সিরিয়ায় বাশারের পতন

যেভাবে লাভবান হয়েছে ইসরায়েল

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও জো বাইডেন দুইজনই বাশার আল-আসাদের পতনের জন্য কৃতিত্ব দাবি করছেন। তারা ভূমিকা রেখেছেন ঠিকই, তবে তা যতটা না পরিকল্পনা অনুযায়ী, তার চেয়ে বেশি ঘটনাচক্রে হয়েছে। তবে এর বিনিময়ে তাদের প্রাপ্তির খাতায় যোগ হতে পারে, ইরানের সামরিক যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলার মতো অর্জন... বিদ্রোহীরা বাশারকে উৎখাতের পর গত সোমবারই গোলানের বাফার জোন, অর্থাৎ যেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা ছিল, সেখানে নিজের সেনাদের প্রবেশের ছবি প্রকাশ করে ইসরায়েল। গোলানে ইসরায়েলে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিকেও দেশটির সুবিধার তালিকায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এর ফলে আরব দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে...

প্রকাশ | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
গোলান মালভূমিতে অবস্থান দৃঢ় করেছে ইসরায়েল
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর থেকে ওই অঞ্চলে জোর সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে গোলান বাফার জোন 'সাময়িকভাবে' নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পাশাপাশি সিরিয়াজুড়ে বিমান হামলাও চালিয়েছে তারা। সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা 'রয়টার্স' জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একটি দল দামেস্কের ২৫ কিলোমিটার কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তবে, দামেস্ক অভিমুখে এগোনোর এই খবর নাকচ করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচু্যত হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একে 'মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ঐতিহাসিক দিন' বলে মন্তব্য করেছিলেন। অবশ্য তার বক্তব্যে সতর্কতার সুরও শোনা গেছে। তিনি বলেন, 'যারা ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিতে বাস করতে চায়, সেই সিরিয়ানদের প্রতি শান্তির হাত বাড়িয়ে দেবে তার দেশ। নেতানিয়াহু বলেন, সিরিয়ার নতুন শক্তির সঙ্গে প্রতিবেশীসুলভ ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনই আমাদের ইচ্ছে। কিন্তু এটি না হলে ইসরায়েলের নিজেকে রক্ষার স্বার্থে যা করার তাই করব।' আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকের শাসনের অবসান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির জন্য কী বয়ে আনবে, তা নিয়ে এখন বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। বিবিসি'র আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন জানাচ্ছেন, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও জো বাইডেন দুইজনই বাশার আল-আসাদের পতনের জন্য কৃতিত্ব দাবি করছেন। তারা ভূমিকা রেখেছেন ঠিকই, তবে তা যতটা না পরিকল্পনা অনুযায়ী, তার চেয়ে বেশি ঘটনাচক্রে হয়েছে। তবে এর বিনিময়ে তাদের প্রাপ্তির খাতায় যোগ হতে পারে, ইরানের সামরিক যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলার মতো অর্জন। তবে প্রশ্ন উঠেছে, সর্বশেষ পটপরিবর্তনের পর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল কি আগের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে? বিদ্রোহীদের জয় ইসরায়েলের 'হামলার ফল'? বাশার আল-আসাদ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শক্তির জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হতো ইরান এবং হিজবুলস্নাহকে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস ইসরায়েলে হামলা করলে গাজা যুদ্ধের সূচনা হয়, যা লেবাননেও ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রভাব পড়ে বাশারের সহযোগী হিজবুলস্নাহর ওপর। হিজবুলস্নাহ নেতা হাসান নাসরালস্নাহ নিহত হন। বছরব্যাপী লড়াইয়ের পর গত ২৭ নভেম্বর হিজবুলস্নাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। সেদিনই বিস্ময়করভাবে হামলা করে দ্রম্নত আলেপ্পো দখল করে নেয় হায়াত তাহরির আল-শাম বা এইচটিএস-এর নেতৃত্বে সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠী। এর ১২ দিনের মাথায় ক্ষমতা ও দেশ ছাড়তে হয় সিরিয়ার শাসককে। ইরান ও হিজবুলস্নাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের জোরদার হামলার 'প্রত্যক্ষ ফল' হিসেবে বাশার সরকারের পতন ঘটেছে বলে দাবি করেছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, 'যারা এই শোষণ ও অত্যাচার থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছেন, তাদের জন্য এটা একটা চেইন রি-অ্যাকশনের মতো কাজ করেছে।' বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েনের মতে, আমেরিকার অস্ত্র ও নিরবচ্ছিন্ন সমর্থনের মাধ্যমে হিজবুলস্নাহ ও ইরানকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল ইসরায়েল। অন্যদিকে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখে আমেরিকা। ফলে, বাশারকে রক্ষা করা তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু, বাশারকে কেবলই ইরানবিরোধী কৌশলের অংশ হিসেবে মোকাবিলা করে আসছিল আমেরিকা ও ইসরায়েল। যা থেকে স্পষ্ট, দিনকয়েক আগেও বাশার আল-আসাদের পতন ঘটতে যাচ্ছে, এমন বিশ্বাস ছিল না তাদের। ইসরায়েলের লাভ কোথায়? সিরিয়া ইসু্যতে ইসরায়েলের লাভকে বিবেচনা করতে হবে তার আঞ্চলিক শত্রম্ন ইরানের ক্ষতির মাপকাঠিতে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, 'মধ্যপ্রাচ্যে ইরানই একমাত্র দেশ, যারা ইসরায়েলের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করত। সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি ইসরায়েলের জন্য অস্বস্তির বিষয় ছিল।' মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের একটি 'প্রক্সি নেটওয়ার্ক' সক্রিয়। লেবাননে হিজবুলস্নাহ, ইয়েমেনে হুতি, ইরাকেও কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী ইরানের সহযোগী শক্তি হিসেবে তৎপর। সিরিয়ায় সেই নেটওয়ার্কেরই মিত্র হিসেবে ছিলেন বাশার আল-আসাদ। তাই বাশারের পতনে ইসরায়েল সবচেয়ে বড় 'বেনিফিশিয়ারি'। কারণ, এর মধ্য দিয়ে তারা ইরানকে নিউট্রালাইজ (নিষ্ক্রিয়) করতে পারছে। সিরিয়ার এই পরিবর্তনে ইরানের আধিপত্য একটা বড় ধাক্কা খেল। সিরিয়ার এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ইসরায়েল কৌশলগতভাবে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বায়েজিদ সরোয়ার। তার বিশ্লেষণ, বিমান হামলায় মূলত ইরানের সহায়তায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রাগারকে লক্ষ্যবস্তু করছে তেল আবিব। যেসব জায়গায় হামলা হয়েছে, তার মধ্যে রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন সংক্রান্ত একটি গবেষণা কেন্দ্র আছে বলে খবর দিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম। ইসরায়েল বলছে, বাশার সরকারের পতনের পর অস্ত্র যাতে 'উগ্রপন্থীদের হাতে চলে না যায়' সেজন্য তারা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতা হুগো বাচেগা তার প্রতিবেদনে বলেন, বাশারের অধীনে সিরিয়া ছিল ইরানিদের সঙ্গে হিজবুলস্নাহর যোগাযোগের অংশ। হিজবুলস্নাহকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর জন্য এটা ছিল মূল পথ। বাশারের পতন ঘটায় হিজবুলস্নাহর সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ইসরায়েলের জন্য সহজ হয়ে গেল। একই সঙ্গে গাজায় হামাসকে সহযোগিতা করাও কঠিন হবে ইরানের জন্য। ইরান সমর্থিত আরেকটি গোষ্ঠী ইয়েমেনের হুতিরাও বারবার বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। ফলে, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের 'এক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স' বা প্রতিরোধের অক্ষ। গোলানের নিয়ন্ত্রণ গোলান মালভূমি দামেস্কের ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। পাথুরে জায়গাটি আয়তনে বেশি বড় নয়, মাত্র এক হাজার বর্গকিলোমিটার। কিন্তু এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। উচ্চতার কারণে এখান থেকে রাজধানী দামেস্ক শহর এবং দক্ষিণ সিরিয়ার একটি বড় অংশ স্পষ্ট দেখা যায়। সামরিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য এটি আদর্শ স্থান। তা ছাড়া পার্বত্য এলাকা বলে কোনো সম্ভাব্য আক্রমণের পথে একটা চমৎকার প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবেও কাজ করে গোলান। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের সময়ও তারা এর সুবিধাটা পেয়েছিল। এছাড়া শুষ্ক ওই অঞ্চলে গোলান মালভূমি হচ্ছে পানির উৎস। মালভূমি বেয়ে নামা বৃষ্টির পানি যায় জর্ডান নদীতে, যেই পানি আশপাশের জমির উর্বরতা ধরে রাখে। যে কোনো শান্তিচুক্তির জন্য সিরিয়ার মূল শর্ত হলো, ইসরায়েলকে ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্তে ফিরে যেতে হবে। ইসরায়েল এটা মানলে গ্যালিলি সাগরের (মিঠা পানির হ্রদ) নিয়ন্ত্রণ পাবে। আরবদের মধ্যে এই হ্রদ লেক তিবেরিয়াস এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে লেক কিনেরেত নামেও পরিচিত। কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিল বিশুদ্ধ পানির উৎস ইসরায়েলের হাতছাড়া হয়ে যাবে। বরং ইসরায়েলের দাবি, গোলানের ওপর দিয়ে পূর্ব দিতে তার সীমানা আরও সম্প্রসারিত হওয়া উচিত। ইসরায়েলের জনমতও এই অঞ্চলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার পক্ষে। উলেস্নখ্য, ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে সিরিয়ার সঙ্গে ছয় দিনের যুদ্ধের সময় গোলান মালভূমি দখল করে এবং ১৯৮১ সালে একতরফাভাবে এটি নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে নেয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটিকে স্বীকৃতি না দিলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগের মেয়াদে ২০১৯ সালে আমেরিকা এর স্বীকৃতি দেয়। দখলের পর থেকে গোলানে ৩০টির বেশি ইহুদি বসতি স্থাপিত হয়েছে, যাতে আনুমানিক ২০ হাজার মানুষের বসবাস। বিদ্রোহীরা বাশারকে উৎখাতের পর গত সোমবারই গোলানের বাফার জোন, অর্থাৎ যেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা ছিল, সেখানে নিজের সেনাদের প্রবেশের ছবি প্রকাশ করে ইসরায়েল। গোলানে ইসরায়েলে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিকেও দেশটির সুবিধার তালিকায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার মনে করেন, এর ফলে আরব দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে, গোলানে ইসরায়েলের দখলের স্বীকৃতিদানকারী ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের কুশীলবরা তাদের তৎপরতাকে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কের অনুপাতেই সাজাবেন। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ