হয়েছিল অলৌকিকতার হাত ধরেই। শ্রীলংকায় আঠারো শতকের ডাচ শাসনামলে কলম্বোতে বসবাস করা অ্যান্টোনিও নামে গোপনে খ্রিস্টধর্মের চর্চা করা এক ব্যক্তিই আজকের এ 'চার্চ অব মিরাকলস' প্রতিষ্ঠা করেন। অ্যান্টোনিওর পৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ ভারতের কোচিনে। কথিত আছে, একদিন সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে দেখে ভিত স্থানীয়রা অ্যান্টোনিওর দ্বারস্থ হয় এবং তাকে প্রার্থনার মাধ্যমে ওই পানি কমিয়ে দিতে অনুরোধ করে। অ্যান্টোনিওর প্রার্থনা কেবল সমুদ্রের উত্থিত পানিকে নামিয়েই আনেনি, পানির স্তর এতটাই কমিয়ে দেয় যে, নিচে থাকা বালুও উঁকি দিয়েছিল। সেখানেই পরে একটি ক্রুশ বসিয়ে কাদামাটির গির্জা বানান ফাদার অ্যান্টোনিও, যা এখন 'অলৌকিকতার গির্জা' হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।