রাশিয়ার ধীর গতি

ইউক্রেন যুদ্ধ আর কতদিন

পশ্চিম সক্রিয় হওয়ার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল হয়েছে এবং ওয়াশিংটন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়েছে এবং এগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। যা কিয়েভের টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট হলেও এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিতভাবে যুদ্ধ জয় করে ফেলবে, সেটা বলা যাবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এবারের ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ। এই যুদ্ধ প্রয়োজন বা পূর্বাভাসের চেয়েও অনেক বেশি সময় ধরে চলছে...

প্রকাশ | ১৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
রুশ সেনাদের লক্ষ্য করে কামান দাগছে ইউক্রেনীয় বাহিনী
গত মে মাসের মাঝামাঝি রাশিয়া উত্তর-পূর্বদিক থেকে ইউক্রেনে আক্রমণ করে। খারকিভ অঞ্চলে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে তারা কিছু অঞ্চল নিজেদের দখলে নেয়। এ অঞ্চলগুলো তারা শুরুর দিকে আক্রমণ চালানোর সময়ও একবার দখল করেছিল, কিন্তু পরে তারা ওই অঞ্চল ছেড়ে যায়। কিছু বিশ্লেষক এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, 'যখন বিশ্ব ঘুমচ্ছিল' তখন এ ধরনের হামলা চালানো ন্যক্কারজনক ঘটনা। ওই আক্রমণের সময় রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্ত থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভোভচানস্ক শহরের চারপাশে প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়। এরপর যা ঘটতে পারে তার পূর্বাভাস ইউক্রেনের জন্য ভয়ঙ্কর। রাশিয়া হয়তো আরও সামনের দিকে এগোতে পারে এবং সম্ভবত ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভও দখল করতে পারে, যেখানে যুদ্ধের আগে ১৪ লাখ মানুষের বসবাস ছিল। ইউক্রেনের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় এক মাস দেরি হওয়ায় পশ্চিমা সামরিক সহায়তা আসতে বেশ সময় নেয়। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, রাশিয়া তার অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং তারা যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে একটি সফল গ্রীষ্মকালীন আক্রমণ চালাতে পারে। যুক্তরাজ্যের 'রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউট'র সামরিক বিশ্লেষক জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, আক্রমণের লক্ষ্য শুধু উত্তর-পূর্বদিক নয়। বরং ইউক্রেনের পূর্বে অবস্থিত দোনবাস অঞ্চলে রাশিয়ান দখল আরও বিস্তৃত করা। যার কিছু অংশ রাশিয়ার অধীন ছিল। ২০১৪ সাল থেকে সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে ওই অঞ্চলটি রাশিয়ার দখলে যায়। সর্বশেষ রুশ অভিযান সফল হয়েছে? প্রায় দুই মাস হলো, রাশিয়ান বাহিনী ফ্রন্টলাইনের কিছু অংশে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারা ভোভচানস্ক এবং চসিভ ইয়ার নামে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহর পুরোপুরি দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। দুটি শহরই গত ছয় সপ্তাহে কয়েক দফা মারাত্মক লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এই দুটি শহর দখল করতে পারলে রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসবে। এতে ইউক্রেনের সামরিক সরবরাহ আসার পথ বন্ধ হয়ে যাবে এবং রাশিয়াও পরে আরও বিস্তৃত এলাকা নিজেদের দখলে নিতে পারবে। এখন পর্যন্ত এই অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে প্রধান দুটি কারণ হলো, এক- প্রতিপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করতে রাশিয়ার বড় ধরনের আক্রমণ চালানো জরুরি হলেও, এজন্য তারা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পর্যাপ্ত রিজার্ভ বা সেনাবাহিনীকে আনতে পারছে না। এটি আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়ার এক ধরনের অক্ষমতা। অন্যদিকে, পশ্চিমের দেশগুলো থেকে ইউক্রেনে নতুন সামরিক সরবরাহ আসতে শুরু করেছে, যা তাদের প্রতিরক্ষায় সাহায্য করবে। ইউক্রেনের 'ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ'র রিসার্চ ফেলো মাইকোলা বিয়েলেসকভ বলেন, মার্কিন কংগ্রেস এপ্রিলে ইউক্রেনের জন্য ছয় হাজার ১০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ পাস করার পরই রাশিয়া আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। সুযোগের জানালা বন্ধ হতে শুরু করেছে। এই নতুন সামরিক সহায়তা প্যাকেজের ফলে ভূমিতে রাশিয়ার শক্তি হ্রাস পাবে। এ কারণেই অনেক স্থান থেকে ইউক্রেনকে সরে যেতে হলেও সেই ব্যবধান এখন কমে আসছে। মে মাসের শেষের দিকে, খারকিভ অঞ্চলে রাশিয়ার আক্রমণের গতি কমে যায়। একজন রুশ সামরিক বস্নগার আলেকজান্ডার কোটস লিখেছেন, 'ইউক্রেন ভোভচানস্কের দিকে তাদের সামরিক বাহিনী পাঠিয়েছে এবং আমরা (রুশ বাহিনী) শিগগিরই বড় পরিসরে এগিয়ে যাব, এমনটা আমাদের আশা করা উচিত নয়। আমাদের অবস্থান আগে শক্তিশালী করতে হবে এবং পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।' কিন্তু রাশিয়ার আক্রমণের গতি ধীর হয়ে গেলেও এবং ইউক্রেনীয় বাহিনী আবার সংগঠিত হয়ে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও তার অর্থ এই নয় যে, রাশিয়া হেরে যাচ্ছে। এই যুদ্ধে বিভিন্ন ঘটনাকে প্রভাবিত করছে মূলত দুটি বিষয়। এক. গস্নাইড বোমা এর মধ্যে একটি কারণ হলো গস্নাইড বোমা, যা এই যুদ্ধে রাশিয়ার সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় রাশিয়ার বিমান চলাচল দিনে ১০০টিতে নেমে এসেছে। গস্নাইড বোমা হলো- ফ্রি-ফল বোমা বা উন্মুক্তভাবে নিচে পড়া বোমা, এসব বোমার অনেকগুলো সোভিয়েত আমলের, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার। এগুলোকে উইংলেট এবং জিপিএস ন্যাভিগেশন দিয়ে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে, যেন বোমাগুলো তাদের লক্ষ্যে বিস্ফোরিত হতে পারে। রাশিয়ার বিমানগুলো ইউক্রেনের আকাশসীমায় উড়ে যাওয়ার সময় গস্নাইড বোমা নিক্ষেপ করছে। তুলনামূলকভাবে ছোট আকারের এবং সামান্য তাপ নির্গত করা এই গস্নাইড বোমাগুলোকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আটকানো প্রায় অসম্ভব। যেখানে কিনা ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনগুলোকে প্রায়ই গুলি করে আকাশেই ধ্বংস করা যায়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন সংবাদপত্রকে দেওয়া তার সর্বশেষ এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টি তুলে ধরেন। রাশিয়ান বিমান থেকে গস্নাইড বোমা ফেলতে বাধা দিতে, ইউক্রেন রাশিয়ার ভূখন্ডে রাশিয়ার সামরিক বিমানকে লক্ষ্য করে আঘাত হানতে বিদেশি সরঞ্জাম ব্যবহার করার জন্য পশ্চিমের অনুমতি চেয়েছে। বিশ্লেষক মাইকোলা বিয়েলেসকভের মতে, রাশিয়ান সামরিক বিমান ঘাঁটিতে আঘাত করাই গস্নাইড বোমা এড়িয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায়। দুই. রাশিয়ার বিরুদ্ধে হামলা ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনের বিপর্যয় এবং সেই সঙ্গে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে ক্রমাগত রাশিয়ান হামলা, আমেরিকাকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দান করা অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে তার মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। প্রথমে, কিয়েভ খারকিভ অঞ্চলের কাছে রাশিয়ার ভূখন্ডে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে মার্কিন সরবরাহকৃত অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছিল। জুনের শেষের দিকে, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সালিভান বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে হওয়া চুক্তির কারণে বিষয়টি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, রুশবাহিনী রাশিয়া থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ইউক্রেনে ঢুকে পড়ছে এবং ইউক্রেনের আরও অঞ্চল দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই অনুমোদন এত সহজে দেওয়া হয়নি, কারণ আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর অনেকেই মস্কোর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো এড়িয়ে যেতে যায়। ক্রেমলিন জানিয়েছে, আমেরিকা তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্র ইউক্রেনকে দিয়ে রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে এই সংঘাতে ওয়াশিংটনের 'গভীর সম্পৃক্ততার' বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। যুদ্ধ আর কতদিন চলবে? রাশিয়ার আক্রমণ এখন পর্যন্ত বড় কোনো অগ্রগতি আনতে পারেনি, এমন অবস্থায় পরিস্থিতি ভারসাম্যহীন হয়ে আছে। একজন সিনিয়র ইউক্রেনীয় জেনারেল বলেছেন, কিছু কিছু জায়গায় রাশিয়ার অবস্থান ভালো, আবার খারাপ। সেই সঙ্গে, রাশিয়া ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। সামরিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে রাশিয়ার চলমান অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে, যা সাম্প্রতিক হামলার ঘটনারই প্রতিফলন। ২০২২ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে পুরোদমে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক কিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগোয়নি। তবে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমের সমর্থনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মস্কোর সংকল্প আগের মতোই শক্তিশালী রয়েছে। ইউক্রেনের জন্য মার্কিন কংগ্রেসে একটি নতুন সামরিক সহায়তা প্যাকেজ গৃহীত হওয়ার পর রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ লিখেছেন, 'আমরা অবশ্যই জিতব, ৬১ বিলিয়ন রক্তাক্ত মার্কিন ডলার বিনিয়োগ সত্ত্বেও জিতব। শক্তি এবং সত্য আমাদের পক্ষে।' ইউক্রেনের যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী হতে পারে, সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে, যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র 'টেলিগ্রাফ'র সম্পাদক এবং তার 'ইউক্রেন : দ্য লেটেস্ট' পডকাস্টের উপস্থাপক ফ্রান্সিস ডিয়ারনলি বলেছেন, 'পশ্চিম সক্রিয় হওয়ার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল হয়েছে এবং ওয়াশিংটন গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়েছে এবং এগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। যা কিয়েভের টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট হলেও এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিতভাবে যুদ্ধ জয় করে ফেলবে, সেটা বলা যাবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এবারের ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ। এই যুদ্ধ প্রয়োজন বা পূর্বাভাসের চেয়েও অনেক বেশি সময় ধরে চলছে।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ